২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে দেশে ব্যবসায় পরিবেশের উন্নতি হয়নি। ব্যবসা পরিচালনা সংক্রান্ত কোনো কোনো সূচকের অবনতি হয়েছে। কোনোটি স্থবির রয়েছে। তবে ব্যবসা পরিচালনার অনুকূল পরিবেশের ক্ষেত্রে গত বছর দুর্নীতিই ছিল প্রধান বাধা। দুর্নীতির কারণে বিভিন্ন সেবা পেতে বাড়তি ব্যয় গুনতে হয়। এ কারণে অভ্যন্তরীণ কিংবা রপ্তানি উভয় ধরনের পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। পণ্য ও সেবার মূল্য বা মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বেড়ে যায়। এতে সাধারণ মানুষের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক ধারণা জরিপ প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশের ব্যবসায় পরিবেশ: উদ্যোক্তা জরিপ ২০২২’ নামের এ জরিপের ফলাফল রোববার রাজধানীর ধানমন্ডিতে সিপিডি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরা হয়। এতে বক্তব্য রাখেন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন।
দেশের প্রধান ব্যবসাকেন্দ্র ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জের ৭৪ জন শিল্প উদ্যোক্তা এবং শীর্ষ কর্মকর্তাদের মতামতের ভিত্তিতে জরিপের ফলাফল নির্ধারণ করা হয়। এতে অংশ নেওয়া উদ্যোক্তাদের মধ্যে বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্র -তিন ক্যাটাগরির প্রতিনিধি রয়েছেন। গত বছরের এপ্রিল থেকে জুলাইয়ের মধ্যে জরিপটি পরিচালনা করা হয়। ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) এতে সহায়তা দিয়েছে।
জরিপের ফলাফল বলছে, আগের বছরের মতো গত বছরও দুর্নীতিকেই প্রধান বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ব্যবসায়ীরা। জরিপে অংশ নেওয়া এ ধরনের উদ্যোক্তার হার ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ। দুর্নীতির খাতভিত্তিক তথ্যের বিষয়ে বলা হয়, আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়া সেবার ক্ষেত্রে ৭৫ শতাংশ, গ্যাস-বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ পেতে ৪৯ শতাংশ, লাইসেন্স পেতে ৫৪ শতাংশ, কর প্রদানে ৪৮ শতাংশ দুর্নীতি হয়।
অবকাঠমো দুর্বলতা এবং অর্থসংকট: ব্যবসা পরিচালনায় দুর্নীতির বাইরে বড় বাধা হিসেবে অবকাঠমো দুর্বলতা এবং অর্থসংকটের কথা বলেছেন ব্যবসায়ীরা। অবকাঠামো দুর্বলতার কথা বলেছেন ৪৪ দশমিক ৬ শতাংশ। অর্থপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতার কথা বলেছেন ৪৩ দশমিক ১ শতাংশ। সম শতাংশ উত্তরদাতা সেবাদাতা সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমলাদের অদক্ষতার কথা বলেছেন। ৩৮ দশমিক ৫ উত্তরদাতা মূল্যস্ফীতি এবং বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের অস্থিরতাকে গত বছর ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে বড় বাধা বলে মত দিয়েছেন। এছাড়া সরকারের নীতির অস্থিতিশীলতা, কর ব্যবস্থার জটিলতা ও উচ্চহারের করকাঠামাকে দায়ী করেছেন যথাক্রমে ৩৫, ২৬ ও ২৫ শতাংশ উত্তরাদাতা। ৪৪ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন দেশ থেকে অর্থপাচার হয়ে যাচ্ছে। পাচার বন্ধে সরকারের উদ্যোগ যথেস্ট নয় বলে মনে করেন তারা।
সরবরাহ চেইনের সব পর্যায়ে বড় ব্যবসায়ীদের আধিপত্য: প্রতিবেদন অনুযায়ী, বড় ব্যবসায়ীরা ব্যবসা-বাণিজ্যের সব ক্ষেত্রে আধিপত্য খাটাচ্ছে। সরবরাহ চেইনের সব পর্যায়েই তাদের প্রাধান্য। পাইকারি, খুচরা সব ব্যবসা তারাই করছে। এতে ক্ষদ্র এবং মাঝারি মানের ব্যবসা উদ্যোগগুলো সংকুচিত হচ্ছে যা বৈষম্য তৈরি করছে।
সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল। খাদ্যপণ্য ও জ্বালানি বাজারের অস্থিরতায় মূল্যস্ফীতিতে সবাই হাবুডুবু খাচ্ছে। এর মধ্যে দেশে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে ব্যবসায়ীরা আরও চাপে পড়েছেন। এ কারণে মূল্যস্ফীতির চাপ কমবে না। রপ্তানির ক্ষেত্রেও প্রতিযোগী সক্ষমতা কমবে। কর্মসংস্থান ব্যাহত হবে। প্রতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো, সুশাসন ও সংস্কারের মাধ্যমে ব্যবসা পরিবেশ উন্নয়ন করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ব্যবসায়ী পরিবেশের অবনতি স্বল্পোন্নত (এলডিসি) কাতার থেকে উত্তরণের পথকে মসৃণ হতে দেবে না। বিষয়গুলো মাথায় রেখে এখনই নীতি কৌশল ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। আগামী নির্বাচনে এ বিষয়টি রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশেতহারে অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিৎ বলে মনে করেন তিনি।