পর্যবেক্ষক পাঠাতে শর্ত ইইউর তত্ত্বাবধায়কে অনড় বিএনপি

0
101
পর্যবেক্ষক পাঠাতে শর্ত ইইউর

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া এবং আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচনে যাবে না বিএনপি। গতকাল রোববার ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে দেড় ঘণ্টা রুদ্ধদ্বার বৈঠকে দলটির আগের এ অবস্থান তুলে ধরেন নেতারা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া ত্রুটিপূর্ণ ও পক্ষপাতমূলক নির্বাচনে অংশ নিলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বৈধতা পাবে বলে জানিয়েছে দলটি।

অন্যদিকে, বৈঠকে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে পর্যবেক্ষক পাঠাবে না বলে জানিয়েছে ইইউ। একই সঙ্গে রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সংলাপের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে সংস্থাটি। বিএনপিকে এ বার্তা দিয়ে ইইউ বলেছে, নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাতে চায় তারা। এ কারণে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে আগামী জুন-জুলাই মাসে নির্বাচন-পূর্ব পর্যবেক্ষক দল ঢাকা আসবে।

বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বিএনপির চার সদস্যের প্রতিনিধি দল অংশ নেয়। অন্য সদস্যদের মধ্যে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ও মানবাধিকারবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান উপস্থিত ছিলেন। গুলশানে ইইউ ডেলিগেশন প্রধানের বাসভবনে সকাল ১০টা থেকে দেড় ঘণ্টার বৈঠকে রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলির নেতৃত্বে ফ্রান্স, ইতালি, সুইডেন ও জার্মানির রাষ্ট্রদূতরা অংশ নেন।

বিএনপির সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে জানতে চাইলে নিজ অবস্থান তুলে ধরে ঢাকার ইইউ ডেলিগেশন প্রধান চার্লস হোয়াইটলি বলেন, নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য ইইউর কাছে অগ্রাধিকারে রয়েছে বাংলাদেশ। আমরা নির্বাচনের আগে ১২ পর্যবেক্ষক দল পাঠিয়ে থাকি, যদি নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়। আর অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতে হলে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর ভূমিকা থাকতে হবে। এ বিষয়টি আমরা বৈঠকে জানিয়েছি।

বিএনপির উদ্বেগের বিষয়ে তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিএনপির অবস্থান সম্পর্কে সবার বিস্তারিত জানা রয়েছে। তারা তাদের অবস্থান তুলে ধরেছে। আমরা তা শুনেছি, যা আমরা সব দলের সঙ্গে বৈঠক করে কথা শুনে থাকি।

সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত বৈঠকের অংশ হিসেবে বিএনপির সঙ্গে এ বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে বিএনপি তার আগের অবস্থান তুলে ধরেছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি জানিয়েছে। তারা গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি, বিরোধীদের রাজনৈতিক স্বাধীনতাসহ আগের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছে। বৈঠকে তাদের প্রধান বিষয় ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান, যা ইইউ রাষ্ট্রদূতদের কাছে নতুন কিছু নয়।

নাম না প্রকাশের শর্তে বৈঠকে উপস্থিত এক রাষ্ট্রদূত বলেন, বিএনপি মনে করে, বর্তমান নির্বাচন প্রক্রিয়া ত্রুটিপূর্ণ ও পক্ষপাতমূলক। কারণ, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এ প্রক্রিয়ায় নির্বাচনকে ডাকাতি করে নিয়ে যাবে, যা আগে তারা করেছে। আর এমন নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে আওয়ামী লীগ আবারও বৈধতা পাবে। বৈঠকে তারা জানায়নি, কীভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরত আনবে বা সরকারকে কীভাবে এতে রাজি করাবে। এ সময় আমাদের পক্ষ থেকে সংকট নিরসনে সংলাপের আহ্বান জানানো হয়েছে বিএনপি নেতাদের। তবে আমরা কোনোভাবেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করব না।

ব্রাসেলস বাংলাদেশকে নির্বাচনী পর্যবেক্ষণে অগ্রাধিকারে রেখেছে। যার অর্থ হচ্ছে, ইতোমধ্যে বাজেট বরাদ্দ দিয়েছে ইইউ। নির্বাচনের আগে বেশ কয়েকটি নির্বাচন-পূর্ব পর্যবেক্ষক দল বাংলাদেশ সফর করবে। তাদের পর্যবেক্ষণের ওপর নির্ভর করবে নির্বাচনের দিন পর্যবেক্ষক পাঠানো হবে কিনা। যদি পরিবেশ অবাধ, মুক্ত ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের অনুকূলে না হয়, তবে পর্যবেক্ষক পাঠানো হবে না। আর প্রধান বিরোধী দল যদি নির্বাচনে অংশ না নেয়, তবে সেই নির্বাচন পর্যবেক্ষণের যৌক্তিকতা নেই।

এ নিয়ে আরেক রাষ্ট্রদূত বলেন, প্রধান বিরোধী দল যদি নির্বাচনে অংশ না নেয়, তবে যারা এতে অংশ নেবে, তাদের পক্ষেই ফলাফল যাবে। তাতে পর্যবেক্ষণ করার কিছু নেই। আর নির্বাচন পর্যবেক্ষণ না করতে পারলে এটি ভালো হয়েছে, না খারাপ হয়েছে, তা বলার অধিকার সীমিত হয়ে আসবে অংশীদারদের।

তত্ত্বাবধায়কসহ খালেদার চিকিৎসা ও মুক্তিতে জোর বিএনপির: সূত্র জানায়, বৈঠকে বিএনপি চেয়ারপারসনের চিকিৎসা ও মুক্তির বিষয়ে দলটির নেতারা ইইউকে অবহিত করে।রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে খালেদা জিয়া কারান্তরীণ আছেন বলেও জানানো হয়। এ ছাড়া নির্বাচন নিয়ে অবস্থান পরিষ্কার করে নেতারা বলেন, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে ক্ষমতাসীন দল দেশের জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে এবং প্রতারণা করে ক্ষমতায় এসেছে। আগামীতেও তারা একই ফর্মুলায় নির্বাচন করতে চাচ্ছে। তাই আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হতে পারে না। এ অবস্থায় ইইউ প্রতিনিধিরা বিএনপি নেতাদের কাছে জানতে চেয়েছেন, নির্বাচন কীভাবে নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করা যায়। এর জবাবে বিএনপি নেতারা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে হলে সংসদ বিলুপ্ত করে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং নতুন নির্বাচন কমিশনের পক্ষে জোরালো মতামত তুলে ধরেন। পাশাপাশি ক্ষমতায় গেলে বিএনপি কী করবে, সে বিষয়ে দলটির প্রস্তাবিত রাষ্ট্র মেরামতে ২৭ দফা ব্যাখ্যা করেন নেতারা। ২৭ দফার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন ইইউ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা।

বৈঠকে দেশের গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতি বিস্তারিত তুলে ধরেন বিএনপি নেতারা। তাঁরা বলেন, গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় ১০ দফা দাবিতে বিএনপির চলমান আন্দোলনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও পাল্টা কর্মসূচি দিচ্ছে। বিএনপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ হামলা করছে, এতে বহু নেতাকর্মী হতাহত হয়েছে। উল্টো বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা-গায়েবি মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।

বৈঠক শেষে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, এই সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না– সেটা খোলাখুলিভাবে বলেছি। নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে কী আলাপ হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলাদেশে নির্বাচনী ব্যবস্থাটা ভেঙে পড়েছে, এখানে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে একটা ‘অবৈধ সরকার’ ক্ষমতায় বসে আছে। আগামী নির্বাচনে দেশের মানুষ যদি ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না পারে, তাহলে বাংলাদেশ যে সংকটের দিকে যাবে– এই শঙ্কা যেমন দেশে কাজ করছে, তেমনি দেশের বাইরেও কাজ করছে। এই শঙ্কা থেকে তারা জানতে চাচ্ছে, কীভাবে আগামী নির্বাচনটা হতে যাচ্ছে, কীভাবে এটাকে নিরপেক্ষ অংশগ্রহণমূলক করা যায়। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আলোচনাটা হচ্ছে।

বিষয়গুলো নিয়ে ইইউ কী মনে করে– জানতে চাইলে আমীর খসরু বলেন, তারা কী মনে করে, সেটা তারাই বলতে পারবে।

বৈঠকে অংশগ্রহণকারী শামা ওবায়েদ বলেন, ইইউর সঙ্গে এটি একটি ধারাবাহিক বৈঠক। এর আগে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গেও তারা বৈঠক করেছে। এর পর বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে আগামী নির্বাচন নিয়ে তারা তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে।

চলতি বছরের শেষে অথবা আগামী বছরের শুরুতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন। আসছে নির্বাচনে পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইইউ। এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে আওয়ামী লীগ। সেই সঙ্গে অবাধ, স্বচ্ছ, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায় ব্রাসেলস। আর এর জন্য বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর আস্থা অর্জনে পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। আর এর আগে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দলগুলোকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে সরকার।

গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠায়নি ইইউ। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ২০১৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর এক চিঠিতে ইইউকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানোর আমন্ত্রণ জানানো হয়। তবে তাতে সাড়া দেয়নি ইইউ। কিন্তু নির্বাচনের আগে দুই সদস্যের একটি নির্বাচন বিশেষজ্ঞ দল পাঠায়, যারা নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করে ও কিছু সুপারিশ দেয়।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.