মণিপুরে রক্তক্ষয়ী হিংসা ও ভারতের বিপদ

0
114
মেইতেই সম্প্রদায় তফসিলি আদিবাসী হিসেবে সংরক্ষণ পেতে পারে কি না, তা খতিয়ে দেখতে রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন মণিপুর হাইকোর্ট। এরপরই বিক্ষোভ শুরু করেন উপজাতিরা। শুরু হয় সংঘাত-সহিংসতা

বর্তমানে উত্তর–পূর্ব ভারতের প্রতিটি রাজ্যে কোনো না কোনো সমস্যা রয়েছে। এ অবস্থায় মণিপুরসহ উত্তর–পূর্ব অশান্ত হলে ভারতের সমস্যা বাড়বে।

দক্ষিণ এশিয়ার তিন দেশ বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটান; পূর্ব এশিয়ার চীন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মিয়ানমার—এই পাঁচ দেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে উত্তর-পূর্ব ভারতের। সেখানে রয়েছে সাতটি রাজ্য। এর মধ্যে অন্যতম মণিপুর রাজ্য। এই রাজ্যে ৩ মে থেকে শুরু হওয়া সংঘাত–সহিংসতা আগামী দিনে ভারতসহ গোটা অঞ্চলের জন্য কী বার্তা দিচ্ছে, তা সামনে আসছে। এই প্রতিবেদনে মণিপুর রাজ্যের অনেকের সঙ্গে কথা বলা হলেও নিরাপত্তার কারণে তাঁদের নাম উল্লেখ করা হয়নি।

ঘটনা

মার্চ মাসে মণিপুর হাইকোর্ট এক নির্দেশে রাজ্য সরকারকে বলেছিলেন, মণিপুরের সংখ্যাগরিষ্ঠ অনুপজাতি (উপজাতিভুক্ত নয় এমন সম্প্রদায়) মেইতেই সম্প্রদায় তফসিলি আদিবাসী হিসেবে সংরক্ষণ পেতে পারে কি না, তা খতিয়ে দেখতে। নির্দেশটি হাইকোর্টের ওয়েবসাইটে ১৮ এপ্রিল প্রকাশ করার পরে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে উপজাতি সম্প্রদায়। বিক্ষোভ দিন কয়েকের মধ্যেই সহিংস আন্দোলনের রূপ নেয়। মণিপুরের রাজধানী ইম্ফলের পাশের জেলা চূড়াচাঁদপুরে ৩ মে উপজাতি ছাত্রদের একটি মিছিল বের হয়।

কিছুটা গুজবের কারণে এবং মিছিলে অস্ত্র থাকার খবরে হিংসা ছড়াতে শুরু করে ইম্ফলের আশপাশে, চূড়াচাঁদপুরে এবং সংলগ্ন অন্তত আরও চার জেলায়। এক দিনে মৃত্যু হয় অন্তত ২০ জনের। এখন পর্যন্ত সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ৭০ জনের বেশি। স্থানীয় লোকজনের ধারণা, মারা গেছেন শতাধিক মানুষ। সংঘাত শুরু হওয়ার দু–এক দিন পর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং বলেছিলেন, ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে ১ হাজার ৭০০ বাড়িঘর, সম্পত্তি। অসংখ্য আহত। কত মানুষ গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছেন বলা মুশকিল।

সেনাবাহিনী মোতায়েন করে এবং ইন্টারনেট বন্ধ করে অবস্থা সামাল দিচ্ছে রাজ্য এবং কেন্দ্র সরকার। কিন্তু পাহাড়ে এখনো গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে বলে চূড়াচাঁদপুরের বাসিন্দারা জানিয়েছেন। স্পষ্টই এই শান্তি ক্ষণস্থায়ী।

ঘটনার কারণ

এই হিংসার অন্যতম কারণ বিভিন্ন গণতন্ত্রকামী শক্তির সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ‘তাতমাদো’র লড়াই। গৃহযুদ্ধের তীব্রতা যত বেড়েছে, মিয়ানমার থেকে মণিপুরে শরণার্থীদের আসা তত বেড়েছে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে শরণার্থী আসা। রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রবেশের কারণে বছর ছয়েক আগে ভুগতে হয়েছিল বাংলাদেশকে। আর আজ সামরিক দমনমূলক শাসনের কারণে বিপদে পড়েছে ভারত। মণিপুরের সহিংসতা তারই পরিণাম।

পশ্চিম মিয়ানমারের দুটি প্রদেশ সাগাইন ও চিনের সঙ্গে মণিপুরের ৪০০ কিলোমিটারের সীমান্ত রয়েছে। ২০২১ সাল থেকে সেখানে গণতন্ত্রকামী সশস্ত্র সংগঠনের ওপর হামলা চলছে। শরণার্থীরা হাজারে হাজারে মণিপুরে এবং পাশের রাজ্য মিজোরাম ঢুকছেন।

যাঁরা ঢুকছেন, তাঁদের সঙ্গে ‘এথনিক’ বা জাতিগত সম্পর্ক রয়েছে মণিপুরের অরণ্য ও পাহাড় অঞ্চলে বসবাসকারী পাঁচটি প্রধান উপজাতির। এঁরা হলেন কুকি-চিন-মিজো-যমি-হামর, যাঁদের সার্বিকভাবে কুকি জনগোষ্ঠীর আওতাভুক্ত করা হয় খানিকটা বোঝার সুবিধার জন্যই। এঁরা ছাড়া মোটামুটি আরও ৩০টি উপজাতি রয়েছেন, প্রধানত মণিপুরের অরণ্য-পাহাড়ে। যাঁরা প্রবেশ করছেন, তাঁরা পাহাড়-অরণ্য অঞ্চলে এসে বসবাস করছেন বলে সরকারের অভিযোগ। এ কারণে ৯৬৬টি নতুন গ্রাম ২০২২ সালের মে মাস পর্যন্ত গড়ে উঠেছে। এরা সরকারি স্বীকৃতি চেয়েছে বলেও গত বছরে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে মণিপুরের সংবাদপত্র ইম্ফল ফ্রি প্রেস

এই পারস্পরিক বিশ্বাসহীনতার পরিবেশ মণিপুরে অতীতেও ছিল, সংঘাতের পরে আরও বেড়েছে। উত্তর–পূর্ব ভারতের দীর্ঘ বঞ্চনা ঔপনিবেশিক ইতিহাস এবং তার জেরে ভিন্ন রাষ্ট্রের দাবিতে সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। ছোট–বড় সব জাতিগোষ্ঠীর এখনো নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনী এবং কমবেশি আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে, যে কারণে সাম্প্রতিক সংঘাত দ্রুত ছড়িয়েছে। বর্তমানে উত্তর–পূর্ব ভারতের প্রতিটি রাজ্যে কিছু না কিছু সমস্যা রয়েছে। এ অবস্থায় মণিপুরসহ উত্তর–পূর্ব অশান্ত হলে ভারতের সমস্যা বাড়বে।

এই পরিস্থিতিতে চাপে পড়েছে রাজ্যে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার। মণিপুর এবং উত্তর–পূর্ব ভারতসহ সম্ভবত বিশ্বের আদিমতম কিন্তু আধুনিক বিতর্ক হলো কে ভূমিপুত্র আর কে বহিরাগত। এই বিতর্ককে শাণিত করে ক্ষমতায় এসেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প (২০১৬), আর ক্ষমতায় রয়েছেন নরেন্দ্র মোদি থেকে বিশ্বের অনেক নেতা। ফলে মণিপুরকে দোষ দেওয়া যায় না।

মণিপুরের প্রধান অনুপজাতি সম্প্রদায় মেইতেইরা নিজেদের ভূমিপুত্র হিসেবে দাবি করেন। এটা করতে গিয়ে তাঁরা তাঁদের রাজপরিবারের প্রাচীন নথি ‘চেইথারোল কুমপাবা’ থেকে উদ্ধৃত করে দেখান, সুসভ্য ও সুসংহত মূল নিবাসী হিসেবে প্রায় দুই হাজার বছর ধরে তাঁরা মণিপুরে রয়েছেন।

এ নিয়ে বিশেষ বিতর্ক নেই। কারণ, ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে মেইতেইদের (যাদের মধ্যে অবশ্য সবকিছুতেই প্রাণ থাকার তত্ত্বে বিশ্বাসী ‘অ্যানিমিস্ট’, খ্রিষ্টান, হিন্দু, মুসলমান, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি থেকে তপসিলি জাতির মানুষ রয়েছেন) ভূমিকা অনস্বীকার্য। মহাভারত থেকে রবীন্দ্রনাথ—সবাই মণিপুর অঞ্চলের মানুষের কথা বলেছেন।

সমস্যা অন্যত্র। মণিপুরিদের বক্তব্য, সুসভ্য জাতি হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের অস্তিত্ব বিপন্ন। তাঁরা সরকারিভাবে জনসংখ্যার ৫৩ শতাংশ হলেও বসবাস করেন প্রধানত ইম্ফল ও সংলগ্ন উপত্যকা অঞ্চলে, যার আয়তন রাজ্যের মাত্র ১০ শতাংশ। অনেকটা বাটির আদলে যদি চিন্তা করি, তাহলে দেখা যাবে, ইম্ফলের সমতল-উপত্যকায় রয়েছেন মেইতেইরা, আর উপজাতিরা রয়েছেন উঁচু পাহাড় অঞ্চল ঘিরে।

মণিপুরের সাধারণ মানুষের ভয় কাটছে না

কিন্তু মেইতেইরা পাহাড়-অরণ্য অঞ্চলে জমি কিনতে পারেন না। কারণ, তা আদিবাসী অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃত, যেখানে রয়েছেন নাগা, কুকিসহ অন্যান্য উপজাতির মানুষ। তাঁরা জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ, অথচ এই অরণ্য-পাহাড় মণিপুরের ৯০ শতাংশ এলাকাজুড়ে রয়েছে। উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ অনুপজাতিদের জন্য নির্দিষ্ট উপত্যকায় জমি কিনতে পারেন। একে পুরোপুরি ‘বৈষম্য’ বলে চিহ্নিত করছেন মেইতেইরা। তা ছাড়া মিয়ানমার থেকে শরণার্থী ঢুকতে শুরু হওয়ায় আর কয়েক প্রজন্মের মধ্যেই মেইতেইরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন, এমন আশঙ্কা অনেকেরই।

এমনকি মনেপ্রাণে বামপন্থী এবং দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক নিংথৌজারও মনে করেন, এভাবে চললে সংস্কৃতি, ভাষা, ইতিহাস—সবকিছু হারিয়ে যাবে।

এ কারণে মেইতেইরা তফসিলি উপজাতি হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়ে সংরক্ষণের সুবিধা পেতে চান। সেই আবেদনে সাড়া দিয়েই হাইকোর্ট সংরক্ষণের বিষয়টি বিবেচনা করতে বলেন।

অপর দৃষ্টিকোণ

কুকিসহ অন্যান্য উপজাতির দৃষ্টিকোণ ভিন্ন। তাঁদের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং একজন মেইতেই। তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেইদের ভোটে জিতে ক্ষমতায় এসেছেন, বিধানসভায় ৬০ সদস্যের মধ্যে ৪১ জন মেইতেই। মেইতেইরা সবদিক দিয়ে উপজাতিদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। ফলে মুখ্যমন্ত্রী মেইতেইদের স্বার্থরক্ষায় প্রবল অত্যাচার শুরু করেছেন উপজাতিদের ওপরে।

উপজাতিদের বক্তব্যের তিনটি দিক হলো:

১. সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে উপজাতিদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। উপজাতিরা প্রধানত পাহাড়ে থাকেন এবং জীবিকার জন্য অরণ্যের ওপর নির্ভরশীল। তাঁদের আশঙ্কা, উচ্ছেদের কারণে তাঁরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন।

২. গত মার্চ মাসে মণিপুর সরকার দুটি পাহাড়ভিত্তিক উপজাতীয় বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি খারিজ করে দিয়েছে। সরকারের বক্তব্য, সশস্ত্র সংগঠন মিয়ানমারের শরণার্থীদের মণিপুরে নিয়ে আসছে, পাহাড়ে বসাচ্ছে এবং অরণ্য অঞ্চল ধ্বংস করে আফিম চাষের কাজে লাগাচ্ছে। সরকারের বক্তব্য, মণিপুর (মিয়ানমার থেকে ভারতের মূল ভূখণ্ডে) মাদক পরিবহনের রাস্তা থেকে অবৈধ আফিম চাষের কেন্দ্রে রূপান্তরিত হচ্ছে। সে কারণে হাজার হাজার একর জমিতে আফিম ধ্বংস করছে মণিপুর সরকার। এ জন্য বিপাকে পড়েছেন স্থানীয় উপজাতীয় দরিদ্র যুবকেরা, যাঁরা পাহাড়ে কাজকর্মের বিশেষ সুযোগ না থাকায় আফিম চাষ করেন। তাঁরা ক্ষুব্ধ।

৩. উন্নয়ন খাতে বাজেট বরাদ্দের মাত্র ১০ শতাংশ খরচ করা হয় উপজাতি অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য। বাকিটা দেওয়া হয় মেইতেইদের। ২০১৭ থেকে ২০২০ সালের দেওয়া বাজেট বিশ্লেষণ করে এই তথ্য জানিয়েছে কুকি নাগরিক সমাজ।

ধর্মীয় বিভেদ

৩ মের ঘটনার আগে অন্তত তিনটি গির্জা অবৈধভাবে নির্মাণের অভিযোগে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। খ্রিষ্টানদের লক্ষ্যবস্তু করার জন্য উত্তর–পূর্ব ভারতে চলমান অভিযানের অংশ হিসেবে বিষয়টি পরবর্তী সময়ে তুলে ধরা হয়েছে।

উত্তর–পূর্ব ভারতে অল্পসংখ্যক ‘অ্যানিমিস্ট’ রয়েছেন। এঁদের পাশাপাশি মণিপুরে রয়েছেন বড়সংখ্যক হিন্দু (৪১%) এবং তাঁদের পাশাপাশি সমসংখ্যক খ্রিষ্টান (৪১%)। হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আরএসএস (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ) ‘অ্যানিমিস্ট’দের একাংশের মধ্যে ঢুকে তাঁদের ধর্মের সঙ্গে হিন্দুধর্মের মিলের বিষয়টি বোঝাচ্ছে। এ নিয়ে ভারতসহ গোটা বিশ্বে বিস্তর লেখালেখি হচ্ছে।

এ ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়। সম্প্রতি শিলংয়ে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের এক নেতা এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘অ্যানিমিস্টদের একাংশ খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী। এ ছাড়া উত্তর–পূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে খ্রিষ্টানদের ওপরে আক্রমণ হচ্ছে, চাপ বাড়ছে। শিলংয়েই একটি বড় জনকল্যাণকারী খ্রিষ্টান সংগঠনের কাজকর্মের তদন্ত শুরু করেছে আর্থিক অনিয়মের তদন্তকারী কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট। মনে হচ্ছে, সংখ্যালঘু হিসেবে মুসলমান সমাজের পরে আক্রমণ নামবে আমাদের ওপরে।’

বিষয়টি উপজাতি সমাজকে উত্তর–পূর্ব ভারত প্রভাবিত করছে, কারণ তাঁদের বড় অংশই খ্রিষ্টান। ফলে মণিপুরে সহিংসতা শুধুই উপজাতিদের সঙ্গে অনুপজাতিদের নয়, এই লড়াই অনুপজাতি হিন্দুদের (যাঁদের বড় অংশই মেইতেই) সঙ্গে উপজাতি খ্রিষ্টানদেরও বটে।

চূড়াচাঁদপুরে গুডউইল ফাউন্ডেশন নামে খ্রিষ্টান গির্জাগুলোর একটি সংগঠন এই প্রতিবেদককে জানিয়েছে, সহিংসতায় আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে ২৯৩টি গির্জা এবং গির্জাসংলগ্ন অফিস। এই তথ্য প্রমাণ করছে বিভেদের গভীরতা কতটা।

সামনে কী

সামনে একাধিক বিপদের আশঙ্কার কথা আলোচনায় রয়েছে। সংক্ষেপে কয়েকটির কথা বলা যাক—

১. মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ যত বাড়বে, তত বিপদে পড়বে উত্তর-পূর্ব ভারত। ভারতের হয়তো উচিত অবিলম্বে মিয়ানমারের ওপরে চাপ সৃষ্টি করা, যাতে শরণার্থী আসা বন্ধ হয়। এটা সম্ভব নয়। কারণ, অতীতে দেখা গেছে, ছোট রাষ্ট্র হলেও মিয়ানমার কারও কথাই শোনে না।

২. মেইতেইরাও প্রবল ক্ষুব্ধ। কারণ, সুপ্রিম কোর্ট মণিপুর হাইকোর্টের মার্চের নির্দেশ সম্পর্কে বলেছেন যে এই নির্দেশ ‘জঘন্য’ ও ‘ভুল’। মেইতেইরা বলছেন, তাঁদের কাশ্মীরি পণ্ডিতদের মতো ঘরছাড়া করার চক্রান্ত হচ্ছে। তাঁদের আরও দাবি, মণিপুরে আসামের ধাঁচে এনআরসি (ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেন্স) করে বিদেশি চিহ্নিত করতে হবে। সংঘাতের আগে এ দাবি মেনে বিদেশি চিহ্নিতকরণ কমিশন গঠন করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সে কারণে আরও অসন্তুষ্ট উপজাতি সমাজের মানুষ। তাঁরা ইতিহাসের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গা থেকে অন্যত্র গিয়ে বসতি গড়েছেন। তাঁদের ইতিহাস নানা কারণে ভিন্ন। ফলে এনআরসি তাঁদের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।

৩. কুকিরা খোলাখুলি অভিযোগ করেছেন যে মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংয়ের প্রশাসনে থাকতে তাঁরা ভয় পাচ্ছেন। এমনকি বিজেপির নিজের আটজন বিধায়ক (এমএলএ) সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় বসতে রাজি হননি। তাঁরা ‘পৃথক প্রশাসন’ চেয়েছেন, যা কার্যত পুরোনো পৃথক কুকিল্যান্ড রাজ্যের দাবির সমতুল্য। বস্তুত, রাজ্য বিধানসভার কুকি বিধায়কেরা উত্তর–পূর্ব ভারতের অন্য রাজ্যের উপজাতি নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন মিজোরামে গিয়ে। তাঁরা বলছেন, মণিপুরে তাঁদের নিরাপত্তা নেই।

মণিপুরের পর সিকিমের দিকে নজর যাচ্ছে সবার

এই পারস্পরিক বিশ্বাসহীনতার পরিবেশ মণিপুরে অতীতেও ছিল, সংঘাতের পরে আরও বেড়েছে। উত্তর–পূর্ব ভারতের দীর্ঘ বঞ্চনা ঔপনিবেশিক ইতিহাস এবং তার জেরে ভিন্ন রাষ্ট্রের দাবিতে সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। ছোট–বড় সব জাতিগোষ্ঠীর এখনো নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনী এবং কমবেশি আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে, যে কারণে সাম্প্রতিক সংঘাত দ্রুত ছড়িয়েছে। বর্তমানে উত্তর–পূর্ব ভারতের প্রতিটি রাজ্যে কিছু না কিছু সমস্যা রয়েছে। এ অবস্থায় মণিপুরসহ উত্তর–পূর্ব অশান্ত হলে ভারতের সমস্যা বাড়বে।

সমস্যা বাড়তে পারে বাংলাদেশেরও। কারণ, শুধু উত্তর–পূর্ব ভারতের কথা ভাবলে, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে এখানেই। মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের সীমান্তের যা দৈর্ঘ্য, উত্তর–পূর্বে তার চেয়েও বাংলাদেশ সীমান্তের দৈর্ঘ্য সামান্য বেশি। চীনের সীমান্ত বড় হলেও তা মূলত ভারতের অন্য প্রান্তে।

যেহেতু মেইতেই বা কুকি—কেউই আপাতত তাঁদের দাবি থেকে পিছু হটবে না, তাই অনেকের মতে, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো শান্তি ও সমন্বয় (পিস অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন) কমিশন প্রয়োজন মণিপুরে। বল এখন ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোর্টে।

  • শুভজিৎ বাগচী প্রথম আলোর কলকাতা সংবাদদাতা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.