দেশে দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোয় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত ও আন্তর্জাতিক লেনদেনে যুগ যুগ ধরে মার্কিন ডলারের আধিপত্য দেখা গেছে। কিন্তু মার্কিন মুদ্রাটির সেই জৌলুশ এখন খোয়া যাচ্ছে। রাজনৈতিক রেষারেষি, ডলারের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা কারণে আন্তর্জাতিক লেনদেনে অনেক দেশ এখন নিজেদের কিংবা বিকল্প মুদ্রা ব্যবহার করছে। আবার এসব মুদ্রা বৈদেশিক মুদ্রার মজুত হিসেবেও রাখা হচ্ছে।
এদিকে মজুত ও নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে বিশ্বজুড়ে এখন সোনার কদর বাড়ছে। বৈশ্বিক লেনদেন ও বৈদেশিক মজুত সংরক্ষণে বিকল্প মুদ্রাগুলোর ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় মার্কিন ডলার কোণঠাসা হয়ে পড়ছে, যেটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘ডিডলারাইজেশন’। এরই মধ্যে ব্রিকস জোট ডলারের বিকল্প হিসেবে নতুন একটি বৈশ্বিক মুদ্রা চালুর কথা ভাবছে। আর সম্ভাব্য সেই মুদ্রার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে আরও ২৪টি দেশ।
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের (ডব্লিউজিসি) সদ্য প্রকাশিত ‘দ্য রেলেভেন্স অব গোল্ড অ্যাজ আ স্ট্র্যাটেজিক অ্যাসেট ২০২৩’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত দুই দশকে কৌশলগত সম্পদ, নিরাপদ বিনিয়োগ ও বিলাসি পণ্য হিসেবে সোনা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। সম্পদ বৃদ্ধি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ পোর্টফোলিওতে সোনার ভূমিকা জোরদার হচ্ছে। বিশ্বে ১৯৭১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সোনায় বিনিয়োগে বছরে প্রায় ৮ শতাংশ হারে মুনাফা হয়েছে। এতটা লাভ ইক্যুইটি, বন্ড ও অন্যান্য পণ্যে পাওয়া যায়নি।
ডব্লিউজিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উচ্চ ঝুঁকির সময়ে নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে সোনার ভূমিকা ঐতিহ্যগতভাবেই ভালো। সোনার দামের গতিশীলতা অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে, যা চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং ইক্যুইটি ও বন্ড বাজারকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক উদ্বেগের সময়ে স্বস্তি দেবে।
ডব্লিউজিসি জানায়, ২ থেকে ৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতির বছরগুলোয়ও বিশ্বে সোনার দাম ৮ শতাংশ হারে বেড়েছে। ২০২২ সালে বিশ্ববাজারে দৈনিক গড়ে ১৩ হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যমানের সোনা কেনাবেচা হয়েছে। বিশ্বে বিনিয়োগকারী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর কাছে বর্তমানে যে পরিমাণ সোনা মজুত আছে, তার মূল্যমান ৪ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন বা ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি ডলার।
এদিকে ইয়াহু ফাইন্যান্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও ডলারের বাড়তি দরের কারণে বৈশ্বিক রিজার্ভ মুদ্রার ভান্ডারে ডলারের হিস্যা কমে ৪৭ শতাংশে নেমে এসেছে; আগের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে যা ছিল ৫৫ শতাংশ।
রিজার্ভে ও লেনদেনে ডলারের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া মুদ্রাগুলোর মধ্যে রয়েছে ইউরোপের ইউরো, রাশিয়ার রুবল, চীনা ইউয়ান, ভারতীয় রুপি ইত্যাদি। এরই মধ্যে ব্রিকস জোট বিশ্বব্যাপী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত সংরক্ষণে মার্কিন ডলারের যুগ যুগের আধিপত্য কমাতে মাঠে নেমেছে। ব্রিকস হলো বিশ্বের পাঁচটি উন্নয়নশীল দেশের জোট। এই পাঁচ দেশের নামের আদ্যক্ষর নিয়েই নামকরণ হয় ব্রিকস–এর; তা এ রকম—ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চীন ও সাউথ আফ্রিকা। ব্রিকস গঠিত হয় ২০০৬ সালে।
যে ২৪টি দেশ ব্রিকসের নেতৃত্বে নতুন রিজার্ভ মুদ্রার প্রবর্তন চাইছে তারা ইতিমধ্যে এই জোটেও যোগ দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ব্রিকস জোটে দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রদূত অনিল সুকলল একটি প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে বলেন, ইতিমধ্যে ১৩টি দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে যে তারা এই জোটে যোগ দিতে আগ্রহী।
ব্রিকস জোটে যোগ দিতে আগ্রহী উল্লেখযোগ্য দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে সৌদি আরব, ইরান, আর্জেন্টিনা, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), আলজেরিয়া, মিসর, বাহরাইন ও ইন্দোনেশিয়া।
রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বার্তা সংস্থা স্পুটনিকের প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্রিকস জোট এখন নতুন একটি বৈশ্বিক মুদ্রা প্রবর্তনের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, যা মার্কিন ডলারকে ছাড়িয়ে যাবে।
বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে ব্রিকসের সদস্য ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা মার্কিন ডলারে বৈদেশিক মজুত সংরক্ষণ থেকে দূরে সরে আসছে এবং দ্রুতগতিতে সোনার মজুত গড়ে তুলছে।
আগামী আগস্ট মাসের শেষ দিকে দক্ষিণ আফ্রিকায় পরবর্তী ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। তাতে নতুন অনেকগুলো দেশকে এই জোটের সদস্য করা এবং নতুন বৈশ্বিক মুদ্রা চালুর বিষয়ে বড় সিদ্ধান্ত আসতে পারে। এর আগে আগামী ২ ও ৩ জুন দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে ব্রিকস জোটের একটি বৈঠক হবে। তাতে জোটের বহর বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা হবে।