যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে। সেখানের বলা হয়েছে, বাংলাদেশে নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে যাঁরা বাধাগ্রস্ত করবেন, তাঁরা ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধের মুখে পড়বেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই ভিসা নীতির প্রভাব কী পড়তে পারে, তা নিয়ে কথা বলেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. হারুন-অর-রশিদ।
হারুন-অর-রশিদ: যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির বাধ্যবাধকতার মধ্যে না পড়ে যদি আমাদের রাজনৈতিক নেতারা স্ব–উদ্যোগে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে যদি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হতে পারতেন, সেটা সম্মানজনক হতো। কিন্তু বাংলাদেশের সাংঘর্ষিক রাজনৈতিক পরিবেশে আলাপ-আলোচনার সেই পরিসর কিংবা সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনের নেতারা (সরকারি দল, বিরোধী দলনির্বিশেষে) এবং নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যঁারা যুক্ত, বলতে গেলে তাঁদের প্রত্যেকেরই কোনো না কোনোভাবে যুক্তরাষ্ট্রে একধরনের স্টেক আছে। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের প্রধান উন্নয়ন সহযোগীও। তাদের ভিসা নীতি আমলে নেওয়ার ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, বাংলাদেশের উন্নয়নের স্বার্থে এবং নির্বাচনে যাতে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করে, সেই স্বার্থে তারা ভিসা নীতি দিয়েছে। নতুন মার্কিন ভিসা নীতি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করার ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
হারুন-অর-রশিদ: আওয়ামী লীগের ওপর চাপটা কেন বেশি পড়বে? এবারের নির্বাচন যে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে করতে হবে, সেটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক আগেই ঘোষণা করেছেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি আসেনি, চরম প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে সরকারকে সেই নির্বাচনটি করতে হয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি এসেছে কিন্তু সাংগঠনিক যে প্রস্তুতি থাকা দরকার ছিল, সেটা তাদের ছিল না। সে কারণে বিএনপি আশানুরূপ ফল করতে পারেনি। সেই নির্বাচন নিয়েও বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়টি নিয়ে খুবই সচেতন। দেশ-বিদেশে তাঁকে এ নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। সে কারণে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান হলো, এবারের নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হতে হবে, তাতে যে ফলাফলই হোক না কেন, জনগণ যে ম্যান্ডেট দিক না কেন, সেটা তিনি মেনে নেবেন। প্রয়োজনে বিরোধী দলে চলে যাবেন, সেটাও তিনি বলেছেন। মার্কিন ভিসা নীতি না হলেও বাস্তব অবস্থা হলো, পরবর্তী নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু হয়, সেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী আগে থেকেই জেনেবুঝে নিয়েছেন।
হারুন-অর-রশিদ: যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির কারণে বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি এবং সেই দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার সম্ভাবনা আর থাকল না। কেননা, বিএনপির পক্ষে এখন এই ভিসা নীতি সামনে রেখে নির্বাচন বর্জন করা, প্রতিহত করা এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি পূরণ না হলে নির্বাচনে না যাওয়ার অবস্থানে অটল থাকার আর কোনো সুযোগ নেই। আমি মনে করি, বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার দাবির পরিসমাপ্তি ঘটেছে। অবশ্য বিএনপি যদি মার্কিন ভিসা নীতি উপেক্ষা করে পথ চলতে চায়, সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু সেটা অত্যন্ত কঠিন হবে বিএনপির জন্য। বাস্তব পরিস্থিতি হলো, বিএনপি তাদের আন্দোলনে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করতে পারেনি।
হারুন-অর-রশিদ: অনেকে মনে করেন, বিএনপি নির্বাচনে না এলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না। এ ক্ষেত্রে আমি ভিন্নমত পোষণ করি। বিএনপি না এলে সামগ্রিকভাবে ভোটের হার কম হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে। রাজনৈতিক অঙ্গনের যারা খেলোয়াড় (সরকারি-বেসরকারি) আছে, সবার ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য।
বিএনপি যদি রাজনৈতিক দল হিসেবে সিদ্ধান্ত নেয় যে এরপরও তারা নির্বাচনে যাবে না, সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র তো জোর করে তাদের নির্বাচনে আনতে পারবে না। কিন্তু এর বাইরে যেসব দল নির্বাচনে অংশ নেবে এবং জনগণ যদি তাদের ভোট দেয়, তাহলে ভোটের হার কম হওয়া সত্ত্বেও সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে, বৈধতাও পাবে। বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ না নিলে তারা আন্তর্জাতিক বন্ধুদের হারাবে। তাদের জন্য এবার নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত হবে আরও আত্মঘাতী।
হারুন-অর-রশিদ: গাজীপুর সিটির নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে, তখনো তো মার্কিন ভিসা নীতি সেভাবে প্রকাশ্যে আসেনি। এর অর্থ হলো সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে অঙ্গীকারবদ্ধ। গাজীপুরে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হেরে গেছেন, সেটা বলা ঠিক হবে না। নবনির্বাচিত মেয়র জায়েদা খাতুনের ছেলে জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, ব্যক্তির বিরুদ্ধে আমার প্রতিদ্বন্দ্বিতা, কিন্তু আমিও আওয়ামী লীগ পরিবারের সদস্য। বিএনপির অনেক ভোটার জায়েদা খাতুনকে ভোট দিয়েছেন। বিএনপি, আওয়ামী লীগের একটা অংশ জায়েদা খাতুনের পক্ষে যাওয়ার পরও ভোটের ব্যবধান কিন্তু খুব বেশি নয়।
কাউন্সিলর পদে বিএনপির যাঁরা দাঁড়িয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এরপরও তাঁদের ১১ জন কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। এর অর্থ হলো রাজনীতি যাঁরা করেন, তাঁরা নির্বাচন করতে চান। সাধারণ পরিস্থিতিতে নির্বাচন বর্জন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। নির্বাচনকে আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে দেখা প্রয়োজন।
হারুন-অর-রশিদ: ছোটখাটো সংঘর্ষ হলেও বিরাট কোনো সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখি না। বড় দুটি দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা আছে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে। তাদের সম্পর্ক সাংঘর্ষিক হওয়ার কারণে স্ব–উদ্যোগে তারা সমঝোতায় আসতে পারেনি। এখন একধরনের বাইরের চাপের কারণে সেই বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হলো।
ইতিহাসের তো পুনরাবৃত্তি ঘটে না। আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। এখন সরকার ও জাতির সামনে একটাই করণীয়, সেটা হলো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান কাঠামো গড়ে তোলা এবং বিদ্যমান গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা। এ জন্য সরকারি দল, বিরোধী দল সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। একা নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়।