যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সুমানা কে. রিমি সম্প্রতি ৫ হাজার ১৫৪ ডলার পাঠান তাঁর ভাইয়ের কাছে। গত ২২ মার্চ সানমান গ্লোবাল এক্সপ্রেস করপোরেশন নামে এক্সচেঞ্জ হাউসের মাধ্যমে ডলার এসেছে ঢাকা ব্যাংকে। প্রতি ডলারে ১১২ টাকা ৫০ পয়সা হারে ৫ লাখ ৭৯ হাজার ৮২৫ টাকা দিয়েছে ব্যাংক। এর সঙ্গে সরকারি প্রণোদনার আড়াই শতাংশ হারে আরও ১৪ হাজার ৪৯৫ টাকা দেওয়া হয়েছে। অথচ ব্যাংকটি বাংলাদেশ ব্যাংকে রিপোর্ট করেছে যে তারা প্রতি ডলার কিনেছে ১০৭ টাকা করে।
গত ১৬ মার্চ ন্যাশনাল ব্যাংকে একজন প্রবাসী ৯০ ডলার পাঠান যুক্তরাষ্ট্রের এনইসি মানি ট্রান্সফারের মাধ্যমে। প্রতি ডলার ১১২ টাকা হিসাবে ১০ হাজার ৮০ টাকা দেয় ব্যাংক। আড়াই শতাংশ হারে প্রণোদনা বাবদ দেওয়া হয় আরও ৩৩২ টাকা। অথচ প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে সর্বোচ্চ ১০৭ টাকা বিনিময় মূল্য দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সব ব্যাংক। কাগজে-কলমে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে তেমনই রিপোর্ট করছে। যদিও বাস্তব চিত্র ভিন্ন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, অন্তত ১২টি ব্যাংক আগ্রাসীভাবে বাড়তি দরে ডলার কিনছে। এ তালিকায় সরকারি মালিকানার দুটি ও বেসরকারি খাতের ১০টি ব্যাংকের তথ্য পেয়েছে সমকাল। বাড়তি দরে ডলার কিনে আমদানিকারকদের কাছে ১১৪ থেকে ১১৫ টাকা পর্যন্ত দরে বিক্রি করছে। এ ক্ষেত্রেও ব্যাংকগুলো ১০৭ থেকে ১০৮ টাকার বেশি দেখাচ্ছে না। বাড়তি অংশ কখনও অনানুষ্ঠানিকভাবে সরাসরি এক্সচেঞ্জ হাউসের প্রতিনিধিকে পরিশোধ করছে ব্যাংক। আবার কখনও অতিরিক্ত খরচ ‘অন্যান্য খাতের ব্যয়’ দেখানো হচ্ছে। একইভাবে আমদানিকারক থেকে বাড়তি টাকা নিয়ে তা ‘অন্যান্য খাতের আয়’ হিসেবে সমন্বয় করা হচ্ছে। এভাবে ব্যাংকের ভেতরেই ডলারের একটি কালোবাজার সৃষ্টি হয়েছে। ডলারের দরে কারসাজির বাইরে এলসি খুলতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনাপত্তি নেওয়াকে কেন্দ্র করে কোনো কোনো শাখার কর্মকর্তা আমদানিকারকদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন– এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে কয়েকটি ব্যাংক ঘোষিত দরের বেশি দিয়ে ডলার কিনতে শুরু করে। এক্সচেঞ্জ হাউসে দর বাড়ানোর ফলে অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে এখন ১১৫ থেকে ১১৭ টাকা পর্যন্ত দর মিলছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন, আগামী জুন থেকে ডলারের দর পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হবে।
ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেহমুদ হোসেন বলেন, তাঁদের ব্যাংক বাফেদা নির্ধারিত দরের বেশি দিয়ে ডলার কিনছে কিনা, তা যাচাই করে বলতে হবে। তবে মাসখানেক আগে যখন তাঁরা নির্ধারিত দরে ডলার কিনছিলেন, তখন রেমিট্যান্স পাচ্ছিলেন খুব কম।
এমনকি তাঁদের নিজস্ব মালিকানায় পরিচালিত ছয়টি এক্সচেঞ্জ হাউসেও রেমিট্যান্স ব্যাপকভাবে কমছিল।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, স্মল ওয়ার্ল্ড নামে একটি বিদেশি মানি এক্সচেঞ্জ থেকে গত ২৫ মার্চ বাংলাদেশি কয়েকটি ব্যাংক ১১৩ টাকা ৩৫ পয়সা পর্যন্ত দরে ডলার কিনেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের এক্সচেঞ্জ হাউসগুলোকে এখন ১১৩ টাকা পর্যন্ত দর দিতে হচ্ছে। গত ১৪ মার্চ দেশটির কয়েকটি এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে ব্যাংকের কাছে পাঠানো দরের কপি এ প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে। সেখানে প্রতি দিরহাম কত টাকা দিয়ে কিনতে হবে, তা উল্লেখ আছে। ওই দিন দেশটির আল-আনসারি এক্সচেঞ্জ হাউসকে প্রতি দিরহাম কিনতে হয়েছে ৩০ টাকা ৮০ পয়সায়। ই অ্যান্ড মানি ইটিসালাত মানিচেঞ্জার থেকে ৩০ টাকা ৪৫ পয়সা ও এমিরেটস এক্সচেঞ্জের ৩০ টাকা ৪০ পয়সা দরে কিনতে হয়েছে। বর্তমানে প্রতি ডলার সমান ৩ দশমিক ৬৭ দিরহাম। এর মানে দিরহামকে ডলারে বিনিময় করে টাকার সঙ্গে হিসাব করলে খরচ দাঁড়ায় ১১১ টাকা ৫৭ পয়সা থেকে ১১৩ টাকা ৩ পয়সা।
ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমরানুল হকের কাছে জানতে চাওয়া হয়, নথিপত্রে তাঁদের ব্যাংক এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে ডলার কেনার দর ১০৭ টাকা দেখালেও রেমিট্যান্সের সুবিধাভোগীকে দেওয়া হচ্ছে ১১২ থেকে ১১৩ টাকা। এ বিষয়ে তাঁর মন্তব্য কী? এমন প্রশ্ন শুনে তিনি পরে কথা বলবেন বলে জানান।
প্রবাসী আয়ের বড় অংশই বিশ্বের বিভিন্ন এক্সচেঞ্জ হাউস সংগ্রহ করে তা বাংলাদেশি ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করে। যে ব্যাংক যত বেশি দর দেয়, ওই ব্যাংকের কাছে এসব প্রতিষ্ঠান বিক্রিতে আগ্রহ দেখায় বেশি। গত বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে অনেক ব্যাংক ১১৪ টাকা পর্যন্ত দরে ডলার কিনছিল। রপ্তানি বিল ভাঙাতেও ১১২ থেকে ১১৪ টাকায় উঠে যায়। এক বছর আগে যেখানে প্রতি ডলার ছিল ৮৬ টাকা। এতে করে আমদানি খরচ আরও বেড়ে যেতে থাকে। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্থতায় গত ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ব্যাংকগুলো নিজেরাই ডলার কেনার একটি সর্বোচ্চ দর ঠিক করছে। প্রথমে রপ্তানিতে সর্বোচ্চ ৯৯ টাকা এবং রেমিট্যান্সে ১০৮ টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এর পর কয়েক ধাপে রপ্তানিতে একটু করে বাড়িয়ে গত ১ মার্চ থেকে ১০৪ টাকা ও রেমিট্যান্সে কমিয়ে ১০৭ টাকা ঠিক করা হয়েছে। আর রপ্তানি ও রেমিট্যান্স কেনার গড় দরের সঙ্গে সর্বোচ্চ ১ টাকা যোগ করে আমদানিকারকের কাছে ডলার বিক্রি করার কথা। বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাফেদা এবং প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির নেতারা বসে এ দর ঠিক করেন।
রাষ্ট্রীয় মালিকানার সোনালী ব্যাংকের এমডি ও বাফেদার চেয়ারম্যান আফজাল করিমের কাছে জানতে চাওয়া হয়– ১০৭ টাকা দর ঠিক করলেও অনেক ব্যাংক ১১৩ টাকা দরে ডলার কেনার বিষয়টি তিনি জানেন কিনা। এর উত্তরে তিনি বলেন, বাফেদা বা এবিবির আইন প্রয়োগের কোনো সুযোগ নেই। বাজারের স্বার্থে তারা বসে একটা দর ঠিক করে। এত দিন সবাই মানছিল। এখন কোনো ব্যাংক যদি না মানে, বাফেদা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানানো হয়েছে কিনা– এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় জানার সুযোগ আছে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘সোনালী ব্যাংক ১০৭ টাকা এক পয়সা বেশি দর দিচ্ছে না।
বেসরকারি একটি ব্যাংকের রেমিট্যান্স বিভাগের একজন কর্মকর্তা বাড়তি দরে রেমিট্যান্স কেনার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, দু-একটি ব্যাংক বাড়তি দর দেওয়া শুরুর পর অন্যদেরও সে পথে হাঁটতে হয়েছে। তা না হলে এক্সচেঞ্জ হাউস ডলার দিতে রাজি হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এরই মধ্যে ডলার বিক্রি কমিয়েছে। তবে বিভিন্ন কারণে ডলারের চাহিদা বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে ডলারের দর না বাড়িয়ে সংগ্রহ করা যাচ্ছে না।
অন্য একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা বলেন, সরকারি-বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংক উচ্চ দর দেওয়ায় বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউস এখন আর অন্যদের কাছে কম দামে ডলার বিক্রি করতে চাইছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিষয়টি জেনেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে চরম সংকট দেখা দেবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক বলেন, ব্যাংকগুলোই ডলারের দর ঠিক করছে। এখন তারাই যদি না মানে, তা হবে নিজেদের নীতিমালার অমান্য করা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিদর্শনের সময় বিষয়টি দেখা হবে। সেখানে দর না মানার বিষয়টি ধরা পড়লে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
১১৩ টাকায় কিনে ১০৭ টাকা দেখাচ্ছে যেভাবে : অনেক ব্যাংক ১১৩ টাকায় ডলার কিনলেও ১০৭ টাকা দেখাচ্ছে কীভাবে? ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে । এ ক্ষেত্রে মোটাদাগে তিনটি অনৈতিক পন্থার খবর পাওয়া গেছে। প্রথমত, সরাসরি ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিময় না করে তৃতীয় মুদ্রায় বিনিময় করা হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়– কোনো ব্যাংক সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ২ মিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ রেমিট্যান্স কিনল। তবে সরাসরি ডলারের সঙ্গে বিনিময় না দেখিয়ে প্রথমে ইউরোর সঙ্গে বিনিময় দেখানো হলো। এর পর ইউরো থেকে আবার ডলারে বিনিময় দেখিয়ে ব্যাংকের হিসাবে বৈদেশিক মুদ্রা জমা করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে ১১২ থেকে ১১৪ টাকায় ডলার কিনছে। সে হারে গ্রাহককে পরিশোধ করলেও কাগজে-কলমে দেখাচ্ছে ১০৭ টাকা। বাড়তি দর ব্যাংকের ‘অন্যান্য খাতের ব্যয়’ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। এর পর ওই ডলার হয়তো কোনো আমদানিকারকের কাছে ১১৫ টাকায় বিক্রি করে দেখানো হচ্ছে ১০৮ টাকা। একইভাবে বাড়তি টাকা ‘অন্যান্য খাতের আয়’ হিসেবে সমন্বয় করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে বাড়তি টাকা বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউসের বাংলাদেশি এজেন্ট কিংবা এখানে থাকা অফিসে নগদে পরিশোধ করা হচ্ছে। তৃতীয়ত, বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউসের সঙ্গে ব্যাংক ডলারের দর নিয়ে কোনো কথা না বলে সরাসরি আমদানিকারকের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছে। আমদানিকারক হয়তো প্রতি ডলারে ১১৩ টাকা দিতে রাজি হলেন। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যাংক এক্সচেঞ্জ হাউসকে ১০৭ টাকা দেখাচ্ছে। বাকি টাকা আমদানিকারক দেশেই ওই এক্সচেঞ্জ হাউসের প্রতিনিধিকে পরিশোধ করছেন।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংককে তো বেঁচে থাকতে হবে। আবার আমদানিকারককেও তো ব্যবসা করে টিকে থাকতে হবে। ফলে ১০৭ টাকায় যদি ডলার না পায়, যে কোনো দরে ডলার জোগাড় করার চেষ্টা করবে। এটাই স্বাভাবিক। ভুলটা হলো কৃত্রিমভাবে ১০৭ টাকায় ধরে রাখার চেষ্টা। কৃত্রিমভাবে দর ধরে রাখলে আবার একটা বড় চাপ তৈরি হবে। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত হলো, ডলারের দর পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নাম ভাঙিয়ে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ : মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি ঠেকাতে গত বছরের আগস্ট থেকে বড় এলসি খোলার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতে হচ্ছে। পণ্য ধরে ধরে যাচাই করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এলসিতে যে পণ্যের যে দর দেওয়া হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারদরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা, তা দেখা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ উদ্যোগকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে অনাপত্তিকে পুঁজি করে আমদানিকারকদের কাছ থেকে ঘুষের টাকা নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সব ধরনের কাগজপত্র ঠিক থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনাপত্তি নিতে টাকা লাগবে– এমন কথা বলে এই টাকা নেওয়া হচ্ছে। একজন আমদানিকারক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছন, তাঁর কাছ থেকে একজন ব্যাংক কর্মকর্তা এ বাবদ ৩ লাখ টাকা নিয়েছেন।
ওবায়দুল্লাহ রনি