মা চিকিৎসক। কোলের শিশুটির বয়স বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মা বুঝতে পারছিলেন, শিশুটির পা দুটি স্বাভাবিক না, সামান্য বাঁকা। বয়স তখন ১৮ মাস। শিশুকে নিয়ে যান রাজধানীর বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে। রক্ত পরীক্ষায় জানা গেল, শিশুটি ভিটামিন ডি স্বল্পতায় ভুগছে।
শিশুটির চিকিৎসা হয়েছিল প্রতিষ্ঠানের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগে। শিশুটিকে নিয়মিত ভিটামিন ডি খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। এখন শিশুটির বয়স ২২ মাস। ২৮ মে শিশুটির মা বলেন, শিশুটির পা ঠিক হয়ে গেছে। ওর শরীরে ভিটামিন ডির ঘাটতিও নেই।
শিশুটির চিকিৎসায় যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের প্রধান ও প্রতিষ্ঠানের সহযোগী অধ্যাপক রবি বিশ্বাস। রবি বিশ্বাস বলেন, ‘পা বাঁকা হয় রিকেট হলে। রিকেট হয় ভিটামিন ডির ঘাটতি হলে। এই হাসপাতালে বহু শিশু আসে ভিটামিন ডির স্বল্পতা নিয়ে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে এই যে শুধু শিশুদের নয়, এ দেশের ৬০ শতাংশের বেশি মানুষের ভিটামিন ডির ঘাটতি আছে। এটি একটি জাতীয় সমস্যা।’
ভিটামিন ডি একধরনের অণুপুষ্টি কণা বা মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট। এই অণুপুষ্টি কণা মানুষের সামান্য পরিমাণে দরকার হয়, কিন্তু প্রতিদিনই তা দরকার। মানুষের চাহিদার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ভিটামিন ডি আসে খাদ্য থেকে। বাকি ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশের উৎস সূর্যের আলো।
ভিটামিন ডির ঘাটতির কারণে শিশুদের রিকেট হলে হাড় নরম ও দুর্বল হয়, কঙ্কাল বিকৃত হয়। বয়স্করা ‘অস্টিওম্যালাসিয়া’ রোগে আক্রান্ত হয়, এতে হাড়ে ব্যথা হয় ও মাংসপেশি দুর্বল হয়। দীর্ঘদিন ভিটামিন ডির অভাবে ভুগলে বয়স্ক নারী-পুরুষ ‘অস্টিওপোরোসিসে’ আক্রান্ত হয়। এতে হাড় পাতলা হয়, হাড় ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। অস্টিওপোরোসিসে ভুগলে মাংসপেশি দুর্বল হয়ে, এর ফলে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। ভিটামিন ডির ঘাটতিতে থাকা মানুষ লাগাতারভাবে ব্যথায় ভুগতে থাকেন। এসব মানুষের উদ্বেগ ও বিষণ্নতা বেশি দেখা দেয়। অন্যদিকে শরীরে ক্যালসিয়াম ও ফসফেট কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হতে সহায়তা করে ভিটামিন ডি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্রে ভিটামিন ডি ব্যবহারের উপদেশ সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে দেশে ভিটামিন ডির স্বল্পতা নিয়ে নানা ধারণা প্রচলিত আছে। একটি ধারণা আছে যে, সূর্যের আলোতে যারা বেশি থাকে, তাদের ভিটামিন ডির ঘাটতি হয় না। কিন্তু গবেষণায় তা প্রমাণিত হয়নি। দেখা গেছে, শহরের মানুষের মতো গ্রামের মানুষও এর ঘাটতিতে আছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের অর্ধেক শিশু ভিটামিন ডির ঘাটতিতে ভুগছে। সূর্যের আলো বাস্তবে কতটা কাজে লাগে, কী কাজে লাগে, তা নিয়ে স্পষ্ট ধারণা অনেকেরই নেই।
পা বাঁকা হয় রিকেট হলে। রিকেট হয় ভিটামিন ডির ঘাটতি হলে। এই হাসপাতালে বহু শিশু আসে ভিটামিন ডির স্বল্পতা নিয়ে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, শুধু শিশুদের নয়, এ দেশের ৬০ শতাংশের বেশি মানুষের ভিটামিন ডির ঘাটতি আছে। এটি একটি জাতীয় সমস্যা।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের প্রধান ও প্রতিষ্ঠানের সহযোগী অধ্যাপক রবি বিশ্বাস
শিশু বয়সেই সমস্যা শুরু
চট্টগ্রাম মহানগর এলাকার একটি ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে আসা ৫২৪ জন শিশুর শরীরে ভিটামিন ডির পরিমাণ নিয়ে একটি গবেষণা করেছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের শিশুরোগ বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক প্রণব কুমার চৌধুরী। শূন্য থেকে ১৮ বছর বয়সী এসব শিশু ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই ক্লিনিকে চিকিৎসা নিয়েছে।
গবেষণার সময় শিশুদের আর্থসামাজিক তথ্য, খাওয়ানোর অভ্যাস, জীবনযাত্রা, স্কুলের বিষয় ও পরিবেশগত বৈচিত্র্যের তথ্যের পাশাপাশি ওজন পরিমাপ করা হয়। এ ছাড়া প্রতিটি শিশুর রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে রক্তে ভিটামিন ডির পরিমাণ পরিমাপ করা হয়।
রক্তের নমুনা পরীক্ষায় দেখা গেছে, ২৬৫টি শিশুর অর্থাৎ ৫০ দশমিক ৫৭ শতাংশ শিশুর ভিটামিন ডির ঘাটতি আছে। ঘাটতি অর্থ এসব শিশুর এক মিলিলিটার রক্তে ২০ ন্যানোগ্রামের কম ভিটামিন ডি পাওয়া যায়।
ভিটামিন ডির ঘাটতিতে থাকা ছেলে ও মেয়ের অনুপাত প্রায় সমানই ছিল। কিন্তু পার্থক্য দেখা গেছে গ্রাম ও শহরের শিশুদের ক্ষেত্রে। ভিটামিন ডি কম থাকা শিশু শহরে বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, শহরের ৭৯ দশমিক ৯ শতাংশ শিশুর এই ঘাটতি আছে। গ্রামে এই হার ৪৩ দশমিক ৬ শতাংশ। অন্যদিকে বয়স অনুপাতে যেসব শিশুর ওজন বেশি, তাদের ভিটামিন ডির ঘাটতিও বেশি।
সমস্যা সবার
ভিটামিন ডির ঘাটতি আছে বয়স্কদেরও। কিন্তু অনেকে জানেন না, বোঝেন না। মধ্যবয়স্ক একজন গণমাধ্যমকর্মী শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন। শরীরে ব্যথা অনুভব করেন। শরীর দুর্বল। একসময় মেপে দেখেন ওজন ১১ কেজি কমেছে। একসময় দেখেন পেশি দুর্বল হয়েছে। আয়নায় একদিন দেখেন বাহুর চামড়া ঝুলে পড়েছে।
ওই গণমাধ্যমকর্মী রাজধানীর সাধারণ হাসপাতাল থেকে নামীদামি একাধিক হাসপাতালের মেডিসিন, অস্থি ও অস্থিসন্ধিবিশেষজ্ঞসহ বেশ কয়েক ধরনের চিকিৎসককে দেখান। অবস্থার উন্নতি হয়নি। একজন চিকিৎসক মতামত দিয়েছিলেন, ওই গণমাধ্যমকর্মীর দ্রুত বার্ধক্য (আর্লি এজিং) শুরু হয়েছে। ২০১৮ সালে তিনি সিঙ্গাপুর যান। মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসা শুরু করেন। গত ২৭ মে ওই গণমাধ্যমকর্মী বলেন, ‘ঢাকায় কোনো চিকিৎসক আমাকে একবারও ভিটামিন ডি পরীক্ষার কথা বলেননি। অথবা তাঁদের সন্দেহ হয়নি যে আমি ভিটামিন ডি–স্বল্পতায় ভুগছি। কিন্তু সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকেরা প্রাথমিক কথাবার্তার পর ভিটামিন ডির স্বল্পতার বিষয়টি অনুধাবন করেছিলেন। পরীক্ষায় ধরা পড়ে যে আমি তীব্র ভিটামিন ডির ঘাটতিতে ভুগছি। আমার শুধু ভিটামিন ডির ঘাটতি পূরণের চিকিৎসা দেওয়া হয়।’
ভিটামিন ডি কম থাকা শিশু শহরে বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, শহরের ৭৯ দশমিক ৯ শতাংশ শিশুর এই ঘাটতি আছে। গ্রামে এই হার ৪৩ দশমিক ৬ শতাংশ। অন্যদিকে বয়স অনুপাতে যেসব শিশুর ওজন বেশি, তাদের ভিটামিন ডির ঘাটতিও বেশি।
ওই গণমাধ্যমকর্মী এখন পুরোপুরি সুস্থ। একাধিক গবেষণাতেও দেখা গেছে, এ দেশের বয়স্কদের বড় অংশ ভিটামিন ডির ঘাটতিতে ভুগছে।
২০১৯ সালে প্রকাশিত উপকূলের জেলা কক্সবাজারের ১৪০ জন মৎস্যজীবীর ওপর অন্য এক গবেষণায় দেখা যায়, ৭০ শতাংশ মৎস্যজীবী ভিটামিন ডির ঘাটতি আছে। মৎস্যজীবীরা সাধারণত প্রায় অনাবৃত শরীরে সূর্যের আলোতে থেকে মাছ ধরেন। এসব মৎস্যজীবী ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা সূর্যের আলোতে থেকে মাছ ধরেন। তাঁদের বয়স ছিল ১৯ থেকে ৬৫ বছরের মধ্যে। গবেষকেরা তাঁদের রক্তের নমুনা পরীক্ষা করে ভিটামিন ডির পরিমাণ নির্ণয় করেছিলেন।
বাংলাদেশে ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন ইন ডায়াবেটিস, এন্ডোক্রাইন অ্যান্ড মেটাবলিক ডিজঅর্ডারের দুজন গবেষক এবং ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজের একজন গবেষক গবেষণাটি করেছিলেন। গবেষণাটি ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আইএমসি জার্নাল অব মেডিকেল সায়েন্সে ছাপা হয়েছিল।
গবেষক ও চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে ছোট আকারে হলেও আরও কয়েকটি গবেষণায় ভিটামিন ডির ঘাটতির বিষয়টি উঠে এসেছে। কোনো গবেষণায় পরিস্থিতি আরও খারাপ পাওয়া গেছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ১০০ শতাংশ পোশাকশিল্পের কর্মী এবং ৯৭ শতাংশ কৃষি ও নির্মাণশ্রমিকের এই ঘাটতি রয়েছে। ঋতু বন্ধ হওয়া যেসব নারী কিছু সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের আছে আসেন, দেখা গেছে তাঁদের ৮২ শতাংশের ভিটামিন ডির ঘাটতি আছে।
উপকূলের জেলা কক্সবাজারের ১৪০ জন মৎস্যজীবীর ওপর অন্য এক গবেষণায় দেখা যায়, ৭০ শতাংশ মৎস্যজীবীর ভিটামিন ডির ঘাটতি আছে।
সূর্যের আলো কী করে
চট্টগ্রামের শিশুরোগবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক প্রণব কুমার চৌধুরীর গবেষণায় দেখা গেছে, সূর্যের আলো বেশি পাওয়া শিশুদের মধ্যে ভিটামিন ডির ঘাটতি কম। যেমন গ্রামের শিশুরা শহরের শিশুদের চেয়ে বেশি রোদ পায়। গ্রামের শিশুদের ভিটামিন ডির ঘাটতি থাকলেও তা শহরের শিশুদের তুলনায় কম। একইভাবে স্কুলে যাওয়া শিশুদের তুলনায় স্কুলে না যাওয়া শিশুরা বেশি রোদে থাকে। ওই গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশু স্কুলে যায় না, তাদের ভিটামিন ডির ঘাটতি তুলনামূলকভাবে কম।
সাধারণত শীতকালে মানুষ সূর্যের আলো কম পায়। শিশুদের বেলায় তা সমানভাবে সত্য। গবেষণায় দেখা গেছে, শীতকালে শিশুদের ভিটামিন ডির ঘাটতি গ্রীষ্মকালের ঘাটতির চেয়ে প্রায় দুই গুণ বেশি।
মৎস্যজীবী ও শিশুদের নিয়ে গবেষণা থেকে এটা স্পষ্ট যে সূর্যের আলোতে থাকলেই শরীরে পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি সঞ্চিত হয় না। বাংলাদেশে শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক রবি বিশ্বাস বলেন, দিনের কোন সময়ের সূর্যের আলো পেতে হবে, শরীরের কোন অংশে, কত অংশে, কমপক্ষে কত সময় ধরে তা পড়বে—এই বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ।
ভিটামিন ডির ঘাটতি আছে বয়স্কদেরও। কিন্তু অনেকে জানেন না, বোঝেন না। মধ্যবয়স্ক একজন গণমাধ্যমকর্মী শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন। শরীরে ব্যথা অনুভব করেন। শরীর দুর্বল। মেপে দেখেন ওজন ১১ কেজি কমেছে। একসময় দেখেন পেশি দুর্বল হয়েছে। আয়নায় একদিন দেখেন বাহুর চামড়া ঝুলে পড়েছে।
প্রণব কুমার চৌধুরী ও রবি বিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সকাল ৯টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত থাকা রোদ গুরুত্বপূর্ণ। এই রোদ পড়তে হবে শরীরের ১৫ থেকে ২০ শতাংশে। এর মধ্যে থাকবে মুখমণ্ডল, হাত ও পায়ের নিচের অংশ। রোদে থাকতে হবে সপ্তাহে তিন দিন ১৫ মিনিট করে।
চিকিৎসকেরা বলেছেন, ত্বকের রং রোদে কত সময় থাকতে হবে তা নির্ধারক হিসেবে কাজ করে। ত্বকের রং বাদামি হলে রোদে ৪৫ মিনিট থাকতে হবে। ত্বকের রঙের কারণে বাংলাদেশের মানুষের দৈনিক ৪৫ মিনিট রোদে থাকা উচিত।
ঝুঁকিতে কে, করণীয় কী
সাধারণভাবে দেশের সিংহভাগ মানুষ কোনো না কোনো মাত্রায় ভিটামিন ডির ঘাটতিতে আছে। তবে গর্ভবতী মা ঘাটতিতে থাকলে সন্তান ভিটামিন ডির ঘাটতি নিয়ে জন্মাবে বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন।
জন্মের পর যারা রোদ কম পায়, যেসব শিশু বা পূর্ণবয়স্ক মানুষ ঘরে আবদ্ধ থাকে, তাদের ভিটামিন ডির ঘাটতির ঝুঁকি বেশি। আবার কিছু ওষুধ আছে, যেসব ওষুধ শরীরে ভিটামিন ডির পরিমাণ কমিয়ে দেয় বা শরীরে ভিটামিন ডি মজুত হতে বাধা দেয়।
ভিটামিন ডির স্বল্পতা একধরনের জাতীয় সমস্যা। এ বিষয়ে সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, চিকিৎসকদের একটি অংশের স্বচ্ছ ধারণা নেই। এ নিয়ে জনসচেতনতা গড়ে তোলা দরকার।
অধ্যাপক প্রণব কুমার চৌধুরী বলেন, প্রসবপূর্ব সময়কাল থেকে মাকে সম্পূরক ভিটামিন ডি দেওয়ার প্রয়োজন আছে। এ ছাড়া বৈজ্ঞানিক পদক্ষেপ শিশু বয়সে ভিটামিন ডির অভাব বন্ধ করতে পারে। সবচেয়ে জরুরি ভিটামিন ডির অভাবজনিত বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা মূলক কর্মসূচি হাতে নেওয়া।
শিশির মোড়ল
ঢাকা