রাজধানীর শাহবাগ থানায় ছাত্রলীগ নেতাদের মারধরের ঘটনায় রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) আজিজুল হক, পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) হারুন অর রশিদসহ চারজনের দায় পেয়েছে পুলিশের তদন্ত কমিটি। অপর দুজন হলেন শাহবাগ থানার তৎকালীন পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশনস) মো. গোলাম মোস্তফা ও এডিসি হারুনের দেহরক্ষী মো. আলী হোসেন। এ ছাড়া পরোক্ষভাবে এ ঘটনায় অনেকের দায় রয়েছে বলে উল্লেখ করেছে কমিটি। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এপিএস আজিজুল হক তাঁর স্ত্রী পুলিশের এডিসি সানজিদা আফরিনের সঙ্গে এডিসি হারুনকে দেখে সন্দেহের বশবর্তী হয়ে শারীরিকভাবে আঘাত না করে তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানালে এই ঘটনা এড়ানো যেত বলে অভিমত দিয়েছে তদন্ত কমিটি। অন্যদিকে এডিসি হারুন সুশৃঙ্খল বাহিনীর সদস্য হয়েও ছাত্রলীগ নেতাদের থানায় এনে মারধর করে ঘটনাটি জটিল করেছেন বলে তদন্তে উঠে এসেছে। তদন্তকারীদের মতে, পুরো ঘটনায় সরকার বিব্রত হয়েছে। পাশাপাশি ঘটনাটি ছাত্রলীগের মতো একটি সংগঠন ও পুলিশ বাহিনীর মধ্যে অস্বস্তিকর ও আস্থাহীনতার পরিবেশ তৈরি করেছে।
আজিজুলের সঙ্গে এডিসি হারুনের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে গত ৯ সেপ্টেম্বর রাতে ছাত্রলীগের দুই কেন্দ্রীয় নেতাকে শাহবাগ থানায় নিয়ে বেদম মারধর করা হয়। এ নিয়ে সমালোচনার মুখে ১২ সেপ্টেম্বর এডিসি হারুনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
ঘটনার পরপর ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সদর দপ্তরের উপকমিশনার আবু ইউসুফকে প্রধান করে তিন সদস্যের এই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির বাকি দুই সদস্য হলেন রমনা বিভাগের এডিসি শাহেন শাহ্ ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের মতিঝিল বিভাগের এডিসি রফিকুল ইসলাম। তদন্ত কমিটির সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন, ঘটনার ভিডিও চিত্র পর্যালোচনা এবং এডিসি হারুন, এডিসি সানজিদা আফরিন ও তাঁর স্বামী রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হক ও সংশ্লিষ্ট ছাত্রলীগ নেতাদের বক্তব্য শুনেছেন।
এ ঘটনায় আলাদা আলাদা করে প্রত্যেকের দায় নিরূপণ করা হয়েছে বলে তদন্ত কমিটির সদস্য এডিসি শাহেন শাহ্ জানিয়েছেন। প্রশ্নের জবাবে তিনি গতকাল বৃহস্পতিবার বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন এখনো জমা দেওয়া হয়নি। তা শেষ পর্যায়ে আছে।
ঘটনা যা ঘটেছিল
তদন্ত কমিটি বলছে, রাজধানীর ইব্রাহিম কার্ডিয়াক (বারডেম) হাসপাতালে এডিসি সানজিদার সঙ্গে হারুনকে দেখে তাঁকে আঘাত করেন এপিএস আজিজুল হক। এর মধ্য দিয়েই ঘটনার সূত্রপাত হয়, যা পরবর্তী সময়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় রূপ নেয়।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঘটনার দিন রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হক তাঁর স্ত্রী এডিসি সানজিদা আফরিন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের আশপাশে আছেন জানতে পেরে তাঁর খোঁজে বের হন। এ সময় তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হল শাখার সাধারণ সম্পাদক শরীফ আহমেদ (মুনিম) এবং কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও ফজলুল হক হল শাখার সভাপতি আনোয়ার হোসেনকে (নাঈম) সঙ্গে নেন। তাঁরা ওই এলাকায় সানজিদা আফরিনের গাড়ি খুঁজতে থাকেন। একপর্যায়ে বারডেম হাসপাতালের সামনে গাড়ি দেখতে পান।
তখন নিজের গাড়িচালক সাজিদুরকে নিয়ে হাসপাতালের কার্ডিয়াক বিভাগে গিয়ে সানজিদাকে খুঁজতে থাকেন আজিজুল। এ সময় এডিসি হারুনকে দেখতে পেয়ে সানজিদা কোথায় আছেন, তা জানতে চান। এডিসি হারুন ইটিটি (হৃদ্রোগের পরীক্ষা) কক্ষ দেখিয়ে দেন। এপিএস আজিজুল তখন হারুনকে বলেন, ‘তুই দাঁড়া।’ এডিসি হারুন তখন বলেন, ‘আপনি আসছেন, আমি চলে যাই।’ হারুন চলে যেতে চাইলে আজিজুল তাঁর টি–শার্ট ধরে ধাক্কা দিতে দিতে ইটিটি কক্ষের সামনে নিয়ে যান। আজিজুল এর মধ্যে ছাত্রলীগ নেতা শরীফ, আনোয়ার ও শেখ ফরিদকে ফোন করে ওপরে ডাকেন। তাঁরা দ্রুত সেখানে গেলে আজিজুল এডিসি হারুনকে ইটিটি কক্ষের সামনে মারধর শুরু করেন। এ সময় হারুনের চশমা ভেঙে যায় ও কপালে আঘাত পান। একপর্যায়ে হারুনকে টেনেহিঁচড়ে মারতে মারতে ইটিটি কক্ষে ঢোকানো হয়।
এর কিছুক্ষণ পর শাহবাগ থানার ওসিসহ অন্য পুলিশ সদস্যরা এসে এপিএস আজিজুল ও ছাত্রলীগ নেতা শরীফকে ধরে থানায় নিয়ে যান। আনোয়ার পরে তাঁদের খোঁজ করতে থানায় গেলে এডিসি হারুন, শাহবাগ থানার পরিদর্শক গোলাম মোস্তফা ও হারুনের দেহরক্ষী তাঁকে মারধর করেন।
তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, ঘটনাটি ঘটেছে এডিসি সানজিদা আফরিনকে ঘিরে। পুরো ঘটনার দায় তিনি কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না। অন্যদিকে এডিসি হারুন একজন সুশৃঙ্খল বাহিনীর সদস্য হয়েও এই ঘটনা নিয়ন্ত্রণ না করে উল্টো জটিল করে তুলেছেন। তিনি কোনোভাবেই কাউকে থানা হেফাজতে রেখে মারধর করতে পারেন না।
শাস্তি হবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্তে
ঘটনার পর এডিসি হারুনকে সাময়িক বরখাস্ত ও শাহবাগ থানার পরিদর্শক গোলাম মোস্তফাকে ওই দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এ ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি তদন্ত কমিটি কাজ করছে। ওই কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান জানিয়েছেন। ২ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হক প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাবে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘তাঁর যে ডিপার্টমেন্ট আছে, সেটিও সরকারি বিধিবিধান মোতাবেক ব্যবস্থা নেবে। আমি মনে করি, জড়িত দুজন সরকারি ডিপার্টমেন্টের এবং দুজনই ক্যাডার কর্মকর্তা। সেখানে দুজনের নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ রয়েছে। যার যার দায়িত্ব সেই সেই পালন করবে।’
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির একজন সদস্য গতকাল বলেন, তাঁরাও কাজ গুছিয়ে এনেছেন। অল্প সময়ের মধ্যেই প্রতিবেদন দেবেন বলে আশা করছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, এ ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে অবশ্যই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আজিজুল হকের বাবার মুক্তিযোদ্ধা সনদ আলোচনায়
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, একটি অভিযোগের ভিত্তিতে আজিজুল হকের বাবা গাউছুর রহমানের বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতির গেজেট ও সনদ বাতিল করেছিল জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)। ২০১৮ সালের জামুকার একটি বৈঠকের (৫৯তম) কার্যবিবরণীতে বলা হয়, গাউছুর রহমানের ছেলে আজিজুল হক মন্ত্রীর কাছে লেখা এক আবেদনে ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে বিদ্বেষপ্রসূতভাবে একজন অমুক্তিযোদ্ধার আনা মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগের সুবিচার প্রার্থনা করেন। এ নিয়ে বৈঠকে আলোচনার পর বলা হয়, গাউছুর রহমান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সপক্ষে কোনো দালিলিক তথ্যপ্রমাণ হাজির করতে পারেননি। তাই তাঁর গেজেট ও সনদ বাতিলের বিষয়ে সবাই একমত পোষণ করেন।
২০২০ সালের ২৭ জানুয়ারি মন্ত্রণালয়ের এক চিঠিতে এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী লিখেছিলেন, ‘গাউছুর রহমান খান প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নন। কোনো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন নাই। তাঁর সনদ ও গেজেট বাতিল করা হলো।’
পরে আদালতের নির্দেশে ২০২২ সালের ১৬ জুন গাউছুর রহমানের গেজেটটি পুনর্বহাল করা হয়। ৩১তম বিসিএসের কর্মকর্তা আজিজুল হক ২০১৩ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি পেয়েছিলেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘গাউছুর রহমানের বাড়ি আমার জেলায়। প্রথমত, জামুকায় তাঁর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে এবং এলাকাতে খোঁজ নিয়েই আমরা গেজেট বাতিল করেছিলাম। কিন্তু আদালতের নির্দেশে তা আবার বহাল করেছি।’