ঢাকায় মেট্রোরেল চালু হয়েছে দুই বছরের বেশি সময় পেরিয়েছে। গণপরিবহনের এই বাহনটি ধীরে ধীরে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ব্যস্ত সময়ে ভিড়ের কারণে অনেক যাত্রী উঠতেও পারছেন না। এখন দৈনিক যাত্রী সংখ্যা চার লাখ ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এগোচ্ছে দেশের প্রথম মেট্রোরেল। কিন্তু এখনো টিকিট বা পাসের সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি।
স্থায়ী পাসে টাকা শেষ হয়ে গেলে নতুন করে টাকা ভরার জন্য (রিচার্জ) এখনো স্টেশনে গিয়ে লাইন দিতে হয়। অথচ বিশ্বের অনেক দেশেই ঘরে বসে টাকা রিচার্জ করা যাচ্ছে।
মেট্রোরেল পরিচালনায় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টিকিট সরবরাহ বৃদ্ধি ও ঘন ঘন ট্রেন পরিচালনা করা গেলে যাত্রী আরও বাড়বে। ঘরে বসে স্থায়ী র্যাপিড বা এমআরটি পাস রিচার্জ করা গেলে যাত্রীদের দুর্ভোগও কমে যাবে।
স্থায়ী পাসের রিচার্জ আরও সহজ করার কাজটিও ডিটিসিএর হাতে রয়েছে। ফলে দুই সংস্থার ঠেলাঠেলিতে দুই বছরেও টিকিট কাটা ও রিচার্জ সহজ করা যায়নি।
প্রশ্ন হচ্ছে—যাত্রীদের দুর্ভোগ কমানোর উদ্যোগ কেন নেওয়া হচ্ছে না? খোঁজ নিয়ে জানা গেল, টিকিট সরবরাহ ও রিচার্জ সহজীকরণ বিষয়টি সরকারি দপ্তরের আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পড়েছে। মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। কিন্তু স্থায়ী বা র্যাপিড পাস সরবরাহের দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। স্থায়ী পাসের রিচার্জ আরও সহজ করার কাজটিও ডিটিসিএর হাতে রয়েছে। ফলে দুই সংস্থার ঠেলাঠেলিতে দুই বছরেও টিকিট কাটা ও রিচার্জ সহজ করা যায়নি।
দীর্ঘদিন ধরেই ডিএমটিসিএলের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন সরকারের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। গত মাসের শেষের দিকে মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনায় আন্তর্জাতিকভাবে বিশেষজ্ঞ ফারুক আহমেদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়া মেট্রোরেলের সংখ্যা বাড়িয়ে ঘন ঘন ট্রেন পরিচালনা করা হয়নি কিছু ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে। ডিএমটিসিএল সূত্র বলছে, দক্ষ লোকবলের সংকট দেখিয়ে এত দিন মেট্রোরেলের সংখ্যা বাড়ানো হয়নি। অবশ্য কর্তৃপক্ষের এমনও ধারণা ছিল যে ঠাসাঠাসি করে যাত্রী পরিবহন না করলে মেট্রোরেলে লোকসান হবে।
ট্রেন বাড়ালে যাত্রী ঠাসাঠাসি করে যাবে না। কিন্তু এখন যে ব্যস্ত সময়ে ঠাসাঠাসির কারণে অনেক যাত্রী ট্রেনে উঠতে পারেন না, এটা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক বর্তমান লোকবল দিয়েই ট্রেন বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। এখন শুক্রবার বেলা তিনটা থেকে মেট্রোরেল চালু হয়। কিন্তু শুক্রবারও সারা দিন মেট্রোরেল চালুর চিন্তা করছে কর্তৃপক্ষ।
আসলে মেট্রোরেল প্রকল্প নেওয়ার সময় বলা হয়েছিল, সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত এই সেবা চলমান থাকবে। পূর্ণ সক্ষমতায় প্রতি সাড়ে তিন মিনিট পরপর ট্রেন চলার কথা। এভাবে চললে ঘণ্টায় ৬০ হাজার এবং দিনে ৫ লাখ যাত্রী চলাচল করতে পারবেন। অন্যদিকে কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেল সম্প্রসারণের কাজ চলছে। সেটা হলে দৈনিক ৬ লাখ ৭৭ হাজার যাত্রী পরিবহন করা যাবে।
টিকিট জটিলতা
এমআরটি বা র্যাপিড পাসে যাতায়াত করলে ১০ শতাংশ ছাড় পাওয়া যায়। বর্তমানে মেট্রোরেলের ৫৫ শতাংশ যাত্রী র্যাপিড বা এমআরটি কার্ডে যাতায়াত করেন। বাকি ৪৫ শতাংশ যাত্রী ব্যবহার করেন একক যাত্রার কার্ড। দুই ধরনের কার্ডেরই সংকট আছে।
শুরু থেকেই মেট্রোরেলের কার্ড সরবরাহ করছে জাপানের নিপ্পন সিগন্যাল কোম্পানি। প্রথম দিকে তারা একক যাত্রার কার্ড সরবরাহ করে ৩ লাখ ১৩ হাজার। এমআরটি কার্ড সরবরাহ করে ৭ লাখ ২৮ হাজারের মতো। এমআরটি কার্ডের প্রায় সব বিক্রি হয়ে গেছে। এর মধ্যে আর নতুন করে কার্ড কিনতে পারেনি ডিএমটিসিএল।
এ বিষয়ে ডিটিসিএর স্লোগান হলো, ‘ওয়ান কার্ড ফর অল ট্রান্সপোর্ট’। তবে দেশে মেট্রোরেল ছাড়া অন্য কোনো বাহনে এখনো র্যাপিড পাস ব্যবহার হচ্ছে না।
এখন মেট্রোরেলের জন্য র্যাপিড পাস সরবরাহ করছে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। একটিমাত্র কার্ড ব্যবহার করে সব ধরনের গণপরিবহনে ভাড়া পরিশোধের সুবিধা চালু করতে ২০১৫ সালে প্রকল্প নেয় ডিটিসিএ। ‘র্যাপিড পাস’ নামে পরিচিত এ কার্ডের মাধ্যমে রেল, সড়ক ও নৌপথে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানটি ভাড়া আদায় করতে পারবে। এ বিষয়ে ডিটিসিএর স্লোগান হলো, ‘ওয়ান কার্ড ফর অল ট্রান্সপোর্ট’। তবে দেশে মেট্রোরেল ছাড়া অন্য কোনো বাহনে এখনো র্যাপিড পাস ব্যবহার হচ্ছে না।
ডিটিসিএ ঠিকাদারের মাধ্যমে র্যাপিড পাস সংগ্রহ করে। এরপর তা মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষকে দেয়। গত প্রায় ছয় মাস ধরেই স্থায়ী কার্ডের সংকট চলছে। এর মধ্যে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ চার কিস্তিতে ডিটিসিএ থেকে ৭৫ হাজারের মতো কার্ড পেয়েছে। সর্বশেষ গত সপ্তাহে মাত্র দেড় হাজার কার্ড সরবরাহ করা হয়েছে। এর প্রায় সবই বিক্রি হয়ে গেছে। আগামী সপ্তাহে কার্ড না পেলে বিক্রি করা যাবে না।
মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ এখন প্রতিদিন এক হাজার থেকে দেড় হাজার কার্ড বিক্রি করে থাকে। এদিকে একক যাত্রার কার্ডও এখন আর মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ কিনছে না। কিআউআর কোডসংবলিত কাগজের টিকিট চালুর পরিকল্পনা নিয়েছে তারা। এটিও চালু হয়নি। ফলে কার্ডের সংকট থেকেই যাচ্ছে।
রিচার্জ সহজ হচ্ছে না
মেট্রোরেলের যাত্রীরা এমআরটি পাসে প্রতিবারে সর্বোচ্চ ১০ হাজার এবং র্যাপিড পাসে সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা রিচার্জ করতে পারে। তবে এর জন্য যাত্রীদের স্টেশনে যেতে হয়। কখনো কখনো দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে রিচার্জ করা লাগে। অথচ মুঠোফোনে বিকাশ, নগদ বা রকেট অ্যাপ ব্যবহার করে ঘরে বসেই মানুষ এখন বিদ্যুৎ, মুঠোফোন, ইন্টারনেটসহ বিভিন্ন বিল দিতে পারছে। মেট্রোরেলে এ ব্যবস্থা চালু করা গেলে যাত্রীদের দুর্ভোগ অনেকটাই লাঘব হতো।
ভারত, হংকংসহ অনেক দেশেই ব্যাংকের ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড মেট্রোরেলের পাস হিসেবে ব্যবহার করা যায়। বাংলাদেশে এ ধরনের উদ্যোগ এখনো নেওয়া হয়নি।
এই প্রতিবেদক গত শনিবার সন্ধ্যায় কারওয়ান বাজার স্টেশনে এমআরটি পাস রিচার্জ করতে গেলে প্রায় ১০ জনের পেছনে লাইনে দাঁড়াতে হয়। স্টেশনের কাউন্টারের কর্মীদের কাজের গতিও বেশ ধীর। ফলে প্রায় আধা ঘণ্টা অপেক্ষার পর কার্ড রিচার্জ করা সম্ভব হয়।

ঘরে বসে রিচার্জ করার একটা উদ্যোগ ডিটিসিএ নিয়েছে। তবে এটি কবে কার্যকর করা যাবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। এ ছাড়া ডিটিসিএর বর্তমান উদ্যোগ কার্যকর হলেও সব যাত্রীর পক্ষে এর পুরো সুবিধা নেওয়া সম্ভব হবে না।
জাইকার সহযোগিতায় ‘এস্টাবলিশমেন্ট অব ক্লিয়ারিং হাউস ফর ইন্টিগ্রেটিং ট্রান্সপোর্ট টিকিটিং সিস্টেম ইন ঢাকা সিটি অ্যান্ড অ্যাডজাসেন্ট ডিস্ট্রিক্ট’ শীর্ষক প্রকল্প রয়েছে ডিটিসিএর। এটি সংক্ষেপে ‘ক্লিয়ারিং হাউস’ নামে পরিচিত। প্রকল্পের অধীনেই অনলাইনে র্যাপিড পাস রিচার্জ করার নতুন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ঘরে বসে র্যাপিড পাস রিচার্জ করার ব্যবস্থা চালু করতে গত মাসে প্রাথমিক দরপত্র আহ্বান করেছে ডিটিসিএ। এতে ৩৩টি তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে।
মেট্রোরেলের যাত্রীরা এমআরটি পাসে প্রতিবারে সর্বোচ্চ ১০ হাজার এবং র্যাপিড পাসে সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা রিচার্জ করতে পারে। তবে এর জন্য যাত্রীদের স্টেশনে যেতে হয়। কখনো কখনো দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে রিচার্জ করা লাগে।
ডিটিসিএ কর্মকর্তারা বলছেন, অনলাইন রিচার্জ চালু হলে মুঠোফোনে বিকাশ, রকেট ও নগদসহ অন্যান্য ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে র্যাপিড পাসের টাকা ভরা যাবে। তবে এর জন্য মুঠোফোনে নিয়ার ফিল্ড কমিউনিকেশন (এএফসি) সুবিধা থাকতে হবে। অর্থাৎ এনএফসি সুবিধা থাকা মুঠোফোনে কার্ডটা রেখে রিচার্জ করতে হবে। এনএফসি সুবিধা না থাকলেও রিচার্জ করা যাবে। তবে এ ক্ষেত্রে রিচার্জ করার পর মেট্রোরেলের স্টেশনে থাকা যন্ত্রে স্পর্শ করে তা সমন্বয় করে নিতে হবে। অর্থাৎ পুরোপুরি অনলাইন সেবা হচ্ছে না। এ ছাড়া স্টেশনে রিচার্জ করা কার্ড কার্যকর করতে যে যন্ত্র লাগবে, এর সহজলভ্যতা দরকার।
এখন মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ ও সরকারের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত—মেট্রোরেলের সংখ্যা বাড়ানো, টিকিট প্রাপ্তি সহজ করা এবং র্যাপিড ও এমআরটি পাসে টাকা ভরার কাজটি ঘরে বসে সম্পন্ন করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করা। অন্যথায় ঢাকার মেট্রোরেল যাত্রীরা আন্তর্জাতিক মানের সেবা থেকে বঞ্চিতই থেকে যাবেন।
আনোয়ার হোসেন
ঢাকা