মুগ্ধকে নিয়ে ভাই স্নিগ্ধর বেদনাঘন পোস্ট

0
18
শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ (বাঁয়ে) এবং মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় গত বছরের ১৮ জুলাই গুলিতে শহীদ হন মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ। সেই হৃদয়বিদারক ঘটনার এক বছর পূর্ণ হয়েছে আজ। মুগ্ধর ছোট ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ স্মরণ করেছেন ভাই হারানোর আগের দিনের কথা।

শুক্রবার (১৮ জুলাই) ফেসবুকে নিজের ভেরিফায়েড আইডিতে ‘আজ একটা গল্প বলি’ শিরোনামে এক পোস্টে তিনি সেই দিনের কিছু স্মৃতিময় মুহূর্তে কথা লেখেন।

মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধর সেই স্ট্যাটাসে লেখেন, ৯ অক্টোবর ১৯৯৮ সালে জন্মগ্রহণ করি আমরা দুই যমজ ভাই। জন্মের পর থেকেই আমরা নাকি গোলগাল প্রকৃতির ছিলাম। একইরকম দেখতে হওয়ায় অনেক সুবিধাও নিয়েছি—একজন আরেকজনের হয়ে। যখনই মাটিতে কিছু পড়ে থাকতে দেখতাম, সাথে সাথে দুজন দৌড় দিতাম—কে আগে সেটা বারান্দা দিয়ে বাইরে ফেলে দেবে! বারান্দা বন্ধ থাকলে বাথরুমে কমোডে ফেলে দিতাম আর খিলখিল করে হাসতাম। স্বর্ণের চেইন থেকে শুরু করে পায়ের জুতো—কোনো কিছুই আমাদের জন্য মাটিতে রাখা যেত না।’

জীবনে এরকম কত যে পরীক্ষা একে অপরের হয়ে দিয়েছি! কোনো শিক্ষক আজ পর্যন্ত ধরতেই পারেনি। এভাবেই আমাদের বড় হয়ে ওঠা—একসাথে। বুঝ হওয়ার পর থেকেই দু’জনের মধ্যে সবসময় প্রতিযোগিতা লেগেই থাকত। যদিও পড়ালেখায় ওর থেকে কখনো এগিয়ে থাকতে পারিনি, তবে ফ্রিল্যান্সিং থেকে শুরু করে অন্য সবকিছুতে আমাদের টক্কর হতো সমানে সমানে।

আর একটা জিনিস ছিল—ওর সাহস। সেই সাহসের উদাহরণ দিতে গেলে গল্প শেষ হবে না। ছোট থেকে বড় হওয়ার এই যাত্রায় আমরা প্রায় সারা বাংলাদেশ একসাথে ঘুরে বেরিয়েছি—কি করি নাই একসাথে!

তিনি লেখেন, ১৭ জুলাই ২০২৪—মুগ্ধর মৃত্যুর একদিন আগেও আমরা প্রায় রাত ১টা পর্যন্ত একসাথে কাজ করে ঘুমাতে গিয়েছিলাম। সেই রাতেও প্রতিদিনের মতো মশারি টানানো নিয়ে আমাদের ঝগড়া হয়—এটা ছিলো নিত্যদিনের ঘটনা। আমি ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই মুগ্ধ নিজেই ডেকে আমাকে উঠিয়ে দিল। এমন আগে কখনো হয়নি—ও ঘুমের মধ্যে থেকে আমাকে ডেকেছে! আমাকে ঘুম থেকে তুলে নানা বিষয় নিয়ে কথা বলছিলো—বিশেষ করে আম্মুকে নিয়ে। বলছিলো, ‘আম্মু সারাজীবন আমাদের জন্য কষ্ট করেছে, কিভাবে আম্মুকে নিজের টাকায় একটা ফ্ল্যাটে উঠাবে…’ ওর খুব শখ ছিলো—নিজের টাকায় একদিন আম্মুকে নতুন ফ্ল্যাটে তুলবে।

একপর্যায়ে কথা বলতে বলতে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের ভিডিও বের করে দেখাচ্ছিলো—বলছিলো, ‘এখন খুলনায় থাকা উচিত ছিলো, জুনিয়রদের হেল্প করতে পারতাম।’ কথা বলতে বলতে প্রায় ৩টা বেজে গেলো, তবু ওর কথা শেষ হয় না। আমার তখন একদিন আগের এক্সিডেন্টে হাতের নখ উঠে গিয়েছিলো, ৫টা সেলাই—ভীষণ ব্যথা করছিলো। তাই একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘কী শুরু করলি? ঘুমাতে দে।’

এটাই ছিলো মুগ্ধর সাথে কাটানো আমার শেষ রাত।

স্নিগ্ধ লেখেন, সবচেয়ে বেশি ঝগড়া হতো জামাকাপড় নিয়ে। পরের দিন আন্দোলনে যাওয়ার সময় ও আমারই একটা জামা পরে বের হয়, আর যখন জানতে পারি ওর গায়ে গুলি লেগেছে—তখন আমিও ওর একটা শার্ট গায়ে দিয়ে বের হই। যখন মুগ্ধকে হাসপাতালে প্রথম দেখি—মনে হচ্ছিলো কি আরাম করে ঘুমাচ্ছে, এক শান্তির ঘুম! বোঝার কোনো উপায় ছিলো না যে ও আর নেই। মায়ের পেট থেকে যে একসাথে বেরিয়েছি—সে কিভাবে এভাবে একা চলে যায়?

মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধর ফেসবুকের স্টাটাস

সারা রাত ওর লাশের গাড়ির পাশে বসে ছিলাম—ঠিক প্রতিরাতের মতোই। পার্থক্য একটাই—গত রাতে ওর ভেতরে প্রাণ ছিলো, আজ আর নেই।

যতবারই সেদিন ওকে দেখেছি—মনে হচ্ছিলো ওর শরীর থেকে আলো বের হচ্ছে। জীবনে ওকে এতটা সুন্দর আর কখনো লাগেনি। এক পর্যায়ে মনে পড়লো—আম্মু-আব্বু তো তখনো জানে না মুগ্ধ আর নেই! তারা তখনো চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসছিলো। ভাবছিলাম, মা যখন মুগ্ধকে এই অবস্থায় দেখবে, তখন কী হবে?

অবশেষে সকালে তারা এলো। মুগ্ধর পাশে গিয়েই জানলো—মুগ্ধ আর নেই। সেইদিন শক্ত শাবল ভাইকে দেখলাম কিভাবে নিরীহ শিশুর মতো লাশের গাড়ি ধরে বিনা শব্দে কাঁদছিলো। কাঁদবেই বা না কেন? চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত পুরো রাস্তায় আব্বু-আম্মু কিছু বুঝতে না পারে, সেই অভিনয় করতে গিয়ে ওর চোখের পানি শুকিয়ে গিয়েছিলো—সেইদিনই একবারে বের হলো সব।

তিনি আরও লেখেন, আম্মু বলতো—‘‘তোমাদের দু’জনকে একসাথে মানুষ করতে করতে আমার জীবনটা পানি হয়ে গেছে।’’ যাদের জমজ সন্তান আছে তারা জানে—দু’জনকে একসাথে বড় করা কতটা কঠিন। সেই আম্মুকে দেখলাম—কিভাবে নির্বাক হয়ে মুগ্ধর কপালে শেষ চুমু খেলো। চুমুর দৃশ্যটা দেখে মনে হচ্ছিলো—এক মা কপালে চুমু দেয়, আর আরেক মা, যাকে আমরা ‘‘দেশ’’ বলি—সে কপালে গুলি চালায়। আজ এতটুকুই থাক।

তারপর কীভাবে মুগ্ধকে কবর দেওয়া হলো? কীভাবে ৫ই আগস্ট পর্যন্ত আমাদের ব্ল্যাঙ্ক চেক আর হুমকি-ধামকির মাধ্যমে কিনে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে—সেসব গল্প আরেকদিন বলবো।

যারা বাঁচে, তাদের দায় বেশি। কথা আছে—‘সত্য মরে না।’ মুগ্ধর গল্পও শেষ হবে না—কারণ ওর স্বপ্নগুলো এখন আমাদের শ্বাসে বাঁচে।

 

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.