ব্যথানাশক ওষুধ মরফিনের সংকট তীব্র

0
128
ব্যথানাশক ওষুধ মরফিন

মরফিন সবচেয়ে ব্যবহৃত হয় ক্যানসার রোগীদের ক্ষেত্রে। এ ছাড়া দীর্ঘস্থায়ী ব্যথায় ভোগেন, এমন রোগীদের মরফিন দেওয়া হয়

দেশে ব্যথানাশক ওষুধ মরফিন দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে। লাভ কম হওয়ায় ওষুধটি উৎপাদনে কোম্পানিগুলোর আগ্রহ কম। আইনি জটিলতার মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে ওষুধের দোকানে অনেকে তা রাখতে চান না।

বড়ি বা ট্যাবলেট, সিরাপ ও ইনজেকশন—এই তিন উপায়ে মরফিন ব্যবহৃত হয়। মরফিন সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ক্যানসার রোগীদের ক্ষেত্রে। এ ছাড়া দীর্ঘস্থায়ী ব্যথায় ভোগেন, এমন রোগীদের মরফিন দেওয়া হয়। বড় ধরনের অস্ত্রোপচার যেমন ওপেন হার্ট সার্জারির সময় ওষুধটি ব্যবহার করা হয়। এইডস রোগীদেরও মরফিন ব্যবহারের পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবের বরাত দিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, দেশে ব্যথানাশক এই ওষুধ বছরে দরকার কমপক্ষে ৬০০ কিলোগ্রাম। রোগীরা পাচ্ছেন ২৩ কিলোগ্রাম, যা প্রয়োজনের মাত্র ৪ শতাংশ। মরফিনের অভাবে বিপুলসংখ্যক রোগী যন্ত্রণা সঙ্গে নিয়ে মারা যাচ্ছেন।

উত্তরের জেলা দিনাজপুরের কাহারুল উপজেলার তারাপুর গ্রামের পঞ্চাশোর্ধ্ব অঞ্জলি বালার ক্যানসার শনাক্ত হয় ২০২১ সালে। তাঁর অস্ত্রোপচার হয়েছে। প্রথম দফায় ৮ বার এবং দ্বিতীয় দফায় ১২ বার কেমোথেরাপি নিয়েছেন। কিন্তু ক্যানসার পুরোপুরি ভালো হয়নি। চিকিৎসকের পরামর্শে মরফিন খাচ্ছিলেন। এখন সেই মরফিনও পাচ্ছেন না।

অঞ্জলি বালার দিনমজুর স্বামী ফুলেশ্বর চন্দ্র রায় ১ জানুয়ারি বলেন, ‘রোগী (অঞ্জলি) শয্যাশায়ী। যন্ত্রণায় কাতরায়। ওষুধ খেলে স্বস্তিতে থাকে। ২০ দিন আগে ওষুধ শেষ হয়েছে। ডাক্তার ওষুধ লিখে দিচ্ছে না। রোগীর অনেক কষ্ট হচ্ছে।’

ব্যথা ও মরফিন

শরীরের কোষগুচ্ছ বা টিস্যু বা কলা আঘাতপ্রাপ্ত হলে বা নষ্ট হলে মানুষ ব্যথা পান। আঘাত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ ব্যথা পান। ব্যথার সংকেত স্নায়ুকোষের মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছায়, মানুষ ব্যথা অনুভব করেন। টিস্যু যদি দীর্ঘ সময়ের জন্য নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হয়। ব্যথা এখন বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য সমস্যা।

■ দেশে বছরে মরফিন দরকার কমপক্ষে ৬০০ কিলোগ্রাম।

■ রোগীরা পাচ্ছেন ২৩ কিলোগ্রাম।

■ মরফিনের অভাবে বিপুলসংখ্যক রোগী যন্ত্রণা সঙ্গে নিয়ে মারা যাচ্ছেন।

ব্যথা নিরাময়ের অনেক ওষুধ আছে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ক্যানসারের ব্যথা উপশমের সবচেয়ে ভালো ওষুধ মরফিন। এতে মরফিনের চেয়ে মুখে খাওয়ার আর কোনো ভালো ওষুধ নেই। মরফিন শ্বাসকষ্ট দূর করার ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়। তবে উত্তেজনার কারণে মাথাব্যথা, মাইগ্রেন বা পেশি টানের সমস্যায় মরফিন কাজ করে না। মরফিনের কার্যকারিতার সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক বিষয়ের সম্পর্ক আছে।

সঠিক ব্যবহার না হলে মরফিনে আসক্তি তৈরি হওয়ার ঝুঁকি থাকে। মরফিন মাদক হিসেবে ব্যবহারের নজির আছে। এ কারণে মরফিন উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহারে বিধিনিষেধ মেনে চলতে দেখা যায়। মরফিন যেন মাদক হিসেবে ব্যবহৃত না হয়, সে জন্য আন্তর্জাতিক বিধিবিধান আছে।

দেশে মরফিনের ব্যবহার

বাংলাদেশে তিনটি কোম্পানি মরফিন উৎপাদন করে। গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালস, হেলথকেয়ার ও ইউনিমেড-ইউনিহেলথ ফার্মাসিউটিক্যালস।

সরকারি প্রতিষ্ঠান এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড (ইডিসিএল) এই তিন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মরফিন কিনে তা সরকারি হাসপাতালগুলোতে পাঠায়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মরফিন ব্যবহার করতে হলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অনুমতি নিতে হয়। অন্যদিকে অনুমতিহীন কোনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীর মরফিনের দরকার হলে ফার্মেসি থেকে কিনতে হয়। এর বাইরে ওষুধটি আমদানি করা যায় না বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন। তাঁরা বলেন, যে ওষুধ দেশে তৈরি হয়, তা আমদানি করা যায় না।

একটি দেশ বছরে কত মরফিন ব্যবহার করতে পারবে, তার পরিমাণ নির্ধারণ করে দেয় আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল নার্কোটিকস কন্ট্রোল বোর্ড (আইএনসিবি)। সংস্থাটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে কাজ করে। আর দেশে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর মরফিনের উৎপাদন ও ব্যবহারের ওপর নজরদারি করে।

অধিদপ্তরের নিরোধ শাখার উপপরিচালক মানজুরুল ইসলাম বলেন, আইএনসিবি বাংলাদেশকে বছরে ১০০ কেজি মরফিন ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছিল। চাহিদা কম থাকায় বাংলাদেশ ৭০ কেজি ব্যবহারের অনুমোদন নিয়েছে। বাংলাদেশে ৩টি প্রতিষ্ঠান ৬০ কেজি মরফিন উৎপাদন করে। বরাদ্দের আরও ১০ কেজি উৎপাদন করার মতো কোনো প্রতিষ্ঠান পাওয়া যাচ্ছে না।

মানজুরুল ইসলাম আরও বলেন, বাংলাদেশে ৪৯০টি ফার্মেসির মরফিন বিক্রির অনুমতি আছে। মরফিন ব্যবহারের অনুমতি আছে ১ হাজার ৩২২টি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের।

কিন্তু প্রয়োজনের সময় মানুষ মরফিন পান না। কেন পান না, তা নিয়ে গবেষণা করেছেন চিকিৎসকদের সংগঠন প্ল্যাটফর্ম ডক্টরস ফাউন্ডেশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও ক্যানসার বিশেষজ্ঞ মো. মোহিবুর হোসেন। তিনি গবেষণায় দেখেছেন, আর্থিক লাভ হয় না বলে দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোর মরফিন উৎপাদনে আগ্রহ কম। দ্বিতীয়ত, ওষুধের দোকানমালিক দোকানে মরফিন রাখতে চান না। হিসাব দেওয়ার জটিলতার কারণে। এই গবেষণা ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল পেইন করফারেন্সে উপস্থাপন করেন তিনি।

মো. মোহিবুর হোসেন বলেন, চিকিৎসকেরা মরফিন ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন। রোগীর মরফিন আসক্তি তৈরি হয় কি না, তা নিয়ে তাঁদের দুশ্চিন্তা থাকে। মরফিন বিষয়ে আইনকানুন কী আছে, সে বিষয়ে চিকিৎসকদের সবার ধারণা স্পষ্ট নয়।

এসব কারণে দেশে চিকিৎসায় মরফিনের ব্যবহার কম। বিশ্বের মানুষ মাথাপিছু গড়ে ৬ মিলিগ্রাম করে মরফিন ব্যবহার করেন। বাংলাদেশের মানুষ মাথাপিছু শূন্য দশমিক ৫ মিলিগ্রাম মরফিন ব্যবহার করেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে মাথাপিছু সবচেয়ে কম মরফিন ব্যবহৃত হয়। বৈশ্বিকভাবে বেশি থেকে কম মরফিন ব্যবহারের দেশগুলোর ক্রমতালিকায় বাংলাদেশ ১৬০তম।

মো. মোহিবুর হোসেন তাঁর গবেষণায় দেখেছেন, ২০২১ সালে দেশে মাত্র ২৩ কেজি মরফিন ব্যবহৃত হয়েছিল। এখনো পরিমাণ একই আছে।

অনুমতি থাকলেও ওষুধ নেই

এই প্রতিবেদক রাজধানীর ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের ফার্মেসি এবং পান্থপথের বায়োমেড ফার্মেসিতে মরফিনের বিষয়ে খোঁজ নিয়েছেন।

২ জানুয়ারি সন্ধ্যায় যোগাযোগ করা হলে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল ফার্মেসি থেকে জানানো হয়, তাদের কাছে মরফিন নেই। মজুত শেষ। একই দিনে বায়োমেড ফার্মেসি থেকে বলা হয়, মরফিন কিনতে হলে চিকিৎসকের মূল ব্যবস্থাপত্র আনতে হবে। তাতে চিকিৎসকের নাম, সিল ও স্বাক্ষর থাকতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) নিবন্ধন নম্বর আনতে হবে। মূল ব্যবস্থাপত্র রেখে দেওয়া হয়। যতবার ওষুধ কেনা হবে, ততবারই নতুন ব্যবস্থাপত্র আনতে হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মরফিন পেতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্যানসার বিভাগের প্রধান মুকিতুল হুদা বলেন, একটি ওষুধ কোম্পানির ডিপো থেকে মরফিন কিনতে হয়। তা-ও সব সময় পাওয়া যায় না। সাত-আট মাস ধরে মরফিনের সংকট চলছে।

চাই ব্যথাহীন মৃত্যু

দেশের ক্যানসার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্যানসার রোগীদের ৮০ শতাংশের মাঝারি থেকে তীব্র মাত্রায় ব্যথা থাকে। তাঁদের সংখ্যা প্রায় ছয় লাখ। ব্যথা নিয়ে থাকা অন্য রোগীও আছেন। তবে কত রোগীর মরফিনের দরকার, তার সুনির্দিষ্ট সংখ্যা কারও কাছে নেই।

অনেক মানুষ অনিরাময়যোগ্য অবস্থায় বেঁচে থাকেন যন্ত্রণা নিয়ে। মৃত্যুর আগে তাঁদের যন্ত্রণা কমানোর বিষয়টি বিশ্বব্যাপী আলোচিত হচ্ছে। এটা নিশ্চিত করার একটি উপায় হচ্ছে মরফিন সহজপ্রাপ্য করা।

বিএসএমএমইউর প্যালিয়েটিভ মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোস্তফা কামাল চৌধুরী বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মেনে নিলে শুধু ক্যানসার ও এইডস রোগীদের জন্য আমাদের বছরে ৬০০-৭০০ কেজির বেশি মরফিন দরকার। কিন্তু বছরে আমরা ব্যবহার করছি মাত্র ২৩ কেজির মতো। অর্থাৎ প্রয়োজনের মাত্র ৪ শতাংশ মরফিন আমরা ব্যবহার করছি।’

ঢাকা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.