ঢাকার মেট্রোরেল পরিচালনায় প্রথমবারের মতো দায়িত্ব পেলেন এ খাতে বৈশ্বিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন প্রকৌশলী। তাঁর নাম ফারুক আহমেদ।
আজ মঙ্গলবার মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনায় নিয়োজিত রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্ব নিয়েছেন ফারুক আহমেদ।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর মেট্রোরেল পরিচালনাকারী ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানির (ডিএমটিসিএল) এমডি নিয়োগে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞপ্তি দেয় সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। এই পদে নিয়োগ পেতে দেশি-বিদেশি ৭৬ জন আবেদন করেন।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) উপাচার্য অধ্যাপক এ বি এম বদরুজ্জামানের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি কমিটি আবেদনকারীদের মধ্য থেকে সাতজনের সংক্ষিপ্ত তালিকা করে। তা থেকে ফারুক আহমেদকে চূড়ান্তভাবে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়।
অস্ট্রেলিয়া, ভারত, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও হংকং—এই পাঁচটি দেশে মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনায় কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে ফারুক আহমেদের। তিনি ৩৭ বছর দেশে-বিদেশে বড় অবকাঠামো নির্মাণ ও পরিচালনার বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করেছেন। এর মধ্যে ২৫ বছরের অভিজ্ঞতা মেট্রোরেল পরিচালনা ও পরিবহন অবকাঠামো প্রকল্পে।
ডিএমটিসিএলের এমডি পদে দায়িত্ব নেওয়ার আগে ফারুক আহমেদ ভারতের উত্তর প্রদেশে মালামাল পরিবহনের জন্য ৩ হাজার ৭০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বিশেষায়িত মহাসড়ক নির্মাণ প্রকল্পে কর্মরত ছিলেন। তার আগে কলকাতা মেট্রোরেলের ইস্ট-ওয়েস্ট লাইনে কাজ করেছেন।
এমডি নিয়োগের জন্য নাম বাছাইয়ের কমিটি নিশ্চিত হয়েছে যে মেট্রোরেল নির্মাণ, পরিচালনা, নকশা প্রণয়ন, ঠিকাদারের সঙ্গে দর–কষাকষিসহ নানা বিষয়ে ফারুক আহমেদের বিস্তর অভিজ্ঞতা রয়েছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় ক্ষতিগ্রস্ত মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া মেট্রোরেল স্টেশন চালু করার ক্ষেত্রেও যুক্ত ছিলেন ফারুক আহমেদ। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার বলেছিল, ওই দুটি স্টেশন চালু করতে এক বছর সময় লাগতে পারে। খরচ হতে পারে সাড়ে ৩০০ কোটি টাকার মতো।
অন্তর্বর্তী সরকার স্টেশন দুটি চালুর উদ্যোগ নিলে ফারুক আহমেদ যুক্ত হন। প্রাথমিকভাবে অন্য স্টেশন ও স্থাপনা থেকে কিছু সরঞ্জাম স্থানান্তর এবং স্থানীয়ভাবে কিছু পণ্য কিনে প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয় করে তিন মাসের মধ্যে দুটি স্টেশন চালু করা হয়।
এদিকে ডিএমটিসিএল সূত্র জানায়, কাজীপাড়া ও মিরপুর–১০ নম্বর স্টেশনে আরও কিছু প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনার জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এ কাজে সাকল্যে ১৮ কোটি টাকা লাগবে।
ফারুক আহমেদ চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) থেকে ১৯৮২ সালে পুরকৌশল বিষয়ে স্নাতক করেন। ১৯৯০ সালে অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুরকৌশলে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০৪ সালে তিনি অস্ট্রেলিয়া থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) সম্পন্ন করেন। এ ছাড়া আয়ারল্যান্ড, পর্তুগাল, হংকং, নিউজিল্যান্ড ও ম্যাকাও থেকেও নানা পেশাগত দক্ষতাবিষয়ক বিভিন্ন ডিগ্রি নিয়েছেন তিনি।
যা করতে চান নতুন এমডি
বুধবার দায়িত্ব নেওয়ার পর সচিবালয়ে এই প্রতিবেদকের কথা হয় ফারুক আহমেদের সঙ্গে। তিনি জানান, মেট্রোরেল নির্মাণ এবং পরিচালনায় খরচ কমানো তাঁর অন্যতম লক্ষ্য। এ ছাড়া যাত্রীভাড়ার বাইরে মেট্রোরেলের স্টেশন ও অন্যান্য স্থাপনা ব্যবহার করে কীভাবে আয় বাড়ানো যায়, সেই চেষ্টা চালাবেন তিনি। এর মধ্যে মেট্রোরেলের স্টেশনে ব্যাংকের বুথ স্থাপন এবং লন্ড্রি চালুসহ অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় আছে।
যাত্রীদের সুবিধা বাড়ানোর বিষয়ে ফারুক আহমেদ বলেন, মুঠোফোনে আর্থিক সেবা বা এমএফএস ব্যবস্থাসহ অন্যান্য ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে ঘরে বসে মেট্রোরেলের কার্ডে টাকা ভরার (রিচার্জ) বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন তিনি। এমনকি ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ডকে মেট্রোরেলের পাস হিসেবে যাতে ব্যবহার করা যায়, সেই চিন্তাও আছে। মেট্রোরেলের ভেতরে বিনা মূল্যে ইন্টারনেট (ওয়াইফাই) সুবিধা চালুর পরিকল্পনা আছে বলেও জানান নতুন এমডি।

ফারুক আহমেদ বলেন, সিঙ্গাপুরে দুই মিনিট, হংকং দেড় মিনিট এবং সিডনিতে (অস্ট্রেলিয়া) প্রতি চার মিনিট পরপর মেট্রোরেল চলাচল করে। ঢাকার মেট্রোরেলে বিদ্যমান ব্যবস্থা দিয়েই দুই ট্রেনের বিরতি কমানো যাবে এবং তা তাঁরা করবেন।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে ফারুক আহমেদ বলেন, এখন জাপান থেকে পুরো মেট্রোট্রেন তৈরি করে আনা হয়। তাঁর লক্ষ্য হবে বাংলাদেশে মেট্রোট্রেন তৈরির কারখানায় বিনিয়োগ আনা। ভারত শুরুতে জাপান থেকে মেট্রোট্রেন আনত। এখন জাপানি প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভারতেই সেই ট্রেন তৈরি হচ্ছে। সেগুলো অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশেও যাচ্ছে।
যাত্রীদের সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা হবে জানিয়ে ফারুক আহমেদ বলেন, গাড়িতে চলাচলকারী যাত্রীদের মেট্রোরেলে নিয়ে আসতে পারাই হবে সফলতা।
আমলাদের নিয়োগে শর্ত পাল্টানো হয়েছিল
রাজধানীতে ছয়টি মেট্রোরেল লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারে। এর মধ্যে একটির নির্মাণ শেষের পথে (উত্তরা থেকে কমলাপুর: লাইন–৬)। কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর ও নর্দা থেকে পূর্বাচল (লাইন–১) পথে একটি এবং সাভারের হেমায়েতপুর থেকে গুলশান হয়ে ভাটারার পথে (লাইন–৫ নর্দান) একটি মেট্রোরেল নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। এই নির্মাণ ও মেট্রোরেল পরিচালনার কাজ করে ডিএমটিসিএল।
ফারুক আহমেদের আগে ডিএমটিসিএলের ভারপ্রাপ্ত এমডি ছিলেন সরকারের অতিরিক্ত সচিব আব্দুর রউফ। তাঁর আগে প্রায় আট বছর এই দায়িত্ব পালন করেন সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব এম এ এন সিদ্দিক।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর এম এ এন সিদ্দিকের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে দেওয়া হয়। এর আগে প্রকল্প চালু হওয়ার পর থেকে সরকারের অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তারাই ডিএমটিসিএলের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন।
ডিএমটিসিএল সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালে কোম্পানির যাত্রা শুরুর সময় ২০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকা এবং কারিগরি বিষয়েও দক্ষতা থাকা কোনো ব্যক্তিকে এমডি নিয়োগের সুপরিশ করেন জাপানের পরামর্শকেরা। সেই অনুযায়ী কোম্পানির সংঘস্মারক ও সংঘবিধি তৈরি করা হয়।
২০১৭ সালে সড়ক বিভাগের সচিব পদ থেকে অবসর নিয়েই ডিএমটিসিএলের এমডির দায়িত্ব নেন এম এন সিদ্দিক। এরপর তাঁর নিয়োগ বৈধ করতে নিয়ম পরিবর্তন করা হয়। যোগ্যতার শর্তে ‘সড়ক পরিবহন খাতে অভিজ্ঞ অবসরপ্রাপ্ত সচিব’ যোগ করা হয়।
সড়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিকে মেট্রোরেলের এমডি পদে নিয়োগের উদ্যোগ নেন। নতুন বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী এমডি পদের জন্য প্রার্থীদের সিভিল, ইলেকট্রিক্যাল বা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ডিগ্রি থাকা বাধ্যতামূলক ছিল। এর পাশাপাশি প্রকল্প ব্যবস্থাপনা, ব্যবসায় প্রশাসন বা পরিবহন ব্যবস্থাপনায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকলে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে বলে উল্লেখ করা হয়।
বড় গণপরিবহন প্রকল্পে অন্তত ২০ বছরের অভিজ্ঞতা (যার মধ্যে তিন বছর শীর্ষ নেতৃত্বে থাকা) এবং আন্তর্জাতিক মানের জটিল প্রকল্প বাস্তবায়নে অভিজ্ঞতা থাকা প্রার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল।