ভোটকেন্দ্র নির্ধারণে যুক্ত হচ্ছে পুলিশ ও প্রশাসন

0
97
নির্বাচন কমিশনের (ইসি)

ভোটকেন্দ্র কোথায় কোথায় হবে—এত দিন ধরে তা নির্ধারণ করতেন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কর্মকর্তারা। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র নির্ধারণের কাজে ইসির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন প্রশাসন ও পুলিশের কর্মকর্তারা। এ জন্য নতুন করে ভোটকেন্দ্র স্থাপন নীতিমালা তৈরি করেছে ইসি।

নতুন এই নীতিমালা নিয়ে ইসির কর্মকর্তাদের অনেকের মধ্যে অসন্তোষ আছে। তাঁরা মনে করছেন, এতে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের কাজে কমিশনের কর্মকর্তাদের ক্ষমতা খর্ব হবে। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, দেশে সবার অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ নিয়ে সংশয় রয়েছে। এমন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভোটকেন্দ্র নির্ধারণের কাজে পুলিশ ও প্রশাসনকে যুক্ত করা হলে মানুষের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হতে পারে।

গতকাল বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনের বৈঠকে ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটকেন্দ্র স্থাপন এবং ব্যবস্থাপনা নীতিমালা’ অনুমোদন করা হয়। নতুন নীতিমালায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের সংখ্যাও আগের তুলনায় কমতে পারে। শিগগিরই এই নীতিমালা পরিপত্র আকারে জারি করা হবে।

পুলিশ ও প্রশাসনকে ভোটকেন্দ্র নির্ধারণের কাজে যুক্ত করলে এমন জায়গায় কেন্দ্র ঠিক হতে পারে, যাতে বিশেষ বিশেষ প্রার্থীর পক্ষে ফলাফল প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এটি যে বেড়া খেত খায়, তাকেই খেত রক্ষার দায়িত্ব দেওয়ার মতো।
বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুজন

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারফাইল

ইসি সূত্র জানায়, গত বছরের অক্টোবরে সারা দেশের সব জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপারদের (এসপি) সঙ্গে মতবিনিময় করেছিল কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন ইসি। ওই সভায় পুলিশের পক্ষ থেকে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের কাজে তাদের যুক্ত করা এবং ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা কমানোর প্রস্তাব করা হয়। তাদের যুক্তি ছিল, এটি করা হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা তুলনামূলক সহজ হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ভোটকেন্দ্রে আগের চেয়ে বেশি সংখ্যায় জনবল মোতায়েন করা যাবে। এরপর থেকে মূলত ভোটকেন্দ্র স্থাপন নীতিমালায় পরিবর্তন আনার কথা ভাবতে শুরু করে ইসি।

ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যাতায়াতের সুবিধা ও ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনা করে ভোটকেন্দ্র স্থাপন করতে হবে।

ইসির নতুন নীতিমালায় বলা হয়েছে, কোথায় কোথায় ভোটকেন্দ্র হবে, তার খসড়া তালিকা তৈরির জন্য উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) আহ্বায়ক করে একটি পাঁচ সদস্যের কমিটি থাকবে। জেলা পর্যায়ে থাকবে ডিসির নেতৃত্বে সাত সদস্যের কমিটি।

উপজেলা বা থানা পর্যায়ে ভোটকেন্দ্র স্থাপন কমিটিতে সদস্য হিসেবে থাকবেন সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা। এই কমিটির সদস্যসচিব উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা।

কমিশনের বৈঠকে ভোটকেন্দ্র স্থাপনে নতুন নীতিমালা অনুমোদন করা হয়েছে। কমিটি ভোটকেন্দ্রের খসড়া তালিকা করবে। এটি চূড়ান্ত করবেন রিটার্নিং কর্মকর্তা।
এখন যেসব স্থাপনা ভোটকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তার অনেকগুলো পুরোনো বা নষ্ট হয়ে গেছে।মো. আলমগীর, নির্বাচন কমিশনার

নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর
নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীরফাইল

আর মহানগর বা জেলায় ভোটকেন্দ্র স্থাপন কমিটিতে সদস্যসচিব জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা। সদস্য হিসেবে থাকবেন বিভাগীয় কমিশনারের প্রতিনিধি (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), পুলিশ সুপার, সংশ্লিষ্ট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের প্রতিনিধি, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা।

উপজেলা কমিটির তৈরি করা ভোটকেন্দ্রের খসড়া তালিকা মহানগর বা জেলা কমিটিতে পাঠানো হবে। এই কমিটি দৈবচয়নের ভিত্তিতে ভোটকেন্দ্র সরেজমিন তদন্ত করে মতামত দেবে। এই মতামতসহ খসড়া তালিকা নির্বাচন কমিশনে পাঠাবেন জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা।

নতুন নীতিমালায় বলা হয়েছে, শিক্ষা কর্মকর্তারা তাঁদের আওতাধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত অবস্থা, কক্ষের সংখ্যা, যাতায়াতব্যবস্থা সম্পর্কে বিশেষভাবে অবগত থাকেন। অন্যদিকে পুলিশ কর্মকর্তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য স্থাপনার যাতায়াতব্যবস্থা ও সার্বিক নিরাপত্তাব্যবস্থা সম্পর্কে অবগত থাকেন।

জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা সরকার ও নির্বাচন কমিশনের নানা কার্যক্রমে মুখ্য সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করেন। তাই সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে তাদের মতামতের ভিত্তিতে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের কাজ অধিকতর সহজ ও সুষ্ঠু হবে বলে মনে করে ইসি।

 নির্বাচন কমিশন ভবন
নির্বাচন কমিশন ভবনফাইল

নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, কমিশনের বৈঠকে ভোটকেন্দ্র স্থাপনে নতুন নীতিমালা অনুমোদন করা হয়েছে। কমিটি ভোটকেন্দ্রের খসড়া তালিকা করবে। এটি চূড়ান্ত করবেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। এখন যেসব স্থাপনা ভোটকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তার অনেকগুলো পুরোনো বা নষ্ট হয়ে গেছে। আশপাশে নতুন স্থাপনা হয়েছে। তাই এবার নতুন করে ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হবে। আগামী জাতীয় নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা কমবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইসির আগের নীতিমালায় বলা ছিল, বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেসব প্রতিষ্ঠান ভোটকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, তা নদীভাঙন বা অন্য কোনো কারণে বিলুপ্ত না হলে ভোটকেন্দ্র হিসেবে তা ব্যবহার অব্যাহত থাকবে। নতুন নীতিমালায় এই বিধানটি বাদ দেওয়া হয়েছে।

নতুন নীতিমালায় ভোটকেন্দ্র স্থাপনে কিছু বিষয় বিবেচনায় নেওয়ার কথা বলা আছে। যেগুলো আগের নীতিমালাতেও ছিল। এর মধ্যে আছে—ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যাতায়াতের সুবিধা ও ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনা করে ভোটকেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। ভোটার এলাকাগুলো যেন ভোটকেন্দ্রের সংলগ্ন ও সুনিবিড় হয় এবং দুটি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে দূরত্ব তিন কিলোমিটারের বেশি না হয় তা দেখতে হবে।

প্রার্থীর প্রভাবাধীন স্থাপনায় ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা যাবে না। যেসব ব্যক্তি রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত বা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাঁদের নামে স্থাপিত প্রতিষ্ঠানে যত দূর সম্ভব ভোটকেন্দ্র স্থাপন থেকে বিরত থাকতে হবে।

ভোটকেন্দ্র নির্ধারণের কাজে পুলিশ–প্রশাসনকে যুক্ত করায় নেতিবাচক প্রভাব দেখা যেতে পারে বলে মনে করেন সুশসানের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়কে স্বাধীন করা হয়েছে, নিজস্ব কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। যাতে এ ধরনের কাজগুলো ইসি স্বাধীনভাবে নিজেরাই করতে পারে।

কিন্তু ইসির এই নীতিমালা সন্দেহের উদ্রেক করে। কারণ, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন নির্বাচনে সরকার, পুলিশ ও প্রশাসন ছিল সুষ্ঠু ভোটের বাধা। পুলিশ ও প্রশাসনকে ভোটকেন্দ্র নির্ধারণের কাজে যুক্ত করলে এমন জায়গায় কেন্দ্র ঠিক হতে পারে, যাতে বিশেষ বিশেষ প্রার্থীর পক্ষে ফলাফল প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এটি যে বেড়া খেত খায়, তাকেই খেত রক্ষার দায়িত্ব দেওয়ার মতো।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.