সাগরে ১৩০০ যাত্রীর দুর্বিষহ রাত

0
112
সেন্টমার্টিন রুটে বে-ওয়ান ক্রুজ জাহাজের যাত্রীরা অন্য একটি জাহাজে বুধবার ভোরে পৌঁছান কক্সবাজার ঘাটে

ফের ইঞ্জিনে ত্রুটি। ফের দুর্ভোগ। সেন্টমার্টিন রুটে চলাচল করা ‘বে-ওয়ান ক্রুজ’ জাহাজের এটা যেন সাধারণ চিত্র। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাতে ইঞ্জিনে আগুন লেগেছিল এই জাহাজে। এক হাজার পর্যটকের রাত কেটেছে সীমাহীন আতঙ্কে। সেই ইঞ্জিনে ত্রুটি দেখা দেয় মঙ্গলবারও। এবার দুর্বিষহ রাত কেটেছে ১ হাজার ৩০০ যাত্রীর। সেন্টমার্টিন থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ৫ ঘণ্টার ভ্রমণ শেষ হয়েছে ১৪ ঘণ্টায়। অন্য একটি জাহাজ গিয়ে মধ্য সাগর থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে যাত্রীদের।

জাহাজের যাত্রী এক চিকিৎসক জানান, মঙ্গলবার ভোর ৫টায় স্ত্রীকে নিয়ে কক্সবাজারের ঘাটে আসেন সেন্টমার্টিন যাওয়ার জন্য। পরদিন ভোর ৫টায় কক্সবাজার ফিরেছেন। ফেরার সময় প্রায় ১৪ ঘণ্টা কেটেছে জাহাজে। ইঞ্জিনে ত্রুটি হওয়ার খবর শুনে খুব আতঙ্কে ছিলেন। তাঁদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় পুরো পরিবার। শেষ পর্যন্ত অক্ষত অবস্থায় তীরে উঠলেও দুঃসহ স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

এত দীর্ঘ সময় জাহাজে অবস্থান করায় চরম ভোগান্তি ও কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়েছে যাত্রীদের। সবচেয়ে বেশি কষ্টে পড়ে শিশুরা। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ভুক্তভোগী যাত্রীরা। এ জন্য জাহাজ কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা আর অসহযোগিতাকে দুষছেন তাঁরা। বসার জায়গা না পাওয়ায় ১৪ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে বলেও অভিযোগ অনেকের। গত মঙ্গলবার বিকেল ৩টার দিকে সেন্টমার্টিন থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশে ছেড়ে আসা পর্যটকবাহী প্রমোদতরী বে-ওয়ান ক্রুজ রাত ৯টার দিকে গভীর সমুদ্রে আটকে যায়। জাহাজটিতে এক হাজার তিনশর বেশি পর্যটক ছিলেন বলে জানা গেছে। বুধবার ভোর ৫টার দিকে কক্সবাজার শহরের বিআইডব্লিউটিএ ঘাটে যাত্রীদের বহনকারী অপর জাহাজ বার আউলিয়া এসে পৌঁছায়।

বেশিরভাগ যাত্রীর অভিযোগ, এফভি কর্ণফুলী এক্সপ্রেস এবং এফভি বার আউলিয়ার টিকিটের টাকা নিয়ে যাত্রীদের বে-ওয়ানে ওঠানোর কারণে এমন সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। কয়েকজন যাত্রী বলেন, সব যাত্রীকে খাবার সরবরাহের কথা থাকলেও মাত্র ১৫ শতাংশ যাত্রীকে খাবার দেওয়া হয়েছে।

পরিবার নিয়ে সেন্টমার্টিন ভ্রমণে যাওয়া মোহাম্মদ বিদ্যুৎ নামের এক যাত্রী জানান, সোমবার ভোরে এফভি বার আউলিয়া জাহাজের টিকিট কেটে কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিন ভ্রমণে যান তাঁরা। এক রাত অবকাশ যাপনের পর মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে সেন্টমার্টিন থেকে কক্সবাজারগামী এফভি বে-ওয়ানে ওঠেন। সেদিন রাত ৮টার মধ্যে কক্সবাজার পৌঁছার কথা থাকলেও তা আর সম্ভব হয়নি। অতিরিক্ত যাত্রী বহন করার কারণে গভীর সমুদ্রে তিনবার জাহাজ বদল করে কর্তৃপক্ষ। এফভি বে-ওয়ান থেকে এফভি বার আউলিয়ায়, এভাবে পুরো রাত গভীর সমুদ্রে কেটে যায়।

লিটন নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, মাঝসমুদ্রে বে-ওয়ান জাহাজ থেকে বার আউলিয়া জাহাজে ওঠানোর সময় দুটি সিঁড়ি ব্যবহার করে জাহাজ কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে একটি সিঁড়ি হঠাৎ ভেঙে পড়ে। এতে তাঁর দুই সন্তান ভয়ে আঁতকে ওঠে। জাহাজ বদলের কারণে তাঁর স্ত্রী ও বড় সন্তান এক জাহাজে আর ছোট সন্তানসহ তিনি ছিলেন অন্য জাহাজে। পুরো রাত পার হয়েছে আতঙ্কে। সকালে কক্সবাজার পৌঁছালে স্বস্তি ফিরে আসে। সালাহ উদ্দিন নামের আরেক যাত্রী বলেন, ‘বে-ওয়ান ক্রুজে করে এবার সেন্টমার্টিনে গিয়ে বাজে অভিজ্ঞতা হলো। জাহাজ কর্তৃপক্ষের চরম অব্যবস্থাপনা এর জন্য দায়ী। জাহাজে এক সিট তিনজনের কাছে বিক্রি করছে টাকার লোভে। আর যাত্রীদের যে সিট ভাড়া করে সেন্টমার্টিনে যাওয়ার কথা, সেটি তো দূরের কথা, দাঁড়িয়ে থাকাও মুশকিল হয়ে পড়ে। কারণ, পুরো জাহাজে মানুষ আর মানুষ। বাড়তি টাকার লোভেই ধারণক্ষমতার কয়েক গুণ বেশি যাত্রী নেওয়া হয়েছিল জাহাজে। জাহাজের ভেতর ঠাসাঠাসিতে শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয় সবার।’

এ বিষয়ে কর্ণফুলী ক্রুজ লাইনের কর্মকর্তা আবদুল কাইয়ুম জানান, জোয়ার-ভাটাজনিত কারণে বার আউলিয়া জাহাজে করে গভীর সমুদ্র থেকে কক্সবাজার ঘাটে যাত্রীদের ফেরত আনতে সময় লেগেছে। এতে কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল না। জাহাজে পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট রাখা ছিল। তবে যাত্রীদের লাইফ জ্যাকেট সরবরাহ করার মতো পরিস্থিতি হয়নি বলেই কাউকে দেওয়া হয়নি। দেরিতে হলেও সব যাত্রী নিরাপদে ফিরেছেন। আর যাতে এমন সমস্যা না হয়, সে জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানান তিনি। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, ‘পর্যটকরা যাতে কোনো হয়রানির শিকার না হন, সে জন্য জাহাজ কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা আবার ঘটলে জাহাজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এর আগে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টার দিকে এক হাজারের মতো পর্যটক নিয়ে বে-ওয়ান ক্রুজ জাহাজ সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে চট্টগ্রাম ঘাট থেকে রওনা হয়েছিল। দুই ঘণ্টা চলতে না চলতেই জাহাজের ইঞ্জিনে আগুন ধরে যায়। আগুন ও ধোঁয়ায় পর্যটকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ওই ঘটনার সময় ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জাহাজে থাকা সবাইকে লাইফ জ্যাকেট পরানো হয়েছিল।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.