মাছ–মাংসের বাজারে ‘মাথা ঘোরে’

0
177

নদীর এক ডালা চিংড়ি। বেশির ভাগই একেবারে ছোট। শাক রান্নার উপযোগী। কয়েকটি মাঝারি আকারের। দাম জানতে চাইলে বিক্রেতা বললেন, ১ হাজার ৪০০ টাকা, নিলে একদাম ১ হাজার ২০০ টাকা কেজি রাখা যাবে।

চিংড়ির ডালার পাশে ছোট ছোট কিছু বেলে মাছও ছিল। দাম ৮০০ টাকা কেজি।

এটা গেল সুস্বাদু নদীর মাছের কথা। এবার দেখা যাক পাঙাশ, তেলাপিয়া, চাষের কই ইত্যাদি সস্তার মাছ কত দামে বিক্রি হচ্ছে। বাজার ঘুরে দেখা গেল, ছোট পাঙাশের কেজি ১৮০ থেকে ২০০ টাকা, চাষের কই ২৩০ থেকে ২৫০ টাকা এবং মাঝারি তেলাপিয়া ২৫০ টাকার আশপাশে।

এই চিত্র রাজধানীর পশ্চিম আগারগাঁও বাজারের। স্থানীয় সাধারণ মানুষ সেখানে কেনাকাটা করেন। এই বাজারে প্রায় সব ধরনের মাছের দাম বেড়ে গেছে। ক্রেতারা বলছেন, মাছের দাম শুনলে যেন মাথা ঘোরে।

গতকাল বৃহস্পতিবার চারজন প্রতিবেদক পশ্চিম আগারগাঁও ছাড়াও মিরপুর-১, উত্তরা আজমপুর, মহাখালী, শাহজাহানপুর, মালিবাগ, রামপুরা, শ্যামবাজার, সূত্রাপুর ও কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখেছেন। এসব বাজারে দেখা গেছে, নদী, খাল, বিল ও হাওরের মতো প্রাকৃতিক জলাশয়ের মাছের দাম অত্যধিক। আর যেসব মাছ চাষ হয়, সেগুলোর দামও বছরখানেক আগের তুলনায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বেশি।

পশ্চিম আগারগাঁও বাজারের মাছ বিক্রেতা আব্বাস উদ্দিন বলছিলেন, এক বছর আগেও এক কেজি পাঙাশ ১১০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি করেছেন। এখন কিনতেই হচ্ছে ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকা কেজি। বিক্রি করেন ১৮০ টাকায়। পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে দাম কেজিতে আরও ২০ টাকা বেশি ছিল।

বাজারে দুই শ্রেণির মাছ রয়েছে। এক শ্রেণিতে রয়েছে চাষের মাছ যেমন রুই, কাতলা, ট্যাংরা, পাবদা, শিং, তেলাপিয়া, পাঙাশ ও কই। এসব মাছের সরবরাহ সারা বছর স্থিতিশীল থাকে। দামও বাজার ও মৌসুমভেদে খুব বেশি হেরফের হয় না। আরেকটি শ্রেণিতে রয়েছে প্রাকৃতিক জলাশয়ের মাছ। এসব মাছের দাম অবশ্য ওঠানামা করে। তবে দাম সব সময় চাষের মাছের চেয়ে বেশি থাকে।

মাছের গড় দাম কতটা বেড়েছে তার একটি উদাহরণ হতে পারে পাঙাশ। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর মাছের জাতীয় খুচরা বাজারের গড় দরের হিসাব রাখে। তাদের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সালে এক কেজি ছোট পাঙাশের দাম ছিল ১১০ টাকা। ২০২১ সালে দাম দাঁড়িয়েছিল ১১১ টাকা। এর মধ্যে ওঠানামা করেছে। তবে খুব বেশি নয়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বাজারের স্থিতিশীল দামের মাছের মধ্যে পাঙাশ ছিল।

ঢাকার ১০টি বাজার ঘুরে গতকাল দেখা গেছে, ছোট ও মাঝারি পাঙাশ বিক্রি হয়েছে ১৮০ থেকে ২২০ টাকা কেজি। একটু বড় (দুই কেজির বেশি) পাঙাশ বিক্রি হয়েছে ২৫০ টাকা কেজি। বিক্রেতারা বলছেন, দাম বেড়েছে মূলত গত এক বছরে।

পশ্চিম আগারগাঁও বাজারের মাছ বিক্রেতা আব্বাস উদ্দিন বলেন, ওই বাজারে আগে দিনে ৫০০ কেজির মতো পাঙাশ বিক্রি হতো। এখন সেটা দেড় থেকে দুই হাজার কেজিতে উঠেছে। এর কারণ অন্যান্য মাছ, ব্রয়লার মুরগি ও গরুর মাংসের দাম বেড়ে যাওয়া এবং মানুষের আর্থিক পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যাওয়া। তিনি বলেন, দাম বাড়লেও এখনো কম দামে পাঙাশই কেনা যায়।

আব্বাস উদ্দিন যে কথাটি বলেছেন, গত মার্চে সেই বাস্তবতার চিত্র উঠে এসেছিল সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) জরিপে। সংস্থাটি বলেছিল, মূল্যস্ফীতির চাপে ৯৬ শতাংশ পরিবার মাংস খাওয়া কমিয়েছে। মাছ ও ডিম খাওয়া কমিয়েছে যথাক্রমে ৮৮ ও ৭৭ শতাংশ পরিবার। অনেকে খাদ্যাভ্যাস বদলেছেন।

মধ্যবিত্ত বিপাকে

মধ্যম আয়ের পরিবার চাল, ডালের দাম বাড়লে যতটা বিপাকে পড়ে, তার চেয়ে বেশি চাপে পড়ে মাছ-মাংসের দাম নিয়ে। যেমন বেসরকারি চাকরিজীবী রফিকুল ইসলাম বলছিলেন, তাঁর চার সদস্যের বাসায় মাসে ২৫ কেজির এক বস্তা চাল লাগে। চালের দাম কেজিতে ৫ টাকা বাড়লে তাঁর মাসে খরচ বাড়ে ১২৫ টাকা। কিন্তু এখন দুই কেজি মাছ কিনতেই এই পরিমাণ টাকা বাড়তি চলে যাচ্ছে।

নদীর কুঁচে চিংড়ির কেজি যে ১ হাজার ২০০ টাকা, তা আগেই বলা হয়েছে। এ রকম দামি মাছ আরও আছে। এক কেজি ওজনের একটি ইলিশ এখন ১ হাজার ৮০০ টাকা চান বিক্রেতারা। কাজলির কেজি ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা। মাঝারি আইড় ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা, বোয়াল ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা ও পোয়া ৪০০ থেকে ৭০০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।

সার্বিকভাবে চিত্রটি এই যে চাষের বাইরে কোনো মাছ কিনতে গেলেই ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা দাম পড়ছে। চাষের ছোট বাগদা চিংড়ির কেজিও এখন ৬৫০ টাকার আশপাশে বিক্রি হচ্ছে, যা মাস ছয়েক আগেও ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা ছিল।

ব্রয়লার মুরগি, ডিম ও গরুর মাংসের দামও আর আগের জায়গায় ফিরছে না। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০২০ সালে ফার্মের মুরগির জাতীয় গড় দাম ছিল ১২৫ টাকা কেজি। কিন্তু এক বছর ধরে ব্রয়লার মুরগির দাম ব্যাপক চড়া, বেশির ভাগ সময় ১৮০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে কেনাবেচা হয়েছে। গতকাল দর ছিল বাজারভেদে ১৭০ থেকে ১৯০ টাকা কেজি।

ডিমের চিত্রটিও একই। সাধারণ বাজারে ডিমের ডজন ৯০ থেকে ১১০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করত। গত এক বছরে বেশির ভাগ সময় তা ১৪০ টাকার আশপাশে ছিল। গতকাল দর ছিল ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা।

গরুর মাংসের দাম ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। গতকাল বিক্রি হয়েছে ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা কেজি। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০২০ সালে গড় দাম ছিল ৫৩৬ টাকা।

কেন বাড়ছে দাম

মাছ ও মাংস বিদেশ থেকে খুব একটা আমদানি হয় না। তবে বিক্রেতারা বলছেন, দাম বাড়ার কারণ মাছের খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি, পরিবহন খরচ ও ব্যবসায়ীদের নিজেদের সংসার খরচ বেড়ে যাওয়া।

পাঙাশ মাছের উদাহরণটি দেওয়া যাক। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ৫০ কেজির এক বস্তা মাছের খাবারের দাম ১ হাজার ২০০ টাকা ছিল এক বছর আগে। এখন সেটা ২ হাজার টাকার কাছাকাছি। ময়মনসিংহের ভালুকা থেকে ছোট ট্রাকে মাছ আনতে ভাড়া লাগত আড়াই হাজার টাকা। এখন তা সাড়ে তিন হাজার টাকা লাগছে। দোকানের বিদ্যুৎ বিল বেড়েছে।

মাছের খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধি ও মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন। ট্রাকভাড়া বাড়ার কারণ ব্যাপকভাবে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি। চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ সব পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মাছ ব্যবসায়ীর সংসার খরচ বেড়েছে। এখন একই পরিমাণ মাছ বিক্রি করে বাড়তি লাভের মাধ্যমে খরচ ওঠাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

সাধারণ মানুষের মধ্যে যাঁদের আয় বেড়েছে, তাঁরা পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে পেরেছেন। যাঁদের আয় ততটা বাড়েনি, কষ্টে আছেন তাঁরাই।

রামপুরা বাজারে গিয়ে গতকাল পাওয়া গেল এক ব্যক্তিকে, যিনি একটি পোশাক কারখানার মার্চেন্ডাইজার। তিনি কয়েক পদের মাছ দরদাম করে শেষমেশ ২৫০ টাকা কেজি দরে ২ কেজি ২০০ গ্রাম ওজনের একটি চাষের পাঙাশ কিনলেন।

মাছটি যখন কাটা হচ্ছিল তখন ওই ব্যক্তি বলেন, এক থেকে দেড় বছরে তাঁর পরিবারের বাজার খরচ দ্বিগুণ হয়ে গেছে। কিন্তু তাঁর বেতন বাড়েনি বললেই চলে। পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে মাংস কেনা কমিয়েছেন। দামি মাছ কেনা প্রায় বন্ধ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.