এক যুগ হয়ে গেল, এখন পর্যন্ত জাতীয় মানবাধিকার কমিশন জাতিসংঘের আওতাধীন সংশ্লিষ্ট সংস্থার বি শ্রেণিভুক্ত। সার্কভুক্ত দেশ নেপাল এ সময়ে এ শ্রেণিতে উন্নীত হয়েছে। তালেবান ক্ষমতায় আসার আগপর্যন্ত আফগানিস্তানও এ মর্যাদা পেয়েছিল। তবে বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সেই ২০১১ সাল থেকেই একই অবস্থায় আছে। মান বা অবস্থান উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ না করাতেই কমিশনের এমন অবস্থা।
যেসব দেশের মানবাধিকার কমিশন স্বাধীন, সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়া কাজ করতে পারে এবং আর্থিকভাবে প্রভাবমুক্ত, সেসব দেশের কমিশনকে এ শ্রেণিভুক্ত করা হয়। বি শ্রেণি হলো মাঝামাঝি। এই শ্রেণিতে থাকা দেশগুলো সাধারণত উল্লিখিত শর্তগুলো পূরণ করতে পারে না। তারা মান উন্নয়নের চেষ্টায় থাকে। আর সি শ্রেণিভুক্ত মানবাধিকার কমিশনের মান খুব অসন্তোষজনক।
মানবাধিকারকর্মীরা বলেছেন, সমতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ভূমিকা বিপুল। কিন্তু সে কাজে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন মোটেও তার যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারেনি। তা করতে পারলে মানেরও উন্নয়ন হতো, বৈশ্বিক পরিসরেও স্বীকৃতি মিলত। দেশে সার্বিক মানবাধিকার সংরক্ষণে কমিশনের ভূমিকা যে কার্যকর নয়, এ শ্রেণিতে উন্নীত না হওয়া তার প্রমাণ।
বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার কমিশনের গঠন ও কার্যক্রমের ওপর ভিত্তি করে এগুলোকে এ, বি ও সি শ্রেণিভুক্ত করা হয়। আগে এটি করত জাতিসংঘের আওতাধীন সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল কো-অর্ডিনেটিং কমিটি ফর ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস ইনস্টিটিউশনস (আইসিসি)। পরে এর দায়িত্ব পায় গ্লোবাল অ্যালায়েন্স অব ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস ইনস্টিটিউশনস (গ্যানরি)।
২০০৯ সালে যাত্রা শুরু করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। এর দুই বছর পরে বি শ্রেণিভুক্ত হয় সংস্থাটি।
এমন পরিস্থিতিতে আজ ১০ ডিসেম্বর বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘সবার জন্য স্বাধীনতা, সমতা ও ন্যায়বিচার।’
বাংলাদেশের এমন অবস্থা কেন
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, কোনো দেশের মানবাধিকার কমিশনের এ মর্যাদা পাওয়ার অর্থ হলো দেশটিতে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ মানবাধিকার কমিশন আছে, এমন স্বীকৃতি পাওয়া। এ শ্রেণির মানবাধিকার কমিশন জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা রাখতে পারে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে গিয়ে সরাসরি কথা বলতে পারে। এখন বাংলাদেশ এখানে শুধু প্রতিবেদন দাখিলের এখতিয়ার রাখে।
ফারুখ ফয়সলের কথা, ‘আমাদের জাতীয় মানবাধিকার সংগঠন সরকারের আজ্ঞাবহ। তারা এমন কিছু করেনি যে তাদের মানের উন্নয়ন হবে।’
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সূত্র বলেছে, ২০১১ সালে বি শ্রেণিভুক্ত হওয়ার কারণ হিসেবে কমিশনের কিছু সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে তৎকালীন আইসিসি। এর প্রথমটি হলো, কমিশনের সচিবসহ উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা সরকারের নিযুক্ত। সিদ্ধান্ত নেওয়ার পদগুলোতে সরকার নিযুক্ত ব্যক্তি থাকা একটি দুর্বলতা। দ্বিতীয়ত, কমিশনের আর্থিক স্বাধীনতা ও নিজস্ব সচিবালয় নেই। আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে কমিশনকে কাজ করতে হয়। তৃতীয়ত, কমিশনারদের নিয়োগ নিরঙ্কুশভাবে সরকারের হাতে। এখানে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিত্ব নেই।
২০১৫ সালে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ওই বছরের মার্চে জেনেভায় আইসিসির সাবকমিটির সভায় আবার তাদের মান উন্নয়নের জন্য আবেদন করে। কিন্তু আইসিসি আবারও মানবাধিকার কমিশনকে বি শ্রেণিতেই রাখে।
ওই সময় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মিজানুর রহমান। তাঁর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আইসিসির সাবকমিটির সভায় আগের শর্তগুলোর উন্নতি না হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্ত না করতে পারার যে বাধ্যবাধকতা আছে, তা দূর করতে পরামর্শ দেওয়া হয়।
মানবাধিকার কমিশনের আইন অনুযায়ী, তারা শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো অপরাধের তদন্ত করতে পারে না। অথচ দেশে এসব বাহিনীর বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের অনেক অভিযোগ আছে।
মিজানুর রহমান বৃহস্পতিবার বলেন, ‘কমিশনকে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হলে এর নিয়োগ, আর্থিক ক্ষমতা-সংক্রান্ত বিষয়ে আইনের সংশোধন জরুরি। শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগের তদন্ত করারও এখতিয়ার তাদের থাকা দরকার। আমি চেয়ারম্যান থাকার সময় এসব বিষয়ে সংশোধন চেয়ে প্রতিনিয়ত বলছি। কিন্তু আইন মন্ত্রণালয়ের কোনো সহযোগিতা পাইনি।’
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে দিন দিন বেড়েছে সরকারি কর্মকর্তাদের প্রাধান্য। এখন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ এবং সার্বক্ষণিক সদস্য সেলিম রেজা দুজনই সাবেক সচিব। এর সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রেও সুশীল সমাজের কোনো অংশগ্রহণ থাকে না। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপরাধের তদন্ত করার ক্ষেত্রে আইনের সংশোধনী আজও হয়নি।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক অবশ্য বলেন, ‘আমাদের প্রচলিত আইন অনুযায়ী, শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে এসব তদন্তের এখতিয়ার কমিশনের নেই। এসব ক্ষেত্রে আমাদের ভিন্ন, যথেষ্ট স্বচ্ছ আইন আছে। শুধু আমাদের নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও আছে। এটা তো আমাদের মানতে হবে।’
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপরাধের অভিযোগ তদন্তের এখতিয়ার এ শ্রেণি পাওয়ার
ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা নয় বলেই মনে করেন আইনমন্ত্রী। তাঁর কথা, ‘আমরা বেশ কিছু প্রয়োজনীয় সংস্কার করেছি। এ শ্রেণি পাওয়ার দিকে এগিয়ে আছি।’
মানবাধিকার কমিশনগুলোর মানের তদারকি সংস্থা গ্যানরির কাছে মান উন্নয়নের জন্য কোনো আবেদন করা হয়েছে কি না, সে বিষয়ে জানার জন্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও সার্বক্ষণিক সদস্যের কাছে ফোন করে এবং মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।
দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেন, ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের এত দিন ধরে বি শ্রেণিতে থাকা আমাদের মানবাধিকর পরিস্থিতির দৈন্যদশাকে তুলে ধরে। খোদ কমিশন ও সরকারের মধ্যে মান উন্নয়নে কোনো আন্তরিক চেষ্টা নেই। যেভাবে চলছে চলুক, তাদের ভাবটা এমনই।’