মহাসাগরে হারিয়ে যাওয়া একদল জেলের বিস্ময়কর ফেরা

0
180
মাছ ধরার ট্রলারের ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে ভারত মহাসাগরে ভাসতে থাকেন জেলেরা। একসময় একটি দ্বীপের দেখা পেয়ে ডিঙিনৌকায় চড়ে সেখানে গিয়ে আশ্রয় নেন তাঁরা ফাইল ছবি: রয়টার্স

‘নিখোঁজ’ জেলেদের পরিবারের এমন আতঙ্কিত হওয়ার বড় কারণ ২০১৭ সালের শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ‘ওখি’। সেই ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াল স্মৃতি তখনো ভুলতে পারেননি তাঁরা। ওখির ভয়াল থাবায় প্রাণ হারিয়েছিলেন কয়েক ডজন জেলে। এবারও এই জেলেরা তেমন কোনো বিপদে মুখোমুখি হয়েছেন কি না, সেটা ভাবতে থাকেন তাঁদের পরিবারের সদস্যরা। তবে জেলে পরিবারগুলোর এমন উদ্বেগ–উৎকণ্ঠার অবসান হয় ২ জানুয়ারি। এদিন নিখোঁজ জেলেরা নিজেদের বাড়িতে ফিরে এসেছেন।

বাড়ি ফেরার পর জেলেদের মুখে সমুদ্রে এত দিন থাকার কারণ জানা যায়। তাঁরা জানান, সমুদ্রযাত্রার এক সপ্তাহের মাথায় নষ্ট হয়ে যায় তাঁদের ট্রলারের ইঞ্জিন। ইঞ্জিন বিকল হয়ে যাওয়ায় অথই সাগরে ভাসতে থাকে ট্রলারটি। ভাসতে ভাসতে একসময় ভারত মহাসাগরে থাকা একটি দ্বীপের কাছে গিয়ে ভেড়ে তাঁদের ট্রলার। সেখানে কয়েক দিন থাকতে হয় তাঁদের। এর মধ্যে একদিন ব্রিটিশ একটি জাহাজ দ্বীপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। সে জাহাজ অবশেষে দ্বীপ থেকে তাঁদের উদ্ধার করে।

তবে দ্বীপ থেকে উদ্ধার হওয়ার আগে যে কয়েক দিন জেলেদের সেখানে থাকতে হয়েছিল, সে সময় সেখানে কীভাবে ছিলেন তাঁরা। জীবন বাঁচানোর জন্য জেলেরা পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নতুন নতুন বুদ্ধি বের করেন। এর মধ্যে একটি হলো দ্বীপের চারপাশে থাকা নারকেলগাছ থেকে ডাব পেড়ে তার পানি পান করা।

সমুদ্রযাত্রার এক সপ্তাহের মাথায় নষ্ট হয়ে যায় ট্রলারের ইঞ্জিন। ইঞ্জিন বিকল হয়ে যাওয়ায় অথই সাগরে ভাসতে থাকে ট্রলারটি। এভাবে পাঁচ দিন চলে যায়। একপর্যায়ে শ্রীলঙ্কান একটি মাছ ধরার ট্রলারের দেখা মেলে।

তামিলনাড়ু উপকূলে মাছ ধরার ট্রলার ভেড়ার জেটি

তামিলনাড়ু উপকূলে মাছ ধরার ট্রলার ভেড়ার জেটি, ছবি: এএনআই

নেমুস বলেন, ‘শ্রীলঙ্কান ট্রলারের লোকজন আমাদের ট্রলারটিকে টেনে নিয়ে যায়। সাগরের গভীরতা ৮ মিটার (২৬ ফুট) এমন জায়গায় গিয়ে ট্রলারটি থামে। সেখানে পৌঁছানোর পরে নিজেদের নিরাপদ মনে করি আমরা। পরে সেখানে নোঙর করা হয়।’

শ্রীলঙ্কান মাছ ধরার ট্রলার ভারতীয় জলসীমায় প্রবেশ করতে পারে না। তাই ভারতীয় মাছ ধরার ট্রলারটিকে সাহায্য চেয়ে ওয়্যারলেসে বার্তা পাঠানোর পরামর্শ দেন শ্রীলঙ্কান জেলেরা। বার্তা পেয়ে তিন দিন পর একটি ট্রলার সাড়া দেয়।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে উদ্ধারকারী ট্রলারটি নষ্ট ট্রলার টেনে নেওয়ার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল না। ট্রলারের মালিকও নষ্ট ট্রলারটিতে ছিলেন। তিনি বুদ্ধি করে ট্রলারের গিয়ার বাক্সটি মেরামতের জন্য খুলে নেন। পরে উদ্ধারকারী ট্রলারে উঠে গিয়ার বাক্সটি নিয়ে উপকূলের দিকে এগোতে থাকেন। বাকি ১৪ জন জেলে নোঙর করে ট্রলারেই অপেক্ষা করেন মালিকের ফিরে আসা পর্যন্ত।

কিন্তু ১৯ ডিসেম্বর হঠাৎ ঝোড়ো বাতাসে একটি নোঙরের রশি ছিঁড়ে যায়। তিন দিন পর ঘটে আরেক দুর্ঘটনা। দ্বিতীয় নোঙরের রশিটিও ছিঁড়ে যায় এবার। এরপর ট্রলারটি আবারও গভীর সাগরে ভাসতে শুরু করে।

নেমুস বলেন, ‘অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে মাঝসাগরে আমাদের ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। আমরা জানতামও না ট্রলারটি আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। তখন শুধু স্ত্রী ও দুই কিশোর ছেলেকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছিল।’

একপর্যায়ে ট্রলারে থাকা দিকনির্দেশক যন্ত্রের সাহায্য নেন জেলেরা। ডেভিস বলেন, ‘জিপিএসে দেখা যায়, ২৯ নটিক্যাল মাইল দূরে একটি দ্বীপ আছে।’ দ্বীপটি ছিল ভারত মহাসাগরে সলোমন দ্বীপপুঞ্জের একটি দ্বীপ।

ডেভিস জানান, এরপর ছোট্ট একটি ডিঙিনৌকায় চাল ও প্রয়োজনীয় রসদ বোঝাই করে ৯ জন জেলে দ্বীপটির উদ্দেশে যাত্রা করেন। সাতজনকে দ্বীপে নামিয়ে দিয়ে বাকি পাঁচজনকে নিতে নৌকা নিয়ে ট্রলারের দিকে যান দুই জেলে। কিন্তু ততক্ষণে ট্রলারটি অন্য জায়গায় ভেসে যায়। প্রায় এক ঘণ্টার বেশি সময় খোঁজাখুঁজির পর পাওয়া যায় ট্রলারটি।

ট্রলার পাওয়ার পর ডিঙিনৌকায় চেপে বসেন সবাই। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা সাগর বেয়ে সাত জেলে দ্বীপটিতে পৌঁছান। ডেভিস বলেন, দ্বীপটি ছিল জনমানবশূন্য। অথই সাগর থেকে ডাঙায় ফিরলেও সেখানে নতুন আরেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন তাঁরা। সঙ্গে থাকা খাবার শেষ হয়ে গেলে কীভাবে টিকে থাকবেন, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন জেলেরা। তত দিনে সঙ্গে থাকা খাবারও শেষের দিকে। তাঁদের হাতে বড়জোর ১০ দিনের খাবার ও পানীয় জল আছে।

এ অবস্থায় সাহায্যের জন্য প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার ছিল না জেলেদের। রান্নাবান্নার কাজে সাগরের পানি ব্যবহার করেন তাঁরা। কিন্তু খাওয়ার পানির প্রয়োজন হলে খুঁজে খুঁজে ডাব পেড়ে পানি পান করেন। মাঝেমধ্যে আশীর্বাদ হিসেবে নেমে আসত বৃষ্টি। মাটিতে প্লাস্টিকের শিট বিছিয়ে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করতেন জেলেরা। সেগুলো বোতলে ভরে পরবর্তী সময়ে কাজে লাগানো হতো।

সাক্ষাৎকারের একপর্যায়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন নেমুস। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হচ্ছিল, আমরা মৃত্যুর মুখোমুখি। আমরা ঠিকমতো ঘুমাতে পারছিলাম না। নিয়মিত রান্না ও খাওয়াও হচ্ছিল না। সঙ্গে থাকা রসদ যেকোনো সময় ফুরিয়ে যাবে বলে আশঙ্কায় ছিলাম। আমরা কোথায় ছিলাম, সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না। কত দিন সেখানে থাকতে হবে, সে বিষয়েও কোনো ধারণা ছিল না।’

এ অবস্থায় ৫ দিন থাকার পর ২৭ ডিসেম্বর একটি ব্রিটিশ জাহাজ চোখে পড়ে। জাহাজটি দ্বীপের কাছাকাছি দিয়ে যাচ্ছিল। জাহাজটি দেখে জেলেরা খুবই খুশি হন। বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেতে ব্রিটিশ জাহাজটির দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য একটি গাঢ় লাল কাপড় গাছের ডালে বেঁধে দেন তাঁরা।

ভারত মহাসাগরে অবস্থতি সলোমন দ্বীপপুঞ্জ

ভারত মহাসাগরে অবস্থতি সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, ছবি: এএনআই

সেই দিনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে ডেভিস বলেন, ‘জাহাজটির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সম্ভাব্য সব ধরনের চেষ্টা করি আমরা। প্রায় দুই ঘণ্টা পরে চারজন নাবিক পানি ও এক বাক্স ফল নিয়ে আমাদের কাছে আসেন। জানতে চান আমরা সুস্থ আছি কি না।’ এরপর একটি ডিঙিনৌকায় করে জাহাজে নিয়ে যাওয়া হয় জেলেদের।

জাহাজে উঠে অনেক দিন পর গোসল করেন জেলেরা। এরপর নাবিকেরা জেলেদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। পোশাক পাল্টানোর জন্য দরকারি কাপড় দেওয়ার পর জেলেদের খেতে দেওয়া হয়।

২ জানুয়ারি ভারতের দক্ষিণ উপকূলের ভিজিনজাম বন্দরে ভারতীয় উপকূলরক্ষীদের কাছে জেলেদের হস্তান্তর করেন ব্রিটিশ জাহাজের নাবিকেরা। তাঁদের পরিচয় যাচাই-বাছাই ও প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা সারতে এক দিন পার হয়ে যায়। এরপর পরিবারের সদস্যদের কাছে ফেরেন জেলেরা।

নেমুস বলেন, ‘বাড়ি পৌঁছানোর পর সন্তানেরা আমাকে জড়িয়ে ধরে। কী হয়েছিল তাঁরা জানতে চায়। আমি রূপকথার মতো সেই গল্পগুলো তাদের শোনাই। কতবার সেই গল্পগুলো বলেছি তার হিসাব নেই। দুর্গম দ্বীপে থাকার সময় আমাদের কেউ চিন্তাও করতে পারিনি যে আমরা বাড়ি ফিরতে পারব।’

অনুবাদ: মেহেদি হাসান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.