গেল ঈদ আমার জন্য একেবারেই অন্য রকম ছিল। ফাঁকা। ঈদের দিন বিকেলে ফোন করলেন কবি সরকার আমিন, কেমন আছেন?
: এই তো। খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।
: আমি বুঝতে পারি। মা মারা গেলে এমন অনুভূতি হয়। কেন জানেন তো…আমরা তো মায়ের শরীরের সঙ্গে যুক্ত থাকি। নাড়ি কেটে বিযুক্ত করা হয়। তাই মা না থাকলে যে অনুভূতি হয়, সেটা আর কোনো ক্ষেত্রেই হয় না। আমার মা মারা গেছেন তো তাই আপনার অবস্থাটা বুঝতে পারছি।
আমার মা সুফিয়া চৌধুরী মারা গেছেন গত ৪ এপ্রিল। সেদিন ছিল ১২ রমজান। এরপর আমার জীবনের অনেক ‘প্রথম’ ঘটনা ঘটছে। মা ছাড়া প্রথম পয়লা বৈশাখ, প্রথম ঈদ। ৩০ এপ্রিল মেয়ে স্বাগতার জন্মদিনে এই প্রথম বিকাশে কোনো উপহার না আসা। সরিষাবাড়ীতে গিয়ে প্রথমবারের মতো মাকে না পাওয়া। মাকে ছাড়া আজ প্রথম ‘মা দিবস’।
এই যে লিখছি, এটাও তো মাকে নিয়ে আমার প্রথম লেখা। আজ ১৪ মে, মা দিবস। এদিকে আজ আমার মায়ের মৃত্যুর ৪০ দিন পূর্ণ হচ্ছে। অনেকের মত, প্রতিদিনই তো মা দিবস। ঘটা করে একটা দিন পালন করার কী দরকার। কিন্তু একটা দিন ধরে মায়ের জন্য যদি একটু বাড়তি কিছু করা যায়, তবে তো কোনো ক্ষতি নেই। মা দিবসে ফোন করে শুভেচ্ছা জানালে আম্মা বলত, ‘মা দিবসে তোমার জন্যই দোয়া করি। তুমি ভালো থেকো।’ একবার মা দিবসে সরিষাবাড়ীতে শাড়ি পাঠালাম। আম্মা খুশি হয়ে ফোন করলেন। ওপাশ থেকে আব্বা ফোনটা নিয়ে বললেন, ‘মা দিবসে শাড়ি পাঠালি, বাবা দিবস আছে না!’ এই দিবসগুলোতে আমরা আমাদের মতো উদ্যাপন করতাম। যখন সরিষাবাড়ী ছিলাম, তখন ১ জানুয়ারি, ১ বৈশাখ, আব্বা-আম্মার বিয়ের দিন—ভালো কিছু রান্না হতো। মানে খাসির মাংস খাওয়া হতো।
আমার বাবা মারা যান ২০১৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর। আর এ বছর মা। ঈদের দিন সকালে এবার বাড়ি যাই। তার আগের দিন হঠাৎ কেমন যেন একটা অনুভূতি হলো। মনে হচ্ছিল, কোনো কিছুই আর নেই। ‘বাবা কখন আসবে, কী রান্না করব? ভালো হাঁস তো পাচ্ছি না!’—এমন ফোন এবার আর পাইনি। এটাও শুনলাম না—‘বাবা, আমার জন্য যেন আবার শাড়ি কিনো না, অনেক শাড়ি আছে। পরাই হয় না। আমি তো আর বাইরে যাই না।’
আমার মা-বাবা সরিষাবাড়ীতেই থাকতেন। বাবা মারা যাওয়ার পর মা একাই থাকতেন। দোতলার ভাড়াটেরা আর আশপাশের সবাই ছিলেন তাঁর নিত্যদিনের সঙ্গী। যখন আম্মা আমাদের উঠানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন, তৎক্ষণাৎ ভাড়াটে, প্রতিবেশীরা ছুটে এসে নিয়ে গিয়েছিলেন হাসপাতালে। আমাকেও জানিয়েছিলেন। কিন্তু আম্মার জ্ঞান আর ফিরল না। হ্যাঁ, আম্মা বাইরে যেতেন না বললেই চলে। ‘এই বাড়ি ফেলে কীভাবে যাই’—বলে আর বের হতেন না। তবে কোথায় কী হচ্ছে খোঁজখবর ঠিক রাখতেন। করোনাকালে প্রতিদিনের বুলেটিনের পরই আম্মার ফোন আসত—‘এত মানুষ মারা যাচ্ছে কেন? তুমি সাবধানে থেকো। বাইরে বের হও না তো?’ তখন হয়তো আমি বাইরেই। বলতাম, ‘না, তেমন একটা বের হই না।’ আম্মা আশ্বস্ত হতেন। আবার গত ২ এপ্রিল আম্মার সঙ্গে শেষ কথা। সেদিন বিকেলে সম্পাদক মতিউর রহমান উচ্চ আদালতে আগাম জামিন পেয়েছেন। সন্ধ্যায় আম্মা ফোন করে বললেন, ‘তোমাদের মতিউর রহমানকে নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছে। তুমিও সাবধানে থেকো।’ আর দু–চারটি কথার পর বলেছিলাম, ‘ঠিক আছে। রাখো তো!’
আম্মা সুন্দর করে শাড়ি পরতেন। কখনো কখনো সঙ্গে স্লিভলেস ব্লাউজ। একবার আম্মা এক রূপকথার লাইন ধরে আব্বাকে বলেছিলেন, আকাশের মতো নীল, জলের মতো স্বচ্ছ আর বাতাসের মতো ফুরফুরে একটা শাড়ি আমাকে এনে দিয়ো তো।
মায়ের সঙ্গে তো আমরা এভাবেই কথা বলি! যে কোনোভাবেই যেন মায়ের কথা বলা যায়। নো ফর্মালিটিজ, ভালোবাসা-শ্রদ্ধার সরাসরি প্রকাশও না। তবে যখন মা-বাবা থাকেন না, তখন এভাবে কথা বলার জায়গাটাও হারিয়ে যায়। আমার ছেলেমেয়েরা আমাকে বলে, ‘আমরা আছি না!’ হ্যাঁ, তোমরা আছ। কিন্তু কী করে বোঝাই, স্নেহ নিম্নগামী। সেই নিম্নগামী ঝরনাধারায় আমি যে আর অবগাহন করতে পারব না।
কিছুটা বিস্ময়কর হলেও সত্য, ছোটবেলা থেকে আমার সব আদর-আহ্লাদ-আবদার ছিল আব্বার কাছে। পড়াশোনা, দুষ্টুমি বা জিদ ধরার জন্য আব্বার হাতে প্রচুর মার খেয়েছি। কিন্তু তাঁর কাছেই সব আবদার। ওদিকে আমার জীবনে মাত্র একবার আম্মা একটা থাপ্পড় মেরেছিলেন। আর কখনো না। তারপরও আম্মাকে একটু ভয়ই পেতাম। সরিষাবাড়ীর শিমলা বাজারে যে ভাড়া বাসায় আমরা থাকতাম, সেটির কাছেই ছিল চম্পাকলি হল। ১০-১৫ দিন পরপর নতুন সিনেমা আসত। নতুন ছবি (আমরা তখন বই বলতাম) এলেই আমার দেখতে হবে। বিলাসে (প্রথম শ্রেণি) টিকিটের দাম ৩ টাকা ২৫ পয়সা। আব্বাকে বলতাম, ঘ্যান ঘ্যান করতাম। আম্মাকে বলার সাহস পেতাম না। একবার আব্বার কাছে টাকা ছিল না, আম্মা তাঁর ড্রয়ার থেকে বের করে দিলেন। কিন্তু সিনেমা দেখার ‘কুফল’ নিয়ে কিছু বললেন না।
আম্মার একটা সহজাত ব্যক্তিত্ব ছিল। আম্মার প্রয়াণের খবর শুনে ফেসবুকে অগ্রজ বন্ধু শওকত আলীর মন্তব্য, ‘…সরিষাবাড়ী তার প্রাচীনতম স্মার্ট লেডিকে হারালো।’ শওকত আলী যেমন লিখেছেন, তেমনই আম্মাকে আমি দেখেছি ছোটবেলায়। সত্তর-আশির দশকে সরিষাবাড়ীর মতো একটা থানা শহরে কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরাটাও ছিল নতুন কিছু, অচেনা। আম্মা সুন্দর করে শাড়ি পরতেন। কখনো কখনো সঙ্গে স্লিভলেস ব্লাউজ। একবার আম্মা এক রূপকথার লাইন ধরে আব্বাকে বলেছিলেন, আকাশের মতো নীল, জলের মতো স্বচ্ছ আর বাতাসের মতো ফুরফুরে একটা শাড়ি আমাকে এনে দিয়ো তো। ময়মনসিংহ গিয়ে সে রকম একটি শিফন শাড়ি এনে আম্মাকে দিয়েছিলেন আব্বা। আম্মার মধ্যে একটা পরিপাটি ব্যাপার ছিল। তা সে পোশাকে হোক কিংবা জীবনযাপনে। আমরা যে ভাড়া বাসায় থাকতাম, সেটি ছিল টিনের চৌচালা। মাটির মেঝে। সেই মেঝে নিজেই লেপে-মুছে এমন করে রাখতেন, মনে হতো পাকা বাড়ি। আবার আমরা যখন নিজেরা বাড়ি বানালাম, আম্মা বললেন, মেঝে অবশ্যই মোজাইক দিয়ে করতে হবে। তা–ই করা হয়েছে।
আম্মার নামের সঙ্গে ‘চৌধুরী’ আছে। তাই তাঁর বংশ–গরিমা ছিল, সেটা প্রকাশও করতেন। কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার বালাবাড়ির চৌধুরী পরিবারের মেয়ে। তাঁর দাদার হাতি ছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁদের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়, ফলে হারিয়ে যায় সব। আমার নানি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মেয়ে। বড় বাটিতে করে চা খেতেন। স্কুলজীবনেই বাবাকে (আমার নানা) হারান আমার মা। এরপর ১৯৬৯ সালে আব্বার সঙ্গে বিয়ে। আব্বা মুহ. আবদুল মান্নান সবে যোগ দিয়েছেন সরিষাবাড়ী কলেজে। সেই আম্মা এলেন সরিষাবাড়ী। আমার জন্ম হলো। আমরা সরিষাবাড়ীর হয়ে গেলাম।
আম্মা খালি গলায় ভাওয়াইয়া গাইতে পারতেন দারুণ। রবীন্দ্র-নজরুলের গানের লাইন, কবিতার লাইন ছিল মুখস্থ। মাঝে মাঝেই উদ্ধৃত করতেন। আব্বা যেহেতু বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক ছিলেন, তাই আমাদের বাসায় সাংস্কৃতিক একটা আবহ বিরাজ করত সব সময়। গানের আসর বসত। একবার তো নাটিকাও হলো বাড়ির উঠানে।
মারধর করতেন না, তবুও ওই যে ছোটবেলায় আম্মাকে কিছুটা ভয় পেতাম, তার কারণ মনে হয় আম্মার ব্যক্তিত্ব। নিজের জন্য কখনো কারও কাছে কিছু চাইতেন না। এমনকি আব্বার মৃত্যুর পর আমার কাছেও কখনো কোনো টাকা চাইতেন না। যা পাঠাতাম, সেটা থেকেই বাঁচিয়ে আমরা যখন বাড়ি যেতাম, ফেরার সময় আমাদের চারজনকে কিছু কিছু দিতেন। বাড়ির কোনো কাজ করতে হলে তখন হয়তো বলতেন। সাশ্রয়ের শেষ উদাহরণ পেলাম আম্মা চলে যাওয়ার পর। আম্মার দৃশ্যত তেমন কোনো আয় ছিল না। আম, কাঁঠাল আমাদের জন্য রেখে একে-ওকে দিয়ে কিছু বিক্রি করাতেন। সুপারিও বিক্রি করতেন। আর আমার পাঠানো টাকা থেকে জমাতেন। আম্মা চলে যাওয়ার পর এখানে-ওখানে খুচরা কিছু টাকা পেলাম। তবে আলমারি খুলে দুটি পার্সে পেলাম বেশ কয়েক হাজার টাকা। যা সত্যিই বিস্ময়কর।
১৯৭৬ সাল। আমাকে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করা হবে। তখন সরিষাবাড়ী গার্লস পাইলট স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ছেলে ও মেয়েরা পড়তে পারত। আমাকে সেখানে ভর্তি করা হলো। প্রথম দিনের ক্লাস। আমি ক্লাসরুমের শেষ দিকের বেঞ্চের কোনায় বসেছি। রোল কল করছেন একজন শিক্ষিকা। আমার মোহাইমেন নামটা সেই সময় খুব একটা প্রচলিত নাম ছিল না। তাই শিক্ষিকা আমার নামটা মনে হয় ঠিকমতো বুঝতে পারেননি। তিনি ডাকলেন, ‘এই মোমেন শা কেডারে?’ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আম্মা সেটা শুনলেন। ঝড়ের বেগে ক্লাসরুমে ঢুকে বললেন, ‘যে স্কুলে আমার ছেলের নাম ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারে না, সেখানে আমার ছেলেকে পড়াব না।’ বলেই আমাকে হিড়হিড় করে টেনে বের করে নিয়ে এলেন। দুপুরের পর আব্বা কলেজ থেকে ফেরার পর তাঁকে বললেন, ‘পল্লবের বাবা, এখানে তো ভালো কোনো স্কুল নেই। আমার ছেলের নামই বলতে পারে না। একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুল করো।’
এই হলো আম্মা। আমার মনে আছে, সেদিন রাতেই আব্বা, আম্মা আর আমি বের হলাম শিমলা বাজারের বিশিষ্টজনদের সঙ্গে দেখা করতে। জুট মিলের ম্যানেজার, ব্যাংকের ম্যানেজার, কলেজের শিক্ষক, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ধীরে ধীরে কিন্ডারগার্টেন করার বিষয়ে আলাপ করতে থাকলেন আব্বা। সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল মালেকের বাসাও শিমলা বাজারে। তাঁর সহায়তায় ছয় মাস পর ১৯৭৬ সালের জুনে চালু হলো সরিষাবাড়ী কেজি স্কুল। সরিষাবাড়ী আরডিএম পাইলট হাইস্কুলেই শুরু হলো ক্লাস। সকাল ৭টা বা ৮টা থেকে শুরু হয়ে বেলা ১১টা পর্যন্ত চলত স্কুল। আব্বা নিজে স্কুলের প্রধান শিক্ষক। আর পড়াতেন সরিষাবাড়ী কলেজ ও আরডিএম পাইলট হাইস্কুলের কয়েকজন শিক্ষক। সেই সময়ে জামালপুর মহকুমা তো বটেই, ময়মনসিংহ জেলার মধ্যেও সম্ভবত এটি ছিল প্রথম কিন্ডারগার্টেন। স্কুল চালুর আগে আব্বা, আম্মা ও আমি ঢাকায় এসেছিলাম। আব্বা নিউমার্কেট থেকে ‘আনন্দপাঠ’, ‘রেডিয়েন্ট ওয়ে’—কিন্ডারগার্টেনের এমন পাঠ্যবই কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৮০ সালে স্কুলটি নতুন জায়গায় যায়। পরে এর নাম হয় ‘সরিষাবাড়ী নাছের উদ্দিন কিন্ডারগার্টেন স্কুল’। মাঝে মাঝে ভাবি, সেই দিন আম্মা যদি আমাকে টেনে নিয়ে না আসতেন, তবে হয়তো এমন স্কুল প্রতিষ্ঠায় আরও বিলম্ব হতো।
প্রায় প্রতিবছরই ৩১ অক্টোবর আম্মা ফোন করে, খুব সুন্দর করে আবেগ দিয়ে ফোনে আমাকে বলতেন, ‘বাবা, তোমার জন্মদিনে অনেক অনেক শুভেচ্ছা আর দোয়া।’ আমিও গলার স্বর ঠান্ডা করে বলতাম, ‘আজ তো না, গতকাল ছিল আমার জন্মদিন।’ আম্মা বলতেন, ‘আজই তো। আসলে বয়স হয়ে গেছে, মনে থাকে না।’ পরের বারও এমন হতো, তার পরের বারও। তবে এক দিন পরে হলেও আম্মার শুভেচ্ছা পেতাম।
২০২০ সালের ২৭ ডিসেম্বর আব্বার দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী পালন করতে আমরা গেছি সরিষাবাড়ী। সঙ্গে ছেলে মননের তিন বন্ধু। মননের সঙ্গে আম্মার যোগাযোগ যেমন বেশি হতো, তেমনি ওর বন্ধুদের সঙ্গেও আম্মার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। তাদের একজন অভয়ের জন্মদিন ২৬ ডিসেম্বর। আমার স্ত্রী বলল, ‘রাতে অভয়ের জন্মদিন পালন করে ওকে সারপ্রাইজ দিই!’ আমি বললাম, ‘কাল আব্বার মৃত্যুবার্ষিকী, আম্মা আবার কিছু মনে করে কি না! বলে দেখো।’ একটু পরে স্ত্রীর ফোন, ‘মা পোলাওয়ের চাল আনতে বলেছেন। রাতে পোলাও রাঁধবেন।’ আম্মাসহ আমরা বেশ ভালোভাবেই অভয়ের জন্মদিন উদ্যাপন করলাম। আম্মার ধরনটাই ছিল এমন—ওপরে শক্ত, ভেতরে কোমল।
১৯৯২ সালে নতুন বাড়িতে যাওয়ার পর কোনো দিনই এক টাকার লাকড়ি কেনেননি। আগে বলতেন, তোমার বাবার কত টাকা সেভ করে দিচ্ছি। প্রচুর গাছ আমাদের বাড়িতে। সেসবের ডাল, লতাপাতাই ছিল আম্মাার জ্বালানি। সিলিন্ডার গ্যাসের চুলা দেওয়ার পরও ব্যবহার করতেন না। ‘এই সব গ্যাস-ফ্যাস আমার পোষায় না।’ আর তাঁর ছিল গাছের হাত। যেকোনো চারা লাগালেই তরতর করে বড় হতো। সে মরিচ হোক কি দোলনচাঁপা, সুপারি বা ক্যাকটাস। আমার বন্ধুর বোন মিতা রায় ফেসবুকে লিখেছে, ‘আপনাদের বাসাতেই প্রথম মানিপ্ল্যান্ট দেখেছিলাম। আন্টির কাছ থেকে একটু এনে বোতলে পানি দিয়ে লাগিয়েছিলাম।’ গাছের সঙ্গে আম্মার সম্পর্ক ছিল আত্মিক। তাই হয়তো আম্মার কবরের কোনায় লাগানো কাঠগোলাপ মাত্র ২০-২২ দিনের মাথায় ফুল দিতে শুরু করেছে। আর সেই ফুলের কী স্নিগ্ধ রূপ!
আম্মার সঙ্গে শেষ দেখা মার্চের ৭ থেকে ১০ তারিখ। বাড়ি গিয়েছিলাম আমি, সার্থক আর ওর বন্ধু স্বচ্ছ। এখানে বলে রাখি, আমাদের ছেলের ডাক নাম সার্থক আম্মার দেওয়া। এদিকে মেয়ে স্বাগতা বলে দিয়েছে, দাদিকে হাঁস রান্না করে দিতে বলবা। স্ত্রী লিমা বলেছে, মায়ের হাতের আঠা আঠা করে শোল মাছ রান্নাটা খুব ভালো হয়। দিতে বলো। এদিকে আম্মার শরীরে ব্যথা-বেদনা। বসলে–উঠতে অসুবিধা হয়। তারপরও আম্মা করবেন আর বলবেন, বয়স হয়ে গেছে, আগের মতো পারি না। আসার আগের দিন আম্মা হাঁস রান্না শুরু করলেন। ছুটা বুয়া সময়মতো আসেনি, একটু এসে হাঁস আধাআধি বেছে দিয়ে গেছে। আম্মার যা পছন্দ হয়নি। স্বচ্ছকে নিয়ে বসলেন হাঁস সামাল দিতে। সেই আমার মায়ের হাতে শেষ হাঁস খাওয়া। মাঝে মাঝে লবণ, ঝাল কমবেশি হলে আমি যখন বলতাম, ‘কী রান্না করছ এইটা?’ আম্মা বলতেন, আমি আছি তা–ও খাবার পাচ্ছ। না থাকলে সরিষাবাড়ী এসে খাবার খুঁজতে বের হতে হবে। এত তাড়াতাড়ি এমন হবে তা কী আর ভেবেছিলাম। এখন সত্যিই সরিষাবাড়ী গেলে খাবারের সন্ধান করতে হয়!
এখন বুঝতে পারছি, মে মাসের দ্বিতীয় রোববার শুধু নয়, আমার জন্য প্রতিদিনই যেন মা দিবস। মা নেই—এই উপলব্ধি প্রতিদিনই নিয়ে যাবে মায়ের কাছে। মা দিবসে আলাদা করে মনে পড়বে, কিন্তু তাঁর কণ্ঠের শুভকামনা শুনব না। আজ এ কথাও আমি নির্দ্বিধায় বলতে চাই, আমার মা ‘রত্নগর্ভা’ছিলেন না, আম্মা নিজেই রত্ন। প্রত্যেক মা-ই আসলে একেকজন রত্ন। যে রত্নের পরশে কোনো কোনো সন্তানও হয়তো কখনো রত্ন হয়ে ওঠে। আসল রত্ন, আসল পরশপাথর তো এক মা-ই।