ভবনে বারবার আগুন তবু হুঁশ হয়নি কারও

0
131

রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় বিধ্বস্ত শিরিন ম্যানসনের তিনতলা জীর্ণ ভবনটি অন্তত ৫০ বছরের পুরোনো। বিস্ফোরণের পর ভবনটির নানামুখী ত্রুটি-বিচ্যুতি খতিয়ে দেখছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও পুলিশ। তবে এখন পর্যন্ত ভবনটির অনুমোদিত নকশাই খুঁজে পায়নি রাজউক। এমনকি শিরিন ম্যানসনের মালিকপক্ষেরও কোনো খোঁজ নেই। তবে ভবন মালিক ও সেখানকার বাসিন্দাদের দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টি সামনে এসেছে।

কয়েক মাসে একাধিকবার ওই ভবনে ছোট ছোট আগুন লাগলেও তা আমলে নেননি কেউ। কেন বারবার আগুন লাগছে, তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজনও মনে করেননি তাঁরা। ফায়ার সার্ভিস, তিতাস, ওয়াসা কিংবা পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলকে আগুন লাগার তথ্য ভবন কর্তৃপক্ষ জানায়নি। ভবনটির পশ্চিম কোণে স্যুয়ারেজের প্রধান লাইনের সঙ্গে তিনতলার টয়লেটের সংযোগ রয়েছে। সেই সংযোগস্থলে বারবার ছোট আকারে আগুন লাগলে তা নিজেরাই নিভিয়ে ফেলতেন। এখন অনেকেই বলছেন, অগ্নিকাণ্ডের ‘সতর্ক সংকেত’ আমলে নিলে প্রাণঘাতী বিস্ফোরণ থেকে হয়তো রক্ষা পাওয়া যেত।

তবে গতকাল পর্যন্ত বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনায় মামলা হয়নি। নিউমার্কেট থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ।

এদিকে বিধ্বস্ত ওই ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে।  ডিএমপির রমনা বিভাগের উপকমিশনার মো. শহীদুল্লাহ বলেন, জিডি করার পর তদন্ত শুরু হয়েছে। আলামত সংগ্রহ করছে একাধিক সংস্থা। বিশেষজ্ঞ দল বিস্ফোরণের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির বিষয়গুলো বিশদভাবে নিরূপণ করছে।

ভবনটির কেয়ারটেকার আবুল কালাম বলেন, ভবনটিতে বেশ কয়েকবার আগুন লেগেছিল। ছোট আগুন হওয়ায় কেউ পাত্তা দেয়নি; ফায়ার সার্ভিসকেও খবর দেওয়ার প্রয়োজন হতো না।

রাজউকের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা বলেন, ‘ভবনটির নকশা, নথিপত্র খুঁজে দেখা হচ্ছে। মালিকপক্ষ না পাওয়ায় ভবনসংশ্লিষ্ট কাগজপত্র এখনও আমরা পাইনি। তবে ভবনটি ৫০ বছরের পুরোনো।’
সায়েন্স ল্যাব মোড়ের একাধিক ব্যবসায়ী ও পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, সায়েন্স ল্যাব এলাকায় শিরিন ম্যানসনসহ পাশাপাশি তিনটি ভবনের মালিক তিন বোন। শিরিন ম্যানসনের মালিক শিরিন শারমিন ইংল্যান্ড প্রবাসী।

নিউমার্কেট থানার ওসি শফিকুল গনি সাবু বলেন, ভবন মালিক কর্তৃপক্ষের হদিস আমরা এখনও পাইনি। পাশাপাশি তিনটি ভবন তিন বোনের– এটা জানতে পেরেছি। বিধ্বস্ত ভবনের মালিকানা নিয়ে কোনো ঝামেলা রয়েছে– এ তথ্য পাইনি।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, সায়েন্স ল্যাব মোড়ে ওই ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনায় নাশকতার আলামত মেলেনি।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রহমত উল্লাহ চৌধুরী বলেন, এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে, জমে থাকা মিথেন গ্যাস থেকে বিস্ফোরণের সূত্রপাত। স্যুয়ারেজ লাইন বা তিতাসের লাইন থেকে মিথেন গ্যাস সেখানে জমতে পারে। নগরবাসীকে অনুরোধ করব– কোনো ঘর বা রুমে বাতাস চলাচল করতে পারে এটা নিশ্চিত করা; কোনো জায়গায় আগুনের স্পার্ক হলে তা কর্তৃপক্ষকে জানানো। এ ছাড়া নিয়মিত এসি সার্ভিসিং করা। সচেতনতা দুর্ঘটনা থেকে অনেক সময় আমাদের বাঁচাতে পারে।

ধকল সামলে খুলছে দোকানপাট: সায়েন্স ল্যাব এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বিস্ফোরণের ধকল সামলে দোকানপাট খুলতে শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা। বিস্ফোরণ-সংলগ্ন এলাকা  ঘিরে রেখেছে পুলিশ। বিস্ফোরণের পর রোববার পুরো দিন ওই এলাকার দোকানপাট বন্ধ ছিল।  গতকালও গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণে থাকায় বেচাকেনা প্রায় নেই। ভবনের আশপাশের বাসিন্দাদের মধ্যে এখনও আতঙ্ক তাড়া করছে। বিধ্বস্ত ভবনের পাশের আরেকটি ভবনের বাসিন্দা শারমীন ইমা জানান,  ঘটনার সময় দেবরের ৯ মাস বয়সের ছোট্ট ছেলেকে ঘুম পাড়াচ্ছিলেন। হঠাৎ বিকট শব্দে পুরো ভবন কাঁপছিল। দ্রুত দেবরের ছেলেকে কোলে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকি। তখনই শুনি, শ্বশুর ড্রয়িংরুমে আটকা পড়েছেন। তাঁর ঘর লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। আঘাতে তাঁর শরীরের বিভিন্ন স্থানে কেটে গেছে। পরে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। ফায়ার সার্ভিস দ্রুত না এলে আশপাশের ভবনেও আগুন ছড়িয়ে যেত।

তিনটি বিস্ফোরণের সঙ্গে মিল: পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ টিমের তথ্য বলছে, সায়েন্স ল্যাব মোড়ের ঘটনার সঙ্গে এখন পর্যন্ত তিনটি বিস্ফোরণের মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। ২০২১ সালের জুনে মগবাজার, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে  নারায়ণগঞ্জের তল্লা এলাকার মসজিদ ও ২০১৮ সালের মার্চে ভালুকায় একটি ফ্ল্যাটে ঘটা বিস্ফোরণ। জমে থাকা গ্যাস থেকে এসব প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল।

গ্যাসের লাইন নিচতলায়: ভবনে থাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তিনতলা ভবনের নিচতলার রেস্তোরাঁয় রয়েছে গ্যাস লাইন। তবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় গ্যাসের লাইন নেই। ভবনটির তত্ত্বাবধায়ক আবুল কালাম বলেন,‘ আমি ৪০ বছর এই ভবনের কেয়ারটেকারের দায়িত্বে আছি। আগে এখানে টিনশেড ছিল।’  দ্বিতীয় তলায় দ্যা বেস্ট টেইলার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক আব্দুর রশিদ জানান, তিনি ২০১৫ সালে শিরিনের কাছ থেকে দোতলার একাংশ ভাড়া নিয়েছেন। তাঁর অংশে গ্যাসের লাইন নেই।

ব্যবসায়ীদের হা-হুতাশ: বিধ্বস্ত ভবনের বিভিন্ন তলার ব্যবসায়ীরা আসেন সেখানে। ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করেন। তবে ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় পুলিশ তাঁদের বাধা দেয়। ব্যবসায়ীরা জানান, তাঁদের প্রায় কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ভবনের নিচতলায় পাঞ্জাবি ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম জানান, দোকানের ভেতর বিপুল মালপত্র রয়েছে। সেগুলো ঠিক আছে কিনা দেখার জন্য তিনি এসেছেন। সামনে ঈদ। ব্যবসা নিয়ে চিন্তিত তিনি। দ্বিতীয় তলার দ্যা বেস্ট টেইলার্সের মালিক আব্দুর রশিদ জানান, তিনি শার্ট-প্যান্ট ছাড়াও স্যুটের কাপড় বিক্রি করেন। ঈদ সামনে রেখে সম্প্রতি ৫০ লাখ টাকার কাপড় তুলেছেন। এ ছাড়া আগের রয়েছে ২৫ লাখ টাকার পণ্য। সামনে ঈদ। এরই মধ্যে বিস্ফোরণের কারণে ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হলো!

আহতরা শঙ্কামুক্ত নন: বিস্ফোরণে দগ্ধ ছয়জন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক ও সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন। তাঁদের কেউ শঙ্কামুক্ত নন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। রোববার পাঁচজনকে ভর্তি করা হয়েছিল। গতকাল ধানমন্ডির পপুলার হাসপাতাল থেকে স্বপ্না রানী সাহা নামে এক রোগীকে বার্ন ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়। তাঁর শরীরের ১৩ শতাংশ পুড়েছে। বার্ন ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ছয়জনের মধ্যে আশরাফুজ্জামানের ৬ ও হাফিজুর রহমানের শরীর ৮ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। এ ছাড়া আশার ৩৮, জহুর আলীর ৪৪ ও আকবর আলীর ৩৭ শতাংশ পুড়েছে। তাঁরা কেউ শঙ্কামুক্ত নন। বিস্ফোরণ ও ভবন ধসে আহত চারজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নুর নবীকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া অন্য ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন কবির, জাকির হোসেন জুয়েল ও অটোরিকশা চালক সোহেল। নুর নবী ও সোহেলের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক।

মেয়ের পাশে শায়িত মান্নান: ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল সোমবার দুপুরে বিস্ফোরণে নিহত তিনজনের লাশ স্বজনদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়। মারা যাওয়া সাদিকুর রহমান তুষারের লাশ নেওয়া হয় গ্রামের বাড়ি নরসিংদীতে; শফিকুজ্জামান শফিকের লাশ রাজবাড়ীর ধলদী গ্রামে; আব্দুল মান্নানের লাশ নেওয়া হয় আজিমপুর কবরস্থানে। মেয়ে মনিরা আক্তার মিনহার কবরের পাশে দাফন করা হয় মান্নানকে। ১৯ দিন আগে অসুস্থ হয়ে তাঁর ১১ বছরের মেয়ে মিনহার মৃত্যু হয়। নিজ হাতে মান্নান মেয়েকে দাফন করে এসেছিলেন। মান্নানের ভাতিজা মামুন হোসেন বলেন, মান্নানের গ্রামের বাড়ি গাজীপুরে হলেও দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা পুরান ঢাকায় বাস করছেন।

তিনটি লাশেরই সুরতহাল প্রতিবেদন করেন নিউমার্কেট থানার এসআই রমজান আলী। প্রতিবেদনে বলা হয়– তিন লাশের মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে রক্তাক্ত জখম রয়েছে। বিস্ফোরণে তাঁরা ছিটকে পড়েন এবং ধ্বংসাবশেষ শরীরের ওপর পড়ে তাঁদের মৃত্যু হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।

রোববার বিকট শব্দে কেঁপে উঠেছিল সায়েন্স ল্যাব মোড়। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে ঘটে যাওয়া এই দুর্ঘটনায় তিনজন মারা যান। আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। ঢামেক হাসপাতাল এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে এখনও ১০ জন চিকিৎসাধীন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.