ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় মণিপুর রাজ্যে গতকাল শুক্রবার থেকে নতুন করে সংঘাত শুরু হয়েছে। এর কারণ আসামঘেঁষা পশ্চিম মণিপুরের জিরিবাম জেলায় তিন সন্তানের মা এক নারীকে গত বৃহস্পতিবার রাতে ধর্ষণের পর পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। এরপর শুরু হয়েছে নতুন করে সংঘাত, যার জেরে ওই অঞ্চলে ভস্মীভূত হয়েছে অন্তত ৩০টি বাড়ি এবং অসংখ্য দোকান।
জিরিবাম জেলার পুলিশ স্থানীয় গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, ৩১ বছর বয়সী ওই নারী স্থানীয় একটি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। ওই নারীর এক ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে।
শিক্ষিকা হত্যার ঘটনায় স্বামী জিরিবাম পুলিশের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন। এতে বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার রাতে তাঁর স্ত্রীকে সম্পূর্ণ ‘সশস্ত্র মেইতেই জঙ্গিরা’ ধর্ষণের পর হত্যা করেছে।
জেলার একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, ‘অগ্নিসংযোগের ফলে ওই নারী মারা গেছেন বলে মনে করা হচ্ছে। তাঁর পোড়া মরদেহ পরিবারের জিম্মায় রয়েছে। ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহটি আসাম রাজ্যের শিলচরে পাঠানো হবে। পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া প্রয়োজন। সেই কারণেও ময়নাতদন্ত করা জরুরি।’
পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পরিস্থিতি আজ শনিবারও বেশ উত্তেজনাপূর্ণ। ঠিক কতগুলো বাড়ি এবং দোকানঘর আগুনে পুড়ে গেছে, এই মুহূর্তে তা বলা যাচ্ছে না। সহিংসতা বৃদ্ধির আশঙ্কা করে আধা সামরিক বাহিনীর সংখ্যা এই অঞ্চলে বাড়ানো হয়েছে।
স্থানীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হামর, জোমি এবং কুকি এই তিন আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীকে সম্মিলিতভাবে ‘জো’ বলে চিহ্নিত করা হয়। বৃহস্পতিবারের সহিংসতার আগে জিরিবাম জেলার পুলিশ সুপার জো সমাজের প্রতিনিধি ও মেইতেই সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি বৈঠক করানোর লক্ষ্যে অনেকটাই এগিয়েছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে এই সংঘাতের ঘটনা সেই আলোচনাকে সম্পূর্ণ ভেস্তে দিল বলে মনে করা হচ্ছে।
স্থানীয় একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, নির্দিষ্টভাবে আলোচনা ভেস্তে দেওয়ার লক্ষ্যেই এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে। জিরিবামে ১৯ অক্টোবরের পর প্রায় দুই সপ্তাহ কোনো সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি। এ কারণে মনে হচ্ছিল, আলোচনার একটা বাতাবরণ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু বৃহস্পতিবারের সংঘাতের পরে পরিস্থিতি আবার জটিল হয়ে উঠল।
২০২৩ সালের মে মাস থেকে ধারাবাহিক সংঘাতে মণিপুর রাজ্যে এ পর্যন্ত সরকারি হিসাবে প্রায় ২৫০ জন নিহত হয়েছেন। এখনো গৃহহীন অন্তত ৬০ হাজার মানুষ। কিন্তু এখনো ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মণিপুরে যাননি। এ নিয়ে নতুন করে তাঁর সমালোচনা করেছেন বিরোধীদলীয় নেতা কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী।
মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক
দিন কয়েক আগে মিজোরাম রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল জোরাম পিপলস মুভমেন্টের সভাপতি লালদুহোমার এক মন্তব্যকে কেন্দ্র করে ভারতে প্রবল বিতর্ক শুরু হয়েছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে লালদুহোমা বলেছেন, কুকি ও অনুরূপ জাতিগোষ্ঠীকে (জো জাতিগোষ্ঠী) একত্র করে একটি বৃহৎ মঞ্চ গড়ার প্রয়োজন রয়েছে। এ জন্য একটি সুসংহত ও একক নেতৃত্বের প্রয়োজন আছে বলেও তিনি যুক্তরাষ্ট্রে এক সম্মেলনে মন্তব্য করেছেন।
লালদুহোমা জো জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্গত বিভিন্ন ছোট সম্প্রদায়ের উত্তর-পূর্ব ভারত, মিয়ানমার ও বাংলাদেশে নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক আদান-প্রদান বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করার কথাও বলেছেন। তাঁর কথা থেকে স্পষ্ট, এই অঞ্চলে ওই জাতিগোষ্ঠীকে নিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের কথা তিনি বলছেন। গত বেশ কয়েক বছরে উত্তর-পূর্ব ভারতের কোনো নেতা এ ধরনের বক্তব্য দেননি।
একসময় আসামসহ উত্তর-পূর্ব ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে এই ধরনের স্বাধীন ‘হোমল্যান্ড’ বা রাষ্ট্রের দাবি থাকলেও কয়েক দশকে সেই দাবি বিশেষ সামনে আসেনি। এখন খোদ একজন মুখ্যমন্ত্রী এই দাবি তোলার পরে নড়েচড়ে বসেছে ভারত সরকার এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যান্য রাজ্যের সরকার ও জাতিগোষ্ঠীগুলোর নেতৃত্ব।