অনেক প্রতীক্ষার পর ঢাকাতে মেট্রোরেল উদ্বোধন হচ্ছে। বিলম্বে হলেও এটা আমাদের জন্য আনন্দের খবর। এটি উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থায় নতুন মাত্রা যুক্ত হচ্ছে। ঢাকার গণপরিবহনে একটি বিশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা লক্ষ্য করা যায়। এখানে সেবার মান নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। প্রবীণ, প্রতিবন্ধী, নারী ও অসুস্থ যাত্রীরা বেশি বিড়ম্বনার শিকার হন। এই বিড়ম্বনা ও বৈষম্য নিরসনে মাইলফলক হতে পারে মেট্রোরেল। এটি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে নগরীর মানুষ সুফল পাবেন। আরামদায়ক ও নির্ভরযোগ্য পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে আধুনিক ঢাকা গড়ে তোলা সম্ভব। মেট্রোরেল ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা সেই পথে আরও এক ধাপ অগ্রসর হলাম।
মনে রাখতে হবে- ফ্লাইওভার আর মেট্রোরেলের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। শুধু ফ্লাইওভার নির্মাণ করে নগরীকে যানজটমুক্ত করা যায় না। কারণ ফ্লাইওভার কোনো বিকল্প সড়ক নয়। যে গণপরিবহন এক সময় ভূমি দিয়ে চলাচল করত, সেগুলো এই ক্ষেত্রে ওপর দিয়ে চলাচল করে মাত্র। কিন্তু তাতে যেমন যানজটের খুব একটা সুরাহা হয় না, তেমনই এটা টেকসই ব্যবস্থা হিসেবেও গড়ে ওঠে না। আমি বলব, ফ্লাইওভার একটি প্রাচীন ধারণা। বিশ্বের অনেক নগরেই এই ব্যবস্থা গড়ে উঠলেও নতুন করে কেউ এদিকে অগ্রসর হচ্ছে না, বরং পুরানোগুলো ভেঙে ফেলা হচ্ছে। বিশ্ব যেখানে ফ্লাইওভার ভাঙছে, সেখানে আমরা তৈরি করছি। আমি মনে করি, অজ্ঞতার কারণে যানজট নিরসনে ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে। এ ভুলের আর পুনরাবৃত্তি করা যাবে না।
সেদিক থেকে মেট্রোরেল একই সঙ্গে প্রাচীন এবং নির্ভরযোগ্য গণপরিবহন ব্যবস্থা। ফ্লাইওভারে অতিরিক্ত গাড়ির চাপে যানজট হয়। কিন্তু মেট্রোরেলে তার অবকাশ নেই। যাত্রীর চাপ যত বাড়বে, তত বেশিবার এটি চলবে। এখানে যানজট সৃষ্টির অবকাশই নেই।
এটা ঠিক, ইউরোপে মেট্রোরেলে যাত্রীর চাহিদা অপেক্ষাকৃত কম। কিন্তু ঢাকায় যাত্রীদের ঘিরে এর অমিত সম্ভাবনা রয়েছে। তবে মেট্রোরেল পরিকল্পিত না হলে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। স্টেশনের কাছে ছোট পরিবহন পৌঁছার ব্যবস্থা অবশ্যই থাকতে হবে। না হলে যাত্রীরা বাসা থেকে নির্দিষ্ট স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছবেন কীভাবে? আবার স্টেশনে নেমে যাতে সেখান থেকেই গন্তব্যে যেতে পরিবহন পান, সে ব্যবস্থা করতে হবে। যদি স্টেশনে নেমে গাড়ি পেতে অনেক দূর যেতে হয়, তাহলে গণপরিবহন ব্যবস্থার সেই উন্নয়নকে সার্বিকভাবে কার্যকর বলা যাবে না। স্টেশনের কাছে যাতে ছোট পরিবহন দাঁড়াতে পারে তার জন্য পর্যাপ্ত স্থান রাখতে হবে। এটা করা না গেলে যাত্রী ক্ষুব্ধ হবেন। নিচের সড়কেও যাতে যানজট না হয়, সে লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। সার্বিক বিষয়ে নিবিড় নজরদারির মাধ্যমে বসবাসযোগ্য ঢাকা গড়ে তোলা সম্ভব।
আমাদের কাজে সমন্বয়হীনতা দূর করতে হবে। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সরকার সরাসরি সেবা দিতে পারে না। পাটকল, রেল ও বিমান খাতের দিকে তাকালে এর সত্যতা পাওয়া যাবে। সরকারি প্রতিষ্ঠান সরাসরি পরিচালনার দায়িত্ব নিলে তা টেকসই হয় না। এ জন্য পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে ছেড়ে দিলে মেট্রোরেলের সুফল বেশি আসবে। সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্তরা অবহেলার সুযোগ খোঁজেন। স্টেশন পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা থেকে শুরু করে নানা অনিয়ম দেখা যায়। মেট্রোরেলের স্টেশন পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া এবং নামার পর গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব একসঙ্গে দিতে পারলে ভালো হতো।
মেট্রোরেলের ভাড়া সহনশীল রেখে এটিকে আমজনতার বাহনে রূপ দেওয়া দরকার। নিম্ন আয়ের মানুষ ১০০ টাকা ভাড়া শুনলে ৩ বার ভাববে। তারা পাই পাই করে হিসাব করবে। তাই তাদের কথা চিন্তা করে ভাড়া নির্ধারণ করা উচিত। নিরাপত্তা, সময় বাঁচানোর তাগিদে প্রবীণ ও নারী যাত্রীরা মেট্রোরেলের দিকে ঝুঁকবেন। কিন্তু নিম্নবিত্তদের সস্তায় যাতায়াতের সুযোগ করে দিলেই এর আসল উদ্দেশ্য প্রতিফলিত হবে।
অনেক সময় কৌশলী হতে হয়। মেট্রোরেলের আশপাশে অনেক বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মিত হবে। এসব থেকে লাভ আদায় করে নিতে হবে। যাত্রীদের ওপর অতিরিক্ত ভাড়া চাপিয়ে দিয়ে খরচ ওঠানোর চিন্তা বাদ দিতে হবে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে অন্যরা যখন কম খরচে উন্নয়ন কাজ করছে, আমরা সে তুলনায় অতিরিক্ত অর্থ খরচ করে উন্নয়ন কাজ করছি। ভবিষ্যতে মেট্রোরেলসহ যে উন্নয়ন কাজ হবে, সেখানে যাতে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় না হয়, সে ব্যাপারে মনোযোগী হতে হবে।
বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র যেখানে চালকবিহীন মেট্রোরেলের দিকে যাচ্ছে; সেখানে আমরা এই আধুনিক যুগে চালক দিয়ে রেল চালাতে যাব কেন? ঝুলন্ত তার থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ না নিয়ে আধুনিক পদ্ধতিতে যাওয়া দরকার। ২০০৪ সালে ব্যাংককে আধুনিক মেট্রোতে চড়ার অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে। কিন্তু এই আধুনিক যুগে বাংলাদেশে প্রাগৈতিহাসিক যুগের চিন্তা দেখতে পাচ্ছি। বিদেশে স্টেশন হয় একটি খুঁটির ওপর। আর ঢাকাতে ঘরের মতো করে স্টেশন তৈরি করা হয়েছে। এখানকার পরিবেশটা অন্ধকার। বৃষ্টির দিনে এসব স্টেশনের নিচে অনেককে আশ্রয় নিতে দেখা যাবে।
আমার আশঙ্কা, মেট্রোরেলের পরামর্শদাতারা আমাদের ঠকিয়েছেন। ৪০-৫০ বছর আগের চিন্তার প্রতিফলন তাঁরা দেখিয়েছেন এখানে। পরবর্তী সময়ে কৌশল পাল্টিয়ে সাশ্রয়ী হয়ে আধুনিক মেট্রোরেল নির্মাণ করতে হবে।
জাপান, সিঙ্গাপুরে অফ টাইমে প্রবীণ যাত্রীদের বিনামূল্যে যাতায়াতের সুযোগ দেওয়া হয়। আমরাও পিক টাইমের পর অফ টাইমে প্রবীণ, শিশুদের ব্যাপারে সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে পারি। বিনা পয়সায় না হোক, কম টাকা নেওয়া যেতে পারে। এটা করা গেলে পিক টাইমে যাত্রীর চাপ কমবে। আবার অফ টাইমে রেল অলস বসে থাকবে না। মেট্রোরেল এবং বিআরটি প্রকল্পের সঠিক ব্যবহার হলে যানজট কমার পাশাপাশি ঢাকাবাসী লাভবান হবে।
ভাড়া সহনশীল রেখেও ভর্তুকি না দিয়ে মেট্রোরেল চালানো সম্ভব। এটা করতে হলে আগেই বলেছি, আশপাশের বাণিজ্যিক স্থাপনা থেকে খরচ তুলে আনতে হবে। এসব আধুনিক পদ্ধতিতে যাওয়ার আগে হতে হবে আরও বাস্তবিক।
আমাদের দেশে ভারী উন্নয়ন দরকার রয়েছে কিনা, দীর্ঘমেয়াদে হলেও বিবেচনায় নিতে হবে। যদি ১০০ কিলোমিটার গতির মেট্রোরেল ঢাকা শহরে চলাচলের উপযোগী না হয়, তাহলে ডাটা নিয়ে সঠিক গতির দিকে যেতে হবে। যাত্রীর চাপ সামাল দিতে দূরদর্শী হতে হবে। বিলাসী খরচে যাওয়ার দরকার নেই। পরামর্শক বললেই সব মেনে নেওয়া যাবে না; বাস্তবতা বুঝতে হবে। আমরা মুখরোচক বুলির চেয়ে ডাটাভিত্তিক উন্নয়ন চাই এবং সেটা হতে হবে সুলভ ও টেকসই।
ড. শামসুল হক :গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ; অধ্যাপক, পুরকৌশল বিভাগ, বুয়েট