‘ব্রাইট ফিউচার’-এ গিয়ে এখন ঘুরতে হচ্ছে পথে পথে

0
164
সাভারের আশুলিয়ায় জমি কিনে এই সাইনবোর্ড টাঙিয়েছিল ব্রাইট ফিউচার হোল্ডিং লিমিটেড, ছবি: সংগৃহীত

যে টাকা বিনিয়োগ করবেন, তার দ্বিগুণ অর্থ তিন বছরে ফিরিয়ে দেওয়া হবে, এমন লোভনীয় প্রচার চালিয়ে ঢাকার বহু মানুষের কাছ থেকে বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে একটি প্রতারক চক্র। এ ক্ষেত্রে তারা উত্তরায় ব্রাইট ফিউচার হোল্ডিং লিমিটেড ও বেস্ট ডেভেলপার লিমিটেড নামের দুটি প্রতিষ্ঠান চালু করেছিল। তাদের প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে অর্থ খোয়ানো ৮৭ জনের বিষয়ে জানা গেছে। এই ব্যক্তিরা ৫৭ কোটি টাকার বেশি ওই প্রতিষ্ঠানে দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন।

এ ঘটনায় গত ২৬ জুন ব্রাইট ফিউচার হোল্ডিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আকতার হোসেনসহ ৪৮ জনের বিরুদ্ধে রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মামলা করেছেন নাজমুল হুদা নামের একজন ভুক্তভোগী। তাতে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ৮৭ গ্রাহকের ৫৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। এই মামলায় গত বৃহস্পতিবার আকতার হোসেনকে এবং শুক্রবার পরিচালক ওমর ফারুককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। অন্য আসামিরা পলাতক রয়েছেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম বলেন, প্রলোভন দেখিয়ে ব্রাইট ফিউচার হোল্ডিং লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানটি বহু গ্রাহকের অর্থ আত্মসাৎ করেছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আকতারকে জিজ্ঞাসাবাদে এই প্রতারণা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে। আদালত তাঁর পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। কিন্তু তিনি অসুস্থ থাকায় এখনো রিমান্ডে আনা হয়নি। তিনি বর্তমানে কারাগারে আছেন। এই প্রতারণায় জড়িত বাকিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

যেভাবে ফেঁসেছেন গ্রাহকেরা

রাজধানীর উত্তরখানের বাসিন্দা নাজমুল হাসান গত বছরের জানুয়ারিতে এক বন্ধুর কাছ থেকে ব্রাইট ফিউচার হোল্ডিং লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানটির নাম শোনেন। উত্তরায় ওই প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়েও যান। জানতে পারেন, সেখানে এক লাখ টাকা বিনিয়োগ করলে দুই বছরে দ্বিগুণ অর্থ পাওয়া যাবে।

ব্রাইট ফিউচার হোল্ডিং লিমিটেডের এমডি আকতার হোসেন
ব্রাইট ফিউচার হোল্ডিং লিমিটেডের এমডি আকতার হোসেন, ছবি: সংগৃহীত

বেশি লাভের আশায় গত বছর মার্চে ব্রাইট ফিউচার হোল্ডিং লিমিটেডে এক লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন নাজমুল। তাঁকে বলা হয়, তিন বছরে সুদে-আসলে দ্বিগুণ অর্থ ফেরত পাবেন। এই টাকা দেওয়া হবে প্রতি মাসেই। সেখানে আসলের অংশের সঙ্গে মুনাফার টাকাও কিস্তি হিসেবে দেওয়া হবে।

কথামতো প্রথম ছয় মাস টাকা পান নাজমুল। পরের ছয় মাসের মধ্যে তিনি তাঁর মা, বোনসহ স্বজনদের কাছ থেকে নেওয়া আরও ৪৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন। এরপর কয়েক মাস কিস্তির টাকা পেলেও চলতি বছরের মার্চ থেকে কোনো টাকা পাননি তাঁরা।

গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানার কর্মকর্তা নাজমুল হাসানের মতো অনেকে ব্রাইট ফিউচার হোল্ডিং লিমিটেডের প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। ভুক্তভোগী অন্তত ১০ জন গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠান ২০১৪ সাল থেকে এভাবে মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে। প্রথম দিকে তারা সুদ-আসল মিলিয়ে অনেককে টাকা দিয়েছে। কিন্তু গত মার্চ থেকে বিনিয়োগের টাকা ও মুনাফা—কিছুই দিচ্ছে না।

‘জীবনে এত বড় ভুল করব, বুঝতে পারিনি’

এ ঘটনায় করা মামলার বাদী নাজমুল হুদা রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। পরিবার নিয়ে থাকেন দক্ষিণখানে। তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা গত বছরের মার্চে ব্রাইট ফিউচার হোল্ডিংয়ে ৩ কোটি ২৯ লাখ ৪৮ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেন। তবে তিন মাস ধরে কোনো টাকা পাচ্ছেন না। পরে প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে বুঝতে পারেন, অনেক বড় ভুল করে ফেলেছেন।

ব্রাইট ফিউচার লিমিটেড কিংবা বেস্ট ডেভেলপার লিমিটেড যদি রিহ্যাবের সদস্য হয়ে থাকে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আমরাও ব্যবস্থা নেব। গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করলে তাদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আলমগীর শামসুল আলামিন, সভাপতি রিহ্যাব

নাজমুল হুদা বলেন, ‘নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা আমি জীবনে এত বড় ভুল করে ফেলব, তা বুঝতে পারিনি। আমি ও আমার পরিবারের সদস্যদের এতগুলো টাকা বিনিয়োগ করলাম। প্রথম কিছুদিন লাভের টাকা দিল। কিন্তু এখন তো আসল টাকাও ফেরত পাচ্ছি না। আমার মতো শত শত মানুষের টাকা মেরে দিয়েছে ব্রাইট ফিউচার।’

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, মানিকগঞ্জের মামুন শেখ ব্রাইট ফিউচারে ১৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। মামুন বলেন, ‘এক বন্ধু আমাকে ব্রাইট ফিউচারের উত্তরার অফিসে নিয়ে গিয়েছিল। খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারি, ২০১৪ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি উত্তরায় অফিস পরিচালনা করে আসছে। অনেকেই বিনিয়োগ করে লভ্যাংশ পাচ্ছিলেন। সেই লোভে পড়ে ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে আমি ১৪ লাখ টাকা বিনিয়োগ করি। তারা যে আমাকে পথে বসিয়ে দেবে, তা কল্পনাও করিনি।’

তিন মাস ধরে ব্রাইট ফিউচার থেকে কোনো টাকা পাচ্ছেন না অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আল আমিনও। তিনি বলেছেন, তাঁর নিজের ও পরিচিত কয়েকজনের প্রতিষ্ঠানটিতে ২১ কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। আল আমিন বলেন, ‘২০১৭ সাল থেকে আমি ব্রাইট ফিউচারের উত্তরার অফিসে যাতায়াত করছি। আমার মতো অবসরপ্রাপ্ত অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী সেখানে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। তবে আমরা বুঝতে পারিনি তারা এত বড় প্রতারক।’

‘এরা সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র’

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উত্তরা পশ্চিম থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মিজানুর রহমান রোববার বলেছেন, গ্রাহকদের অধিক মুনাফার লোভ দেখিয়ে টাকা নিয়েছে চক্রটি। এ ছাড়া কম দামে প্লট দেওয়ার লোভও দেখিয়েছিল তারা। এ বিষয়ে লোকজনকে বোঝাতে সাভারের আশুলিয়ায় কিছু জমিও কিনেছিল।

এ বিষয়ে উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ মাসুদ আলম বলেন, ব্রাইট ফিউচার হোল্ডিং লিমিটেড মূলত এমএলএমের কায়দায় গ্রাহকদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছে। ব্যবসার আড়ালে এই আসামিরা আসলে একটি সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র। মোট কতজনের কাছ থেকে প্রতিষ্ঠান অর্থ নিয়েছে, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য ব্রাইট ফিউচার লিমিটেডের পরিচালক পারভীন আক্তারসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার মুঠোফোনে কল করে বন্ধ পাওয়া গেছে। উত্তরায় তাঁদের কার্যালয়ও বন্ধ রয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। গ্রেপ্তার হওয়া প্রতিষ্ঠানের এমডি আকতার হোসেনের পক্ষে আদালতে বলা হয়েছে, তিনি কোনো প্রতারণায় জড়িত নন। হয়রানির জন্য তাঁর এবং ব্রাইট ফিউচারের অন্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এই মামলা করা হয়েছে।

এ ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত করে দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন। তিনি রোববার বলেন, ব্রাইট ফিউচার লিমিটেড কিংবা বেস্ট ডেভেলপার লিমিটেড যদি রিহ্যাবের সদস্য হয়ে থাকে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে তাঁরাও ব্যবস্থা নেবেন। গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করলে তাদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

আবাসনপ্রতিষ্ঠান খুলে প্রতারণার মাধ্যমে গ্রাহকের অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি মানি লন্ডারিং অপরাধের মধ্যে পড়ে বলে জানিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মীর আহমেদ আলী সালাম। তিনি বলেন, এই অপরাধে জড়িত ব্রাইট ফিউচারের প্রত্যেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা করা উচিত।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.