নতুন বাজেট সামনে রেখে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান কথা বলেছেন অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। বলেছেন নিজের অভিজ্ঞতার কথা। জানিয়েছেন সরকারের নানা পরিকল্পনার কথাও। তাঁর মিন্টো রোডের নিজ বাসভবনে ২২ মে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সোহরাব হাসান, শওকত হোসেনওআরিফুর রহমান।
পরিকল্পনামন্ত্রী: একক কেউ অর্থনীতি চালাচ্ছেন; আমি তা মনে করি না। এটা সম্ভবও নয়। এককভাবে যদি কাউকে দায়িত্ব দিতে চান, সেটি হতে পারেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁকে অর্থনীতিবিদ হতে হবে না। প্রধানমন্ত্রীর আরেকটি দিক হচ্ছে, তাঁর উচ্চ কাণ্ডজ্ঞান ও অভিজ্ঞতা। তাঁর বেড়ে ওঠা, রাজনীতি, বয়স, আগ্রহ, কৌতূহল সবকিছুই আছে। এটা এ জন্য বলেছি যে মন্ত্রিসভা ও একনেকের বৈঠকে তিনি অর্থনীতি নিয়ে কথা বলেন। শুনে অবাক হই। তাই শেষ বিচারে কাউকে যদি চিহ্নিত করতেই চান, তাহলে বলব, প্রধানমন্ত্রীই করেন। অবশ্য সারথি হিসেবে অনেকে আছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আছেন। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আছেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে অর্থমন্ত্রী বাইরে না এলেও তিনিও ভূমিকা রাখেন। অর্থসচিবও পরামর্শ দেন। এ দেশে বেড়ে ওঠার কারণে আমারও কিছুটা অভিজ্ঞতা আছে। তাই আমি নিজে কিছু কথা বলি। তবে আমার সরাসরি ভূমিকা নেই। পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখি।
পরিকল্পনামন্ত্রী: অর্থনীতি ভালোই চলছে। অভ্যন্তরীণ কিছু সমস্যা মোকাবিলা করা যাবে বলে মনে করি। তবে দেশের বাইরের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমরনীতি আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এখান থেকে বের হওয়ার পথ জানা নেই। এখন সময় হচ্ছে, চুপচাপ থেকে কাজ করা। সেটি হতে পারে হাতের কাজ, পায়ের কাজ বা মাটির কাজ। তারা তাদের খেলা খেলবে। খেলুক। এখানে কিছু করতে পারব না। আমাদের নিছক ঘরের কোণে বসে থেকে নিজেদের কাজ করতে হবে। এর বাইরে গেলে আমাদের ক্ষতি হবে।
ডলার–সংকট এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। রিজার্ভ বাড়ছে না। মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের বেশি। এমন পরিস্থিতিতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটও আসছে। নতুন বাজেটে মানুষকে কতটুকু স্বস্তি দিতে পারবেন।
পরিকল্পনামন্ত্রী : নদীর যেমন স্রোত আছে। নদীর স্রোত মাঝে মাঝে কমে। তেমনি রিজার্ভও কমবে; বাড়বে। দেখার বিষয় হচ্ছে, এটি যেন ভয়ংকরভাবে না নামে। এখন ৩০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে আছে। আমি ভীত নই। তবে নজরদারিতে রাখতে হবে। মাঝেমধ্যে রেমিট্যান্স কমে যাচ্ছে। চুরি বাড়ছে। এটি ভয়ংকর। যতটুকু সম্ভব মানি লন্ডারিং কমানো উচিত। রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়াতে সরকার কাজ করছে। এই যেমন ২.৫ শতাংশ, ৩ শতাংশ নগদ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। তবু কাজ হচ্ছে না। কারণ, প্রবাসীরা প্রায় নিরক্ষর কিংবা স্বল্প সাক্ষর। তাঁরা সাংস্কৃতিকভাবে আমাদের ভয় পান। ব্যাংকের দরজায় যেতে ভয় পান। এক্সচেঞ্জ কর্মকর্তার সামনে যাওয়া মানসিকভাবে নিজেদের ছোট মনে করেন। এ জন্য হুন্ডি ব্যবসায়ীদের অবস্থান শক্তিশালী।
পরিকল্পনামন্ত্রী: মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার কারণ হচ্ছে, দেশে সরবরাহের অপ্রতুলতা। জনসংখ্যা বাড়ছে। লাফিয়ে লাফিয়ে চাহিদা বাড়ছে। মানুষের মধ্যে আকাঙ্ক্ষা বাড়ছে। মাথাপিছু জাতীয় আয় অতীতের তুলনায় বেশি। মানুষ অনেক কিছু কিনতে চায়। ব্যবহার করতে চায়। ভালো থাকতে চায়। এ জন্য পণ্যের ওপর চাপ বাড়ছে।
মূল্যস্ফীতি কমাতে সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ হতে পারে বাজারকে সম্পূর্ণ নির্বিঘ্ন রাখা, মসৃণ রাখা। পণ্য যাতায়াতে পথেঘাটে বাধা না হয়, যেটি নিশ্চিত করা। কিন্তু এটি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। আরেকটি উপায় হচ্ছে, পণ্যের উৎপাদন বাড়ানো। উৎপাদনের মূল রাজা হচ্ছে চাল। চালের ওপর আস্থা আছে। সব মিলিয়ে সরবরাহ বাড়াতে হবে। আর সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পেঁয়াজ নিয়ে টালমাটাল অবস্থা চলছে। এখানে হাত দিতে হবে। হাতে অস্ত্র আছে। তবে পুলিশি অস্ত্র দিয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করলে লাভ হবে না; বরং ক্ষতি হবে। ডলারের মজুত ঠিক রাখতে আমদানি কমাতে হবে। বিদেশি ঋণ বাড়াতে হবে। বিদেশি ঋণ বাড়াতে উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে কথা হচ্ছে।
পরিকল্পনামন্ত্রী: গায়ে জ্বর হলে আগে তাপমাত্রা মাপতে হয়। এখন প্রতি ঘণ্টায় মাপা উচিত। বাজারে গেলে তাপ বোঝা যায়। সবচেয়ে কষ্ট হয় নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য। দেশে এখন নিম্ন আয়ের মানুষের হার সাড়ে ১৮ শতাংশ বলা হয়। কিন্তু সামান্য অর্থ ঘরে আছে, যা দিয়ে সর্বোচ্চ তিন দিন চলবে, এমন সংখ্যা যোগ করলে নিম্ন আয়ের মানুষের হার অনেক বেশি হবে। এসব নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য টিসিবির আওতায় পণ্য সরবরাহ বাড়াতে হবে। এ ছাড়া যেসব পণ্য আমদানিতে বেশি ভ্যাট, কর ও শুল্ক থাকে, সেটি বাদ দিতে হবে। এগুলো দ্রুত করা দরকার।পরিকল্পনামন্ত্রী: মন্ত্রী হিসেবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে আমার ১০ বছর হয়ে গেল। আমি আমলা ছিলাম। মূলত আমলারা এডিপি বাস্তবায়ন করেন। এডিপি কম বাস্তবায়ন হওয়ার কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আছে। কাজের যে বরাদ্দ বা আদেশ, সেটি একজনের টেবিলে পড়ে থাকতে দেখা যায়। এক দিন সই না করলে এক দিন নষ্ট হয়ে গেল। এটি দেশের ক্ষতি। ৪০ বছর আগে আমি যখন নবীন কর্মকর্তা ছিলাম, তখন যা দেখেছি, এখনো তাই দেখছি। আমাদের জাতীয় দক্ষতার মজুত খুব বেশি নয়। উচ্চপর্যায়েও বেশি নয়। পেশাজীবীরা তাঁদের কাজে এখন সন্তুষ্ট নন। তাঁরা সিদ্ধান্তের ব্যাপারে নিজেদের ভূমিকা চান। তাঁরা কাজটা না করে হতাশা বা মনোবেদনায় বসে থাকেন। কাজ করেন না। কাজ থাকে কেরানীগঞ্জে। তাঁরা বসে থাকেন ঢাকায়। এটি জাতিগত বৈশিষ্ট্য।
পরিকল্পনামন্ত্রী: প্রশাসনে তেজ বেড়েছে। তবে গভীরতা কমেছে। কাজের প্রতি কর্মকর্তাদের যে ভালোবাসা বা প্রতিশ্রুতি (কমিটমেন্ট) থাকার কথা, সেটি নেই। তাঁরা প্রজাপতির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
এক দশকের অভিজ্ঞতায় মন্ত্রী হিসেবে কী করতে চেয়েছিলেন; কিন্তু করতে পারেননি।
পরিকল্পনামন্ত্রী: আমি যা করতে চেয়েছি কিন্তু পারিনি, তার একটি হলো আমাদের বেশি ন্যায়ানুগ হওয়া। এ ছাড়া যাদের আমরা দরিদ্র বলছি, তারা কেন দরিদ্র, সেটি দেখা। নাকি তারা বঞ্চিত, এটা আরও গভীরে যাওয়া দরকার। লুকিয়ে রাখা যাবে না। আমি কম আয়ের পরিবার থেকে এসেছি। গ্রামে দেখেছি, কয়েকটি পরিবার প্রভাব বিস্তার করে রাখে। জাতীয় পর্যায়েও তা–ই দেখছি। গ্রামে দরিদ্রদের কণ্ঠ নেই। তাদের বিরুদ্ধে বিচার চলে। কিন্তু তাদের কথা নেই। জাতীয় পর্যায়ে একই চিত্র।
পরিকল্পনামন্ত্রী: হাওরে রাস্তা নির্মাণ করে নিজেদের ক্ষতি করা—এটি একটি উদাহরণমাত্র। এটা অজ্ঞতাবশত হতে পারে। উন্নয়ন করতে হবে। উন্নয়ন মানেই দেশে ভবন আর সড়ক নির্মাণ করা। যেটা দৃশ্যমান। যাঁরা ভোট দেন, তাঁরা এটাই চান। তাঁরা তো পরিবেশবাদী নন। তাঁরা এর প্রভাব বুঝবেন না। গ্রামের মানুষ সড়ক চান। কিন্তু এই সড়কের কারণে যে আরও তিনটি গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সেটা তাঁরা বুঝতে চান না। আমরা আগে এসব সমীক্ষা করিনি। সাবধানতা অবলম্বন করা হয়নি।
পরিবেশের কিছু স্পর্শকাতর এলাকা আছে। হাওর, জলাভূমি, চর—এগুলো স্পর্শকাতর এলাকা। একটুতেই ভেঙে পড়ে। হাওরে সড়ক নির্মাণ করার পর দেখা গেল, এখন উঠানে পানি উঠেছে। জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে। সড়ক ভাঙছে। তবে আমরা সড়ক নির্মাণ করেছি সৎ উদ্দেশে। মানুষও সড়ক চেয়েছে। আমরাও ভোটের কাঙাল। এটা করেছি। এটা জাতীয় সমস্যা। অবশ্য এখন নির্বাহী আদেশ আছে, নতুন করে আর যেন হাওর ও জলাভূমিতে সড়ক নির্মাণ করা না হয়। আমরা হাওরে ভবিষ্যতে উড়ালসড়ক নির্মাণ করব। ইতিমধ্যে সুনামগঞ্জের সঙ্গে নেত্রকোনার সংযোগের জন্য উড়ালসড়ক নির্মাণ প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছি।
আপনি ভোটের কাঙালের কথা বলছেন। আপনার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে প্রচুর প্রকল্প আসে। সামনে জাতীয় নির্বাচন। এ সময়ে আরও বেশি চাপ আসবে। এ চাপ সামলান, নাকি মেনে নেন।
পরিকল্পনামন্ত্রী: এখন রাজনীতিবিদ হলেও একসময় আমি আমলা ছিলাম। প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষেত্রে ‘দেখছি’, ‘অপেক্ষা করুন’ এসব বলছি। আমাকে এসব কৌশল নিতে হচ্ছে। তবে আমার সহকর্মী মন্ত্রী বা সংসদ সদস্য যখন আমাকে ফোন করে প্রকল্প অনুমোদনের জন্য অনুরোধ করেন, তখন বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হয়। প্রকল্পটি বাদ দিতে পারি না। আমার কর্তৃপক্ষ একনেকের চেয়ারপারসন (প্রধানমন্ত্রী) আছেন। তাঁর সঙ্গে কথা হয়। সামনে জাতীয় নির্বাচন। ভোটের সময় এমপিরা দৌড়ে আসবেন। তবে তাঁরা এলেই যে যেনতেনভাবে প্রকল্পটি পাস করে দেব, তা হবে না। প্রকল্পটি আর্থিকভাবে লাভজনক না হলে অনুমোদন দেওয়া হবে না। আগের তুলনায় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এখন বেশ সক্ষম। আরেকটি কথা হলো, এখন প্রকল্প নিয়ে এলেও প্রক্রিয়া করতে করতে নির্বাচন চলে আসবে। তবে মানুষ জানল যে আমরা এ কাজটি করতে যাচ্ছি। দেশের মানুষ অপেক্ষা করতে চায় না। সে সুযোগটা আমরা নেব।
পরিকল্পনামন্ত্রী: বিদেশি ঋণ যদি না নিতাম, তাহলে আমরা স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সড়কে কাজ করতে পারতাম না। যদি এসব কাজ না করতাম, তাহলে আমরা এখন কোথায় থাকতাম? টানাটানি তো আছে। যদি বলেন, বিদেশি ঋণ নিয়ে ভয়, সংশয়, চিন্তা কিছুই নেই। তবে সাবধানতা আছে।
পরিকল্পনামন্ত্রী: সরকারপ্রধান ব্যয় ও অপচয় কমাতে বলেছেন। আমরা পরিকল্পনা কমিশন প্রকল্পগুলো গভীরভাবে দেখছি। প্রকল্পে গাড়ি কত সংখ্যক থাকছে; বিদেশ সফর, সম্মানী, এসবে ফাঁকফোকর আছে। এটি অন্যায় কিছু নয়। আবহমান কাল থেকে ছিল। এগুলোকে এখন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছি। ধীরে ধীরে নির্মূলের চেষ্টা করছি। তবে এক বাজেট বা এক রাতে এসব ফাঁকফোকর নির্মূল করা সম্ভব নয়। ধীরে ধীরে কমাতে হবে।
পরিকল্পনামন্ত্রী: বড় প্রকল্পে বড় দুর্নীতির কথা আমরাও শুনি। এটা স্বাভাবিক কথা। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে বহুমাত্রিক পদক্ষেপ আছে। যেমন আমাদের সরকারি সংস্থা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) আছে। যারা প্রকল্প নজরদারি করে; কিন্তু সরকারি এ প্রতিষ্ঠান ঠুঁটো জগন্নাথ। তাদের লোকবল নেই; যন্ত্র নেই, যাতায়াতের বাজেট নেই। এই প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতে হবে। আরেকটি জিনিস করতে হবে, সবকিছুতেই প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে। চিঠির মাধ্যমে বরাদ্দ না দিয়ে প্রযুক্তির মাধ্যমে দিতে হবে। তবে আমরা মানসিকভাবে এখনো কাগজে আবদ্ধ। এই মানসিকতা দূর করতে সময় লাগবে।