মুক্ত সংবাদমাধ্যম এক কষ্টিপাথর

মোজাম্মেল হোসেন

0
132

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্তসূত্রে ৩ মে ‘বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস’ এবার পালন করা হচ্ছে ৩০তম বর্ষে। এমন জুবিলি বা জয়ন্তীবর্ষে উদ্‌যাপন স্বভাবত ভিন্নমাত্রা পায় বা আবেগসিক্ত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ৫২তম বর্ষে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করা সংস্থা ইউনেস্কো প্রবর্তিত দিবসটি বিশ্বের সঙ্গে উদযাপনের সময় আমরা খুব হৃষ্টচিত্তে বলতে পারি না যে, আমাদের গণমাধ্যম, বিশেষত সংবাদমাধ্যম যথার্থ মুক্ত পরিবেশে, স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে।

পাকিস্তানের আধা-ঔপনিবেশিক শাসনের অধীন থাকার সময় আমাদের পূর্বসূরি সাংবাদিকদের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য অনেক লড়াই সংগ্রাম করতে হয়েছে। সাংবাদিকদের অনেককে জেল-জুলুম সহ্য করতে হয়েছে। তখন বাধা ও দমন-পীড়নটা আসত শাসকগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে। সংবাদপত্র দলনের জন্য প্রেস ও পাবলিকেশন অর্ডিন্যান্স, জননিরাপত্তা ও দেশরক্ষার নামে একাধিক অধ্যাদেশ ও আইন তৈরি হয়েছিল, যার দ্বারা বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের বিনাবিচারে জেলবন্দি রাখা যেত; সম্পাদকদের আটক ও সংবাদপত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যেত।

পাকিস্তানে জনগণের অধিকার, গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের লড়াইয়ে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা ছিল আগুয়ান। পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্র-জনতা বিভিন্ন সময়ে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নিয়েছে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হয়ে বাঙালিরা নিজস্ব স্বাধীন রাষ্ট্র গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ গঠন করার পরে মৌলিক অধিকার, গণতন্ত্র ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে নতুন করে লড়তে হতে পারে– এমন ভাবনা তখন ছিল না। কারণ মাতৃভাষার অধিকার, ব্যক্তির মৌলিক অধিকার, গণতন্ত্র ও নিজস্ব সংস্কৃতিচর্চার অধিকারের জন্য অবিভক্ত পাকিস্তানের ২৫ বছর লড়তে লড়তেই আমরা মুক্তিযুদ্ধের সাগরমোহনায় এসে দাঁড়াই। তাই স্বাধীনতার সঙ্গে সেগুলো অর্জন করেছি বলেই ভাবা স্বাভাবিক ছিল।

পাকিস্তানে গণআন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে দু’একটি দালাল সংবাদপত্র ছাড়া মূলধারার সব সংবাদপত্রের অকুণ্ঠ সমর্থনসূচক বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বকারী রাজনৈতিক শক্তি স্বাধীন দেশে প্রথমদিকে ক্ষমতাসীন থাকাকালে রাষ্ট্র ও সরকারের তরফ থেকে সংবাদমাধ্যমের ওপর কোনো চাপ ও বাধা আসেনি। স্বাধীনতাবিরোধী ও সমাজবিরোধী শক্তিগুলোকে নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৭৪-এর বিশেষ ক্ষমতা আইনটি চরিত্রে নিবর্তনমূলক হলেও তা তখন সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করেনি। তাই রাষ্ট্র ও সরকারের দিক থেকে নয়; ১৯৭০-৮০’র দশকে সংবাদপত্রের ওপর আঘাত এসেছে রাষ্ট্রবহির্ভূত সন্ত্রাসী, জঙ্গিবাদী ও কায়েমি স্বার্থের তরফ থেকে। সেটা মূলত সাংবাদিকদের জীবনের ওপর। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে মানিক সাহা, হুমায়ুন কবির বালু প্রমুখ অন্যূন সাতজন সাংবাদিক নিহত হয়েছিলেন।

কিন্তু স্বাধীন দেশে সংবাদমাধ্যমের ওপর ক্ষমতাসীন সরকারের চাপ ফিরে আসতে সময় নিল না। সামরিক শাসক এরশাদ বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রয়োগ করেছিলেন সংবাদপত্র দমন করতে। আর আমাদের কী ভাগ্য; টানা নির্বাচিত সরকারের গণতান্ত্রিক শাসনামলেই আমরা দেখছি সংবাদমাধ্যমের ওপর নতুন নিবর্তনমূলক কালাকানুনের চাপ। প্রথমে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের কুখ্যাত ৫৭ ধারা। তার পর সেটা সরিয়ে মহা বিতর্ক সৃষ্টিকারী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। অর্থাৎ দেশের সংবাদমাধ্যম এখন দুই তরফে চাপ মোকাবিলা করছে। সরকারি আইনের নিবর্তন ও ভীতি এবং সরকারবহির্ভূত সন্ত্রাসীদের দৈহিক আক্রমণ সাংবাদিকদের ওপর। ২০১২ সালে সাগর ও রুনি নামে সাংবাদিক দম্পতির হত্যাকারী কারা– আজও বিন্দুমাত্র উদ্ঘাটিত হলো না। তদন্তই প্রহসন হয়ে থাকছে। এই ঘটনাটির মামলা ‘আনসল্‌ভ্‌ড মিস্ট্রি’ হয়ে থাকা কি আমাদের নিয়তি হওয়ার কথা? দক্ষিণাঞ্চলের মতো অল্প সময়ে একাধিক হত্যাকাণ্ড না ঘটলেও এখন কিছুদিন পরপরই মফস্বলের এই জেলা বা সেই জেলা বা ওই উপজেলায় স্থানীয় সাংবাদিকদের সংবাদ প্রকাশের কারণে তাঁদের ওপর প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ বা রাজনৈতিক ক্যাডার বা অজ্ঞাতপরিচয় হামলাকারীর মারধর, আক্রমণ, এমনকি হত্যার খবর সংবাদমাধ্যমে আসছে। এঁরা প্রান্তিক এলাকার সাংবাদিক বলে দেশব্যাপী প্রতিক্রিয়া হয় না। কিন্তু সংবাদ হয় এবং দেশি-বিদেশি নজরদারি সংগঠনের নথিতে লিপিবদ্ধ হয় ও আন্তর্জাতিক রিপোর্টও প্রকাশ পায়। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিকে নামতে থাকে। দেশ ও সরকারের ভাবমূর্তি নিয়ে যাঁরা খুব বেশি চিন্তিত, তাঁরা এ বিষয়ে কী ভাবেন?

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি সম্প্রতি এতই আলোচিত যে, নতুন যা বলা যাবে তা-ই বাহুল্য। মাননীয় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক যে প্রায় পাঁচ বছর ধরে ক্রমাগত আইনটি সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছেন; জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের সবক নেওয়ার কথাও শোনাচ্ছেন কিন্তু সংস্কার করছেন না। অন্য কয়েকজন মন্ত্রীর কথার আভাসেও বোঝা যায়, সরকারও আইনটি নিয়ে কিঞ্চিৎ বিব্রত বুঝি বা।

ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারে মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়া ও সাইবার পরিসরকে দুর্বৃত্তমুক্ত রাখার জন্য আইনটির প্রয়োজন অবশ্যই আছে। তবে তা যদি মুখ্য হয় তাহলে ওই মাধ্যমে রাজনৈতিক বক্তব্য বা সরকারের সমালোচনার জন্য মামলা বেশি কেন? সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা বেশি কেন? মামলার বাদী একটি রাজনৈতিক দলের কর্মী বেশি কেন? যত্রতত্র ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দেওয়ার হুমকি উচ্চারিত হয় কেন? ডিজিটাল পরিসরে নারীদের হয়রানির অপরাধের জন্য ক’টি মামলা হচ্ছে?  ক’জন অপরাধীর তাতে শাস্তি হলো? এই প্রশ্নগুলোর জবাব বলে দেবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যুক্তি ও কার্যকারিতা আদৌ কী আছে।

সংবাদমাধ্যমের একটি শীর্ষ সংগঠন সম্পাদক পরিষদ বলেছে, প্রায় পাঁচ বছর আগে সরকারকে বলা হয়েছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কয়েকটি ধারা সংশোধন করে একে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হন্তারকের ভূমিকা থেকে বিরত রাখা যায়। এ বিষয়ে সরকারি প্রতিশ্রুতিও রক্ষিত হয়নি। এখন পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, আইনটি সংশোধনেরও অযোগ্য হয়ে পড়েছে। কারণ বাস্তবে এর প্রয়োগই অপপ্রয়োগ। তাই আইনটি বাতিলযোগ্য। এর পরও সম্পাদক পরিষদ সরকারকে এই সুযোগ দিয়েছে– একটি ধারা যুক্ত করে আপাতত আইনটি রাখা যায়; সেটি হলো সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আইনটি প্রযোজ্য নয়। এখন বল সরকারের কোর্টে।
এ বছরের বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের প্রতিপাদ্য ইউনেস্কো ঠিক করেছে– ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সকল প্রকার মানবাধিকারের চালিকাশক্তি’।

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য এই সত্যের কাব্যিক প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন যে, মাতৃগর্ভ থেকে মানবশিশু ভূমিষ্ঠ হয়েই সুতীব্র চিৎকারে তার অস্তিত্ব ঘোষণা করে। আমরা জানি, তারপর প্রতিটি প্রয়োজনে, প্রতিটি বাধা অপসারণের জন্য সে চিৎকার করে। তাহলে এটাই প্রাকৃতিক যে, নিজেকে প্রকাশ করতে পারাই হচ্ছে সকল মানবাধিকারের আকর। ব্যক্তিস্বাধীনতা, নাগরিক স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার কোন রাষ্ট্রে, কোন সমাজে কতটুকু আছে তা যাচাইয়ের কষ্টিপাথর হচ্ছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা।

মোজাম্মেল হোসেন: সম্পাদক, সমকাল

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.