মাগুরায় হত্যা মামলার আসামিদের পরিবারের সদস্যরা বাড়িছাড়া মাসের পর মাস

0
142
একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনার জেরে মাগুরা সদর উপজেলার শ্রীরামপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আব্দুস সবুর মোল্লা ও তাঁর ছয় ভাইয়ের বসতবাড়িতে ভাঙচুর করেছে প্রতিপক্ষের লোকজন। চার মাসের বেশি সময় ধরে এসব বাড়িতে কোনো বাসিন্দা থাকেন না। ছবি সম্প্রতি তোলা

মাগুরা সদর উপজেলার শ্রীরামপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. আবদুস সবুর মোল্লা (৫২) পরিবারসহ চার মাসের বেশি সময় ধরে বাড়িছাড়া। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে শ্রীরামপুর গ্রামে প্রতিপক্ষের হামলায় স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা নিহত হওয়ার ঘটনায় আবদুস সবুর মোল্লার ছেলেকে আসামি করা হয়। এরপর তাঁর বাড়িতে ভাঙচুর চালায় প্রতিপক্ষের লোকজন। সেই থেকে পরিবার নিয়ে বাড়িছাড়া হয়ে আছেন এই শিক্ষক।

মো. আবদুস সবুর মোল্লা মুঠোফোনে বলেন, ‘আমি পার্শ্ববর্তী একটি এলাকায় ভাড়া থাকি। প্রায় ৫০ লাখ টাকা খরচ করে বাড়ি করেছিলাম। ২০ দিন আগে আমার বাড়ির ছাদ ভেঙে ফেলেছে। কিছুই নেই বাড়িতে। ভাঙচুরের অভিযোগ দিলেও প্রশাসনের কাছে কোনো সহযোগিতা পাইনি। এই জীবনে ওই রকম খরচ করে আর বাড়ি করা সম্ভব নয়।’

গত ৪ ফেব্রুয়ারি পূর্ববিরোধের জেরে প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত হন মাগুরা সদর উপজেলার হাজীপুর ইউনিয়নের শ্রীরামপুর গ্রামের বাসিন্দা জাহিদ জোয়ার্দার (৫০)। তিনি ওই ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় হওয়া মামলার ৮ নম্বর আসামি শিক্ষক আব্দুস সবুরের ছেলে এহসান মাহমুদ ওরফে সানি। একই মামলায় এই শিক্ষকের পাঁচ ভাইসহ পরিবারের মোট ১১ জন আসামি।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় আধিপত্য নিয়ে দুই পক্ষের বিরোধ আছে। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে দুটি পক্ষের লোকজনই হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন। যে সময় রাজনৈতিক শক্তি যার পক্ষে থেকেছে সে সময় প্রতিপক্ষের ওপর চড়াও হয়েছেন তাঁরা। গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সদস্যপদে ভোট নিয়ে বিরোধ আরও বাড়ে।

মো. আবদুস সবুর মোল্লার অভিযোগ, জাহিদ জোয়ার্দারের হত্যার ঘটনার পর ধাপে ধাপে তাঁদের পরিবারের ৭ ভাইয়ের মোট ২৪টি পাকা ও আধা পাকা ঘর ভাঙচুর করা হয়েছে। এখনো প্রায়ই ভাঙচুর চালানো হয়।

গত বৃহস্পতিবার শ্রীরামপুর এলাকার ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় সব ঘরের জানালা–দরজা ভেঙে ফেলা হয়েছে। ভাঙচুর হওয়া বাড়িগুলোতে কোনো বাসিন্দা নেই। দেখে অনেকটা পরিত্যক্ত বসতবাড়ি মনে হয়। ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খুনের ঘটনার জের ধরে অন্তত ১৭টি পরিবারের বসতবাড়িতে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়েছে। আরও পাঁচ থেকে সাতটি বাড়িতে আংশিক ভাঙচুর হয়েছে। এখনো প্রায় ৩০টি পরিবারের শতাধিক মানুষ গ্রাম ছেড়ে বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিয়ে আছেন। ভয়ে তাঁরা গ্রামে ফিরতে পারছেন না বলে দাবি তাঁদের।

বসতবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে থাকা এসব লোকজন হাজীপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. তাহাজ্জত হোসেনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। জাহিদ জোয়ার্দার হত্যা মামলায় তাহাজ্জতকে ১ নম্বর আসামি করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যার পরিকল্পনা ও হুকুম দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। যদিও এই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন তিনি। গত মাসের শেষ সপ্তাহে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন তিনি।

ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খুনের ঘটনার জের ধরে অন্তত ১৭টি পরিবারের বসতবাড়িতে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়েছে
ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খুনের ঘটনার জের ধরে অন্তত ১৭টি পরিবারের বসতবাড়িতে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়েছে

তাহাজ্জত হোসেন বলেন, ‘গ্রামে অনাকাঙ্ক্ষিত একটি ঘটনা ঘটে গেছে। আইন-আদালতের মাধ্যমে সেই ঘটনার সঠিক বিচার হোক। কিন্তু বাড়িছাড়া এসব মানুষ আর কত দিন এখানে-ওখানে থাকবেন? এসব মানুষ সবাই কৃষিজীবী। কয়েক মাসে কেউ ফসল ঘরে তুলতে পারেননি। এবার ফসল চাষ করতে না পারলে তো সবাই না খেয়ে মরবে।’

আওয়ামী লীগ নেতা হত্যার জেরে ১১ জুন মামলার আসামি আশরাফুল আলমের ছেলে মো. মিরাজ হোসেনের ওপর প্রতিপক্ষের লোকজন হামলা চালায় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। মিরাজ হোসেন শ্রীরামপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে চাকরি করেন। তিনি বলেন, ‘মাগরিবের নামাজের পর হাট গোপালপুর বাজার থেকে বাড়িতে ফেরার পথে লোহার পাইপ, হাতুড়ি ও লাঠি নিয়ে আমার ওপর হামলা হয়। হাতুড়ি দিয়ে পাসহ কয়েক জায়গায় আঘাত করে। এ সময় মোটরসাইকেল ফেলে দৌড় দিয়ে পালিয়ে জীবন বাঁচাই। বিষয়টি নিয়ে সদর থানায় একটি অভিযোগও দিয়েছি।’

শ্রীরামপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সম্বরণ কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘ওই হত্যাকাণ্ডের কিছু প্রভাব আমাদের স্কুলে পড়েছে। দুজন শিক্ষককে নিয়ে কিছু সমস্যা হচ্ছে। দু-একজন শিক্ষার্থীও এদিক-ওদিক আছে মনে হয়।’

পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে,  পূর্ববিরোধ ও সামাজিক আধিপত্যকে কেন্দ্র করে ৪ ফেব্রুয়ারি বিকেলে শ্রীরামপুর মাঠে ফসলের খেতে কাজ করার সময় জাহিদ জোয়ার্দারের ওপর হামলা হয়। এ সময় প্রতিপক্ষের লোকজন তাঁকে ঘিরে ধরে লোহার রড ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে পিটিয়ে ও কুপিয়ে ফেলে রেখে যায়। গুরুতর আহত জাহিদকে উদ্ধার মাগুরা সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে জাহিদকে ঢাকায় পাঠানো হয়। তবে রাত ১০টার দিকে পথেই মারা যান তিনি। ওই ঘটনায় ৬ ফেব্রুয়ারি নিহত ব্যক্তির ভাই মো. শাহিদুল ইসলাম বাদী হয়ে সদর থানায় হত্যা মামলাটি করেন।

মো. শাহিদুল ইসলাম মুঠোফোনে বলেন, ‘গত ইউপি নির্বাচনের আগে পরে এই চক্র (আসামিরা) ইউছুফ জোয়ার্দার, আখিনুর রহমান ওরফে ইকুল বাবু, নাছির হোসেন, জনি মিয়াসহ গ্রামের সাত–আটজনকে কুপিয়ে, পিটিয়ে পঙ্গু করে দিয়েছে। যারা সবাই মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এ কারণে আমার ভাই যখন খুন হলেন, গ্রামের লোকজন ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁদের বাড়িঘর ভাঙচুর করেন। এখন ভাঙচুর করা বাড়ি আবার কেন ভাঙবে?’

প্রায় ৩০টি পরিবারের শতাধিক মানুষ গ্রাম ছেড়ে বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিয়ে আছেন। ভয়ে তাঁরা গ্রামে ফিরতে পারছেন না বলে দাবি তাঁদের
প্রায় ৩০টি পরিবারের শতাধিক মানুষ গ্রাম ছেড়ে বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিয়ে আছেন। ভয়ে তাঁরা গ্রামে ফিরতে পারছেন না বলে দাবি তাঁদের

বিবদমান পক্ষের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হত্যাকাণ্ডের পর বসতবাড়িতে ভাঙচুরের অভিযোগে মাগুরা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ১১টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে সাতটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। বাকিগুলো তদন্ত চলছে।

জানতে চাইলে জাহিদ জোয়ার্দার হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মাগুরা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সৈয়দ মোশারফ হোসেন বলেন, ‘তদন্ত চলমান। আসামিরা উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন। তবে অন্যরা (আসামিদের পরিবারের সদস্যরা) বাড়িতে আছে বলেই জানি। সম্প্রতি ওই এলাকায় নতুন কোনো মারামারির কথা শুনিনি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে।’

হাজীপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মঞ্জুরুল ইসলাম মঙ্গলবার মুঠোফোনে বলেন, ওই গ্রামে দীর্ঘদিন ধরে এই ধরনের বিরোধ চলে আসছে। যার জের ধরে এই খুন হয়েছে। এটা যেমন অপরাধ, তেমনি যেসব মানুষের বসতবাড়ি ভাঙচুর হয়েছে সেটিও অপরাধ। যার কারণে অনেক নিরপরাধ মানুষকেও বাড়িছাড়া হতে হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রশাসনের নিরপেক্ষ ও শক্ত অবস্থান ছাড়া ওই গ্রামের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.