আকাশি রঙের আঁকাবাঁকা দাগ দিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মানচিত্রে জিরানী খাল চিহ্নিত করা আছে। এই খাল দক্ষিণ সিটির ৪, ৫, ৭৪ ও ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডের ভেতর দিয়ে গেছে। খালের শুরু সবুজবাগের কুসুমবাগ ব্রিজের নিচ থেকে। প্রায় চার কিলোমিটার পথ পেরিয়ে খালটি ত্রিমোহনী বাজার–সংলগ্ন বালু নদে মিশেছে। মানচিত্র দেখে কেউ যদি জিরানী খাল দেখতে যান, তবে তিনি এটি খুঁজে পাবেন কি না, সন্দেহ আছে।
আগাছা, আবর্জনা ও কচুরিপানা জন্মে এমন দশা হয়েছে, এটি যে খাল, তা বোঝার উপায় নেই। গত শুক্রবার দুপুরে ত্রিমোহনী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এই খালে পানিপ্রবাহ দূরের কথা, কোথাও কোথাও রীতিমতো আবর্জনার স্তূপ জমেছে।
কাগজে-কলমে এই খাল প্রস্থে কোথাও ২০ ফুট, কোথাও ৫০ ফুট। রাজধানীর শান্তিনগর, নয়া পল্টন, মতিঝিল, কমলাপুর, মানিকনগর, সবুজবাগ ও খিলগাঁও এলাকার বৃষ্টির পানি এই খাল হয়ে বালু নদে পড়ে। গত বর্ষা মৌসুম শেষ হওয়ার পর এখন পর্যন্ত এই খাল খনন করা হয়নি। ফলে ভারী বৃষ্টি হলে এবারও কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতা হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) কর্মকর্তারা বলছেন, একটি প্রকল্পের আওতায় জিরানীসহ মোট চারটি খাল পুনরুদ্ধার, সংস্কার ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করা হবে। এ জন্য ৮৯৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে। খুব শিগগির দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া শুরু হবে। আগামী দুই মাসের মধ্যে মাঠপর্যায়ের কাজ শুরু করার বিষয়ে আশাবাদী এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রকৌশলীরা।
তবে সিটি করপোরেশনের পরিকল্পনা অনুযায়ী, যখন প্রকল্পের কাজ শুরু হবে, তখন থাকবে ভরা বর্ষা। আর কাজ শুরু করতে দেরি হলে বর্ষা মৌসুম পার হয়ে যাবে। যদিও প্রকল্পটি গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে অনুমোদন হয়।
মোট ১২টি বড় খাল রয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকায়। এর মধ্যে গত এক বছরেও খনন না হওয়া চারটি খাল হচ্ছে—জিরানী, মান্ডা, শ্যামপুর ও কালুনগর খাল। এসব খাল দিয়ে বৃষ্টির পানি রাজধানীর চারপাশের নদ–নদীতে পড়ে। চারটি খাল খনন না করায় এবার বর্ষায় ভারী বৃষ্টি হলে দক্ষিণ সিটির বেশ কিছু এলাকার মানুষকে জলাবদ্ধতার ভোগান্তি সইতে হতে পারে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য ১২টি খালের পাশাপাশি দুটি বক্স কালভার্ট, দুটি পাম্প হাউস ও ৫১টি স্লুইসগেট রয়েছে। চলতি অর্থবছরে (২০২২–২৩) জলাবদ্ধতা নিরসনে বিভিন্ন খাতে ডিএসসিসি প্রায় ১২০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে। করপোরেশনের প্রকৌশলীরা জানান, খালগুলোর ভাসমান বর্জ্য অপসারণ ও খনন খাতে বরাদ্দ রাখা আছে ২ কোটি ৮১ লাখ টাকা। দুটি বক্স কালভার্ট পরিষ্কারে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ কোটি ৩০ লাখ টাকা। পাম্প হাউসের অচল যন্ত্র সচল করতে খরচ হচ্ছে প্রায় ৬ কোটি টাকা, ওয়ার্ডভিত্তিক নালা পরিষ্কারে বরাদ্দ ২১ কোটি টাকা, যেসব এলাকায় নানা কারণে বৃষ্টির পানি আটকে থাকে সেসব এলাকার জন্য ৫০ কোটি টাকা, আদি বুড়িগঙ্গা চ্যানেলের পরিষ্কার ও খননে ৩৬ কোটি টাকা এবং স্লুইসগেট রক্ষণাবেক্ষণে বরাদ্দ ২ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আকবর হোসেন বলেন, গত বছর জিরানী খালের বর্জ্য অপসারণ করা হলেও এ বছর এখন পর্যন্ত তা করা হয়নি। ভারী বৃষ্টি হলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
জিরানী খালের মতোই একই অবস্থা দক্ষিণ সিটির আওতাধীন মান্ডা খালের। কাগজে-কলমে এই খাল দৈর্ঘ্যে প্রায় সাড়ে আট কিলোমিটার। এই খাল প্রস্থে কোথাও ১২ ফুট কোথাও ৫০ ফুট। গত শুক্রবার বিকেলে উত্তর মান্ডা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, খালজুড়ে আবর্জনার স্তূপ। খালের এই অংশ শুকিয়ে ভরাট হয়ে গেছে।
মান্ডা ও জিরানী খাল দুটোই দ্রুত খনন করা দরকার বলে মনে করেন দক্ষিণ সিটির ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর চিত্তরঞ্জন দাস। তাঁর ওয়ার্ডের ভেতর দিয়ে গেছে জিরানী খাল। আর ওয়ার্ডের পাশ দিয়ে গেছে মান্ডা খাল। চিত্তরঞ্জন দাস বলেন, গত বছর জিরানী খালের অবস্থা ভালো ছিল। তবে এখন আবর্জনা জমেছে, অনেক জায়গা ভরাট হয়ে গেছে। দ্রুত আবর্জনা অপসারণ করে পানি প্রবাহের উপযোগী করা দরকার।
সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগের দুজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, গত বছর খুব একটা বৃষ্টি হয়নি। তাই রাজধানীতে তেমন জলাবদ্ধতাও হয়নি। এবার বৃষ্টি বেশি হলে জলাবদ্ধতার আসল চিত্র বেরিয়ে আসতে পারে।
তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান গত বৃহস্পতিবার বলেন, ভারী বৃষ্টি হলে ৩০ থেকে ৪০ মিনিটের মধ্যে পানিনিষ্কাশন হয়ে যাবে। কোথাও যাতে জলাবদ্ধতা না হয়, সে জন্য খাল ও নালা পরিষ্কারে নিয়মিত কাজ অব্যাহত রাখা হয়েছে। চারটি খালের খননকাজ সময়মতো শুরু করা না গেলেও বর্ষায় এর প্রভাব পড়বে না বলে মনে করেন তিনি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে খনন করা আটটি খাল হচ্ছে বাসাবো খাল, কদমতলা খাল, কাজলা খাল, কুতুবখালী খাল, মৃধাবাড়ী খাল, মাতুয়াইল কবরস্থান–সংলগ্ন খাল, ডিএনডি বঁাধ–সংলগ্ন খাল, তিতাস খাল ও ঢাকা–চট্রগ্রাম মহাসড়ক–সংলগ্ন খাল (যাত্রাবাড়ী এলাকায়)।
দায়িত্ব পালনের দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে গত বছরের ১৬ মে বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছিলেন, বৃষ্টির পানি সড়কে আধা ঘণ্টার বেশি থাকবে না। তবে মেয়রের বক্তব্যের এক মাস পর ১৭ জুনের বৃষ্টিতে বংশালসহ ঢাকা দক্ষিণ সিটির বাবু বাজার, নাজিরাবাজার, কাজী আলাউদ্দিন রোড, গ্রিন রোড, কাঁঠালবাগান, মুগদা, বাসাবো টেম্পোস্ট্যান্ড, জুরাইনের মেডিকেল রোড, মুরাদপুর উচ্চবিদ্যালয় সড়ক, আলমবাগ, কুসুমবাগ ও আউটার সার্কুলার রোড এলাকার বিভিন্ন সড়কে সন্ধ্যা পর্যন্ত বৃষ্টির পানি ছিল। আর জুরাইন এলাকায় সকালের বৃষ্টির পানি রাত ১০টা পর্যন্ত সরেনি।
জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকা দক্ষিণ সিটির কার্যক্রম প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, প্রকল্পের দোহাই দিয়ে চারটি খালের বর্জ্য অপসারণ ও খননকাজ না করে অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে সিটি করপোরেশন। পানিপ্রবাহ ঠিক রাখতে খাল পরিষ্কার করা সিটি করপোরেশনের নিয়মিত কাজ। বর্ষা যেহেতু আসন্ন, তাই দ্রুত এ চারটি খালের বর্জ্য অপসারণের কাজ দ্রুত শুরু করা উচিত। তা না হলে এসব এলাকার বাসিন্দাদের জলাবদ্ধতার ভোগান্তিতে পড়তে হবে।