ভোটার তালিকা কীভাবে হবে তা নিয়ে অস্পষ্টতা

জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন বিল

0
99
ভোট গ্রহণ, প্রতীকী ছবি
বিলের ১৫ ধারা অনুযায়ী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে ভোটার তালিকা করার কথা বলা হয়েছে বলে মনে করছেন নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা।

নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে যথাযথ আলোচনা না করে জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিতে আইন করতে যাচ্ছে সরকার। সংসদে এ–সংক্রান্ত যে বিল (জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন বিল ২০২৩) উত্থাপন করা হয়েছে, তার দুটি ধারা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিলের ১৫ ধারা অনুযায়ী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে ভোটার তালিকা করার কথা বলা হয়েছে বলে মনে করছেন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কর্মকর্তারা। যদিও নির্বাচন কমিশন আইন অনুযায়ী, ভোটার তালিকা করার ক্ষেত্রে তারা সম্পূর্ণ স্বাধীন।

বিলটি সংসদে পাস হয়ে কার্যকর হলে ২০১০ সালের জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন (এই আইনে ইসিকে জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা–সংক্রান্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়) রহিত হবে। বিলের ৩০ ধারায় বলা হয়েছে, আগের আইন রহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের কাছে রক্ষিত এবং নির্বাচন কমিশনের সংগ্রহ করা জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি)–সংক্রান্ত সব তথ্য-উপাত্ত নিবন্ধকের কাছে হস্তান্তরিত হবে।

নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, এনআইডি সেবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্থানান্তরের বিষয়ে ইসির আপত্তি নেই। কারণ, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং ভোটার তালিকা এই দুটি পুরোপুরি আলাদা বিষয়। কিন্তু প্রস্তাবিত আইনটির দুটি ধারা নিয়ে কমিশনের আপত্তি ও অসন্তুষ্টি রয়েছে।

বিলে বলা আছে, জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার জন্য একজন ‘নিবন্ধক’ নিয়োগ দেবে সরকার। নিবন্ধকের কাছ থেকে নির্বাচন কমিশন তাদের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় তথ্য–উপাত্ত পাবে। এ জন্য নিবন্ধকের কার্যালয়ের অধীনে একটি সেল থাকবে। এই সেলে নির্বাচন কমিশনের এক বা একাধিক কর্মচারী দায়িত্ব পালন করবেন। বিলে উল্লেখ করা এই বিষয়ও স্পষ্ট নয় ইসির কাছে। কারণ, সংসদে বিল তোলার আগে নির্বাচন কমিশনারদের সঙ্গে সরকার এ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো আলোচনা করেনি।

নির্বাচন কমিশনের আইনসংক্রান্ত বিষয়াদি দেখভাল করেন নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা। তিনি বলেন, তাঁর জানামতে এই আইনের খসড়া প্রণয়ন নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে তাঁদের কোনো আলোচনা হয়নি। তিনি কয়েক দিন ধরে অসুস্থতার কারণে ছুটিতে আছেন। এর মধ্যে আলোচনা হয়েছে কি না, তা তাঁর জানা নেই। তিনি বিলটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানেন না।

নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা যদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থায় গিয়ে কাজ করেন, তাহলে কমিশনের স্বাধীনতা কতটুকু থাকবে?

ইসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ৪ সেপ্টেম্বর সংসদে যেভাবে বিলটি তোলা হয়েছে, সেভাবেই পাস হলে জটিলতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা আছে। ভোটার তালিকা এবং জাতীয় পরিচয়পত্র দুটি আলাদা বিষয় হলেও জাতীয় পরিচয়পত্রের যে তথ্যভান্ডার, সেটিই ইসির ভোটার তালিকার মূল ভিত্তি। নতুন আইন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কার্যকর করা হলে এই তথ্যভান্ডার চলে যাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘নিবন্ধকের কার্যালয়ে’। তখন এই তথ্যভান্ডারে ইসির সরাসরি কোনো আইনগত অধিকার থাকবে না। নিবন্ধকের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য–উপাত্ত নিতে হবে। এমনটি হলে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ভোটার তালিকা নিয়ে প্রশ্ন ও সন্দেহ তৈরি হতে পারে। আবার ৩০০ আসনের জন্য ছবিসহ ভোটার তালিকা মূদ্রণের কাজটি হবে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরপরই।

অবশ্য বিলে বলা হয়েছে, সরকার গেজেট প্রজ্ঞাপন দিয়ে যে তারিখ নির্ধারণ করবে, সেই তারিখ থেকে আইনটি কার্যকর হবে। অর্থাৎ আইন পাস হলে সরকার চাইলে তা জাতীয় নির্বাচনের পরেও তা কার্যকর করতে পারবে।

২০০৭ সালে ছবিসহ ভোটার তালিকা করার কাজ শুরু করে ইসি। ওই সময় থেকে ভোটার তালিকার পাশাপাশি ভোটার হওয়া নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হয়। এ জন্য আলাদা আইনও তৈরি করা হয় ২০১০ সালে। কিন্তু সরকার এ–সংক্রান্ত সেবা এখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিচ্ছে। এ লক্ষ্যে সংসদে ‘জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন বিল ২০২৩’ উত্থাপন করা হয়েছে, যা চলতি সপ্তাহে পাস হতে পারে।

নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, এনআইডি সেবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্থানান্তরের বিষয়ে ইসির আপত্তি নেই। কারণ, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং ভোটার তালিকা এই দুটি পুরোপুরি আলাদা বিষয়। কিন্তু প্রস্তাবিত আইনটির দুটি ধারা নিয়ে কমিশনের আপত্তি ও অসন্তুষ্টি রয়েছে।

ইসি–সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, কোন প্রক্রিয়ায় এই বিশাল তথ্যভান্ডার হস্তান্তরিত হবে তা নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিস্তারিত আলোচনা হয়নি। তাছাড়া সংবিধানে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে কমিশনের চারটি সুনির্দিষ্ট কাজের কথা বলা হয়েছে। এর একটি হলো রাষ্ট্রপতি পদ এবং সংসদ নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুত করা। ভোটার তালিকা আইন অনুযায়ী, ইসি এখন ভোটার নিবন্ধন ও তালিকা তৈরি করে। প্রস্তাবিত আইনে সরাসরি বলা না হলেও বিলের ১৫ ধারা অনুযায়ী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে ভোটার তালিকা করার কথা বলা হয়েছে বলে মনে করছেন ইসির কর্মকর্তারা।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের বক্তব্যেও বিষয়টি কিছুটা পরিষ্কার। ৪ সেপ্টেম্বর সংসদে বিল তোলার সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, এখন যে শিশুটি জন্মগ্রহণ করবে, জন্মের দিন থেকেই একটি পরিচয়পত্রের নম্বর তার হয়ে যাবে। ভোটার তালিকার ক্ষেত্রে এই আইন কোনো বাধা হবে না। যখন নাগরিকের বয়স ১৮ বছর হয়ে যাবে, তখনই তিনি ভোটার হয়ে গেছেন বলে নোটিশ পেয়ে যাবেন। তাঁর নাম ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।

৪ সেপ্টেম্বর সংসদে বিলটি উত্থাপনে আপত্তি জানিয়েছিলেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম। তিনি প্রশ্ন রেখেছিলেন, নির্বাচন কমিশন কীসের ভিত্তিতে নির্বাচন করবে? তালিকা যদি সরকার করে দেয়, জনগণ কি তা মানবে?

ইসির সূত্র জানায়, নির্বাচন কমিশন কি সামনের দিনগুলোতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে নেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ভোটার তালিকা করবে, নাকি ভোটার তালিকা আইন অনুযায়ী এখন যেভাবে ভোটার নিবন্ধন করা হয় সেভাবেই করবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা যদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে সংস্থায় গিয়ে কাজ করেন, তাহলে কমিশনের স্বাধীনতা কতটুকু থাকবে? নির্বাচনের আগে ইসির তথ্যভান্ডার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে গেলে ভোটার তালিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার আশঙ্কা থাকবে।

রিয়াদুল করিম

ঢাকা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.