যুক্তরাষ্ট্রে ‘ঐতিহাসিক’ সফর চলাকালে সে দেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট বরাক ওবামার ‘পরামর্শ’ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে খোলামনে নিতে পারেননি, হোয়াইট হাউসের আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন সাংবাদিকের প্রশ্নও যে তাঁকে অখুশি করেছিল, ক্রমে তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।
ভারতের শাসক দল ও সরকারের পক্ষে শুরু হয়েছে সম্মিলিত প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ। বড় করে তুলে ধরা হচ্ছে ওবামার ‘হুসেন’ সত্তা এবং দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সাংবাদিক সাবরিনা সিদ্দিকির ‘পাকিস্তানি মুসলমান’ পরিচয়। প্রত্যাশিতভাবে প্রধানমন্ত্রী মোদি এ ক্ষেত্রেও মৌন!
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে সিএনএন সম্প্রচারিত সাক্ষাৎকারে সাবেক প্রেসিডেন্ট বরাক ওবামা ভারতে ‘সংখ্যালঘু নির্যাতন’ প্রসঙ্গে সোজাসাপটা জানিয়েছিলেন, কূটনৈতিক আলোচনার সময় প্রেসিডেন্ট বাইডেনের উচিত মুসলমানদের নিরাপত্তার বিষয়টি তুলে ধরা। তিনি বলেছিলেন, তাঁর সঙ্গে মোদির কথা হলে তিনি বলতেন, সংখ্যালঘু স্বার্থ না দেখলে একটা সময় দেশটা ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে। তাতে হিন্দু ভারতেরও কিন্তু মঙ্গল হবে না।
ওবামার নাম উচ্চারণ না করে গত রোববার নির্মলা বলেন, যাঁর আমলে যুক্তরাষ্ট্র ৬টি মুসলমান দেশে ২৬ হাজার বোমা ফেলেছিল, তাঁর অভিযোগ মূল্যহীন; বিশ্বাসযোগ্যও নয়।
প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন ছাড়া বিজেপির সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলন ডেকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর এই বিষোদ্গার সম্ভব কি? প্রশ্নটি ইতিমধ্যেই চর্চায় উঠে এসেছে। বোঝা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী নিজেই সাবেক প্রেসিডেন্টের ওই সমালোচনা খোলামনে নিতে পারেননি। মন্ত্রীকে দিয়ে এই অভিব্যক্তির প্রকাশ বুঝিয়ে দিচ্ছে তিনি কতটা ক্ষুব্ধ।
ওবামাকে প্রথম আক্রমণ করেছিলেন বিজেপি-শাসিত আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। ওবামার সাক্ষাৎকার প্রচারিত হওয়ার পর ভারতীয় সাংবাদিক রোহিণী সিং টুইট করে জানতে চেয়েছিলেন, ‘অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে গুয়াহাটিতে ওবামার বিরুদ্ধে কি কোনো এফআইআর দায়ের করা হয়েছে? ওবামাকে কোনো ফ্লাইট থেকে নামিয়ে গ্রেপ্তার করতে আসাম পুলিশ কি ওয়াশিংটন যাচ্ছে?’
এই টুইট করারও এক প্রেক্ষাপট আছে। গুজরাটের কংগ্রেস বিধায়ক জিঘ্নেশ মেঘানির বিরুদ্ধে হিন্দু অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার জন্য আসামে কয়েকটি এফআইআর দায়ের করা হয়েছিল। তাঁকে গ্রেপ্তার করতে আসাম পুলিশ গুজরাটে যায়। গ্রেপ্তার করে আসামেও নিয়ে আসে।
একই অভিযোগে কংগ্রেস মুখপাত্র পবন খেরাকে দিল্লি বিমানবন্দরে বিমান থেকে নামিয়ে গ্রেপ্তার করেছিল আসাম পুলিশ। পবন খেরা বেঁচেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে। মেঘানি ছাড়া পেয়েছিলেন বেশ কিছু দিন ভোগান্তির পর। রোহিণী সিং এ কারণেই জানতে চেয়েছিলেন, ওবামাকে ধরতে আসাম পুলিশ ওয়াশিংটন যাবে কি না।
সেই টুইট ও তার জবাবে সময় নষ্ট না করে ২৩ জুন হিমন্ত বিশ্বশর্মা টুইট করে বলেন, ‘ভারতে বহু হুসেন ওবামা রয়েছে। ওয়াশিংটনে যাওয়ার আগে তাদের ব্যবস্থা করাই প্রথম কাজ। আসাম পুলিশ সেই অগ্রাধিকারকেই গুরুত্ব দেবে।’
বরাক ওবামাকে আসামের মুখ্যমন্ত্রী সচেতনভাবেই ‘হুসেন ওবামা’ বলে চিহ্নিত করেছেন। সাবেক প্রেসিডেন্টের ‘মুসলমানত্বের’ ওপর জোর দিয়েছেন। কংগ্রেসসহ বিরোধীরা তা নিয়ে সরব হয়েছেন। কংগ্রেসের মুখপাত্র সুপ্রিয়া শ্রীনাতে বলেন, প্রধানমন্ত্রী যাঁকে ‘মাই ফ্রেন্ড বরাক’ বলে সম্বোধন করেছেন, তিনি হয়ে গেলেন ‘হুসেন’ ওবামা? বিরোধীদের অভিযোগ, ওবামার মন্তব্যে বিজেপি ক্ষিপ্ত। তাঁকে বিদ্ধ করে বিজেপি দেশের মুসলমানদের ‘শিক্ষা’ দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে।
ওবামার মন্তব্য ও সাবরিনা সিদ্দিকির প্রশ্ন নিয়ে সামাজিক মাধ্যম যখন তোলপাড়, তখনই শুরু হয় জল্পনা, সাবেক প্রেসিডেন্টের মুসলমান পরিচয় তুলে ধরার খেসারত হিমন্ত বিশ্বশর্মাকে দিতে হবে কি না। প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রে থাকার সময় ওই টুইটে তাঁর অনুমোদন রয়েছে কি না, সে প্রশ্নও সামাজিক মাধ্যম ও রাজনৈতিক চর্চায় উঠে এসেছিল। আরও উঠেছিল এই কারণে যে ওবামা ও বাইডেন একই দলের সদস্য। ওবামা প্রেসিডেন্ট থাকাকালে বাইডেন ছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। কিন্তু অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণের মন্তব্যের পর এখন স্পষ্ট, তাঁর অনুমোদন ছাড়া দলীয় সদর দপ্তর থেকে ওবামাকে এভাবে আক্রমণ করা সম্ভব নয়।
সংবাদ সম্মেলনে নির্মলা বুঝিয়ে দেন, ওবামা যা বলেছেন, তার টাইমিং, সবটাই পরিকল্পিত চক্রান্ত ও সে–সংক্রান্ত প্রচারের অঙ্গ। প্রচার চালানো হয়েছে সেই সময়, যখন প্রধানমন্ত্রী মোদি সে দেশে সফররত। তিনি বলেন, ভারতীয় মুসলমানদের নিয়ে তাঁর দুশ্চিন্তা প্রকাশ স্তম্ভিত করে দিয়েছে। যিনি ভারতীয় মুসলমানদের নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, তাঁর আমলে তাঁর দেশ ৬টি মুসলিম দেশে ২৬ হাজার বোমা ফেলেছিল। এই মানসিকতার লোকজনের অভিযোগ জনতা বিশ্বাস করবে না।
সামাজিক মাধ্যমে একই রকম সক্রিয় ভারতের ‘হিন্দুত্ববাদী ব্রিগেড’। তাদের লক্ষ্যে সাবরিনা সিদ্দিকি। সাবরিনা মার্কিন নাগরিক। তাঁর বাবা ভারতীয়। মা পাকিস্তানি। তাঁর জন্ম যুক্তরাষ্ট্রে। দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের ৩৭ বছর বয়সী এই সাংবাদিক হোয়াইট হাউস কাভার করেন। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে তিনি ও ভারতের পক্ষে পিটিআইয়ের প্রতিনিধির প্রশ্ন হোয়াইট হাউস আগেই বেছে নিয়েছিল। বাইডেন ও মোদি দুজনেই জানতেন কোন সাংবাদিক কোন প্রশ্ন করবেন। সংখ্যালঘু, মানবাধিকার হরণসংক্রান্ত সাবরিনার প্রশ্ন ছিল দুজনের উদ্দেশেই।
সাবরিনার ওপর হিন্দুত্ববাদী ব্রিগেডের রাগ ওই প্রশ্ন করার জন্য। সে কারণেই সামাজিক মাধ্যমে তিনি মুসলমান ও পাকিস্তানি—এ দুই বিষয়ে জোর দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি নিজেকে যে আদ্যন্ত ভারতীয় মনে করেন, তা প্রমাণে সাবরিনা পুরোনো দুটি ছবি সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করেন। একটিতে তাঁর গায়ে ভারতীয় ক্রিকেট দলের জার্সি।
২০১১ সালে বিশ্বকাপ ক্রিকেট চলাকালে তিনি যে ভারতকে সমর্থন জানিয়েছিলেন, তার নমুনা। অন্যটিতে দেখা যাচ্ছে, তাঁর বারা সোফায় বসে। পাশে বসে সাবরিনা। টিভিতে ভারতের ক্রিকেট ম্যাচ চলছে। বিব্রত ও বিস্মিত সাবরিনা টুইটে লিখেছেন, আমার ব্যক্তিগত ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন। কখনো কখনো মনে হয়, পরিচিতি যেন আসলের চেয়ে জটিল।
ভারতে সংখ্যালঘুদের অবস্থান, মানবাধিকার হরণ, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব, গণতন্ত্রের অধোগমন নিয়ে পশ্চিমা দুনিয়ার সমালোচনার জবাবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যুক্তরাষ্ট্র সফরে যা কিছু বলেছেন, বাস্তব পরিস্থিতি যে ভিন্ন, তা ওবামা ও সাবরিনা–বিতর্ক পরিষ্কার করে দিল।