জাপানের হাত ধরে প্রথম মেট্রোরেলের যুগে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। উত্তরা থেকে কমলাপুর লাইন-৬-এ অর্থায়ন করছে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থা (জাইকা)। চলমান এমআরটি ১ ও ৫-এ দুটি প্রকল্পেও আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে দেশটি।
তবে বাংলাদেশে মেট্রোরেল মানেই জাপান, এই ধারা থেকে বের হয়ে আসছে সরকার। মেট্রোরেল লাইন-৪ প্রকল্পে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
রুটটি কমলাপুর থেকে শুরু হয়ে শেষ হবে নারায়ণগঞ্জের মদনপুরে। দেশটির সঙ্গে বেশ কয়েকবার নীতিনির্ধারণী সভা হয়েছে। বাংলাদেশে মেট্রোরেলের সঙ্গে যুক্ত হতে দক্ষিণ কোরিয়া আগ্রহ দেখিয়েছে।
প্রস্তাবিত মেট্রোরেল লাইন-৪ নির্মাণের সঙ্গে থাকার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত বাদ পড়ছে জাপান। এ প্রকল্পে অর্থায়ন চেয়ে গত সপ্তাহে দক্ষিণ কোরিয়ার ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন ফান্ডে (ইডিসিএফ) আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাবটি পাঠানো হয়েছে।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) তথ্য বলছে, এমআরটি-৪ রুটটি কমলাপুর থেকে শুরু হয়ে সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী-শনির আখড়া-সাইনবোর্ড-চট্টগ্রাম রোড দিয়ে শেষ হবে নারায়ণগঞ্জের মদনপুরে। মেট্রোরেলের দৈর্ঘ্য হবে ১৬ কিলোমিটার। এটি বাস্তবায়নে প্রাথমিক ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ২৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার ইডিসিএফ ঋণ দেবে ২১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। সরকার বহন করবে ৭ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। ডিএমটিসিএলের কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, খরচটি চূড়ান্ত নয়। বিস্তারিত সমীক্ষার পরই জানা যাবে কত টাকা খরচ হবে।
ঢাকা শহরের যানজট কমাতে উড়াল ও পাতাল মিলে মোট পাঁচটি মেট্রোরেল বানাচ্ছে সরকার। এর মধ্যে তিনটিতেই অর্থায়ন করছে জাইকা। প্রস্তাবিত এমআরটি ৪ প্রকল্পেও অর্থায়ন করতে চেয়েছিল দেশটি।
তবে বাংলাদেশ সরকার এগোয়নি। এই প্রকল্পে জাপানের পরিবর্তে কেন দক্ষিণ কোরিয়াকে নিচ্ছে সরকার, তা জানতে কথা হয় সংশ্লিষ্ট দপ্তরের পাঁচজন কর্মকর্তার সঙ্গে।
তাঁরা জানিয়েছেন, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের মেট্রোরেলের মান সমমানের। দুই দেশের মেট্রোরেলের খরচ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, জাপানের তুলনায় দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ঋণ নিলে মেট্রোরেলের খরচ পড়বে কম। তা ছাড়া একক দেশ হিসেবে জাপানের ঋণে তিনটি মেট্রোরেল করায় তাদের সঙ্গে দর-কষাকষির সুযোগ কমে গেছে। দেশটি যা খরচ ধরছে, তাই মেনে নিতে হচ্ছে সরকারকে। মূলত প্রতিযোগিতা বাড়ানোর জন্যই জাপানের বাইরে বিকল্প পথে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
তবে তথ্য বলছে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে সহযোগিতা স্মারক সই হয়। সেখানে বলা হয়, দুই দেশের সরকারি পর্যায়ে পিপিপি পদ্ধতিতে এমআরটি-৪ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। অবশ্য সে অবস্থান থেকে সরে এসেছে সরকার।
এমআরটি-৪ প্রকল্পটি প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে যুক্ত পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, এ প্রকল্পে দক্ষিণ কোরিয়া অর্থায়ন করবে। এটা সিদ্ধান্ত হয়েছে। মেট্রোরেল প্রকল্পে প্রতিযোগিতা থাকার জন্য এ সিদ্ধান্ত বলে জানান তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মেট্রোরেল লাইন-৬ প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত এক কর্মকর্তা বলেন, এই প্রকল্পের আওতায় পিয়ার, ট্রেনের বগি কেনাকাটায় যে টাকা খরচ হয়েছে, তা আরও কমে পাওয়ার সুযোগ ছিল। যেহেতু জাপান সরকার এই প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে, তাই তাদের দেশ থেকে যন্ত্রপাতি কেনার বাধ্যবাধকতা ছিল। সে জন্য বাজার দেখার সুযোগ ছিল না।
সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা বা আরএসটিপিতে মেট্রোরেল লাইন-৪ প্রকল্পের রুট ছিল কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ রেললাইন পর্যন্ত। কিন্তু সেই রুটটি পরিবর্তন করা হয়েছে। সংশোধন করে কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জের মদনপুর পর্যন্ত করা হয়েছে। যুক্তি হিসেবে ডিএমটিসিএলের কর্মকর্তারা বলছেন, কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত ডাবল লাইন নির্মাণের একটি প্রকল্প নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। অন্যদিকে পদ্মা সেতু রেল লিংক প্রকল্পটিও একই রুটের মধ্যে পড়েছে। সে কারণে এমআরটি-৪ প্রকল্পে রুট পরিবর্তন করা হয়েছে। এদিকে মেট্রোরেল লাইন-৪ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে গেলে বহু বছরের পুরোনো সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালকে সরাতে হবে। সে ক্ষেত্রে বাস টার্মিনাল সরিয়ে মদনপুর নেওয়া হবে। এমআরটি-৪-এর ডিপোও হবে মদনপুরে।
মেট্রোরেল লাইন-৪-এর জনসংযোগের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা (উপসচিব) নাজমুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, এই প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ-সংক্রান্ত প্রকল্প প্রস্তাব দেশটিতে পাঠানো হয়েছে।
দেশের প্রথম মেট্রোরেল হচ্ছে লাইন-৬। রুটটি উত্তরা থেকে শুরু হয়ে কমলাপুরে শেষ হবে। গত ২৮ ডিসেম্বর উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত রুটটি চালু হয়েছে। মতিঝিল পর্যন্ত চলতি বছরের শেষের দিকে আর কমলাপুর পর্যন্ত আগামী ২০২৫ সালে চালু করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছে ডিএমটিসিএল।
২১ দশমিক ২৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মেট্রোরেলে খরচ হচ্ছে ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাইকা ঋণ দিচ্ছে ১৯ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা। বাকি ১৩ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকার জোগান দেবে সরকার।
মেট্রোরেল লাইন-১ বিমানবন্দর এলাকা থেকে শুরু হয়ে শেষ হবে কমলাপুর রেলস্টেশন এলাকায়। ৩১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট খরচ হবে ৫১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাইকা কাছ থেকে ঋণ মিলবে ৩৩ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা। বাকি ১৭ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা সরকার দেবে।
মেট্রোরেল লাইন-৫-এর আওতায় সাভারের হেমায়েতপুর থেকে শুরু হয়ে শেষ হবে ভাটারায়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট খরচ ধরা হয়েছে ৪১ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাইকা ঋণ দেবে ৩০ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা। সরকার দেবে ১০ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা। এ প্রকল্পে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এডিবিও যুক্ত হয়েছে।।