বৈশাখ ঘিরে যে উৎসবময়তা, এর আগমনে যে আনন্দ-আয়োজন, তার বিশেষত্ব বাঙালি-জীবনে এতটাই বিস্তৃত পরিসরে প্রকাশিত যে তা শুধু দৃষ্টিগোচরের বিষয় নয়, নয়ন মুদে উপলব্ধিরও বিষয়। দিন আনি দিন খাই—এমন বহু মানুষের জীবনে নববর্ষ হয়তো উৎসবের বার্তা নিয়ে সেভাবে হাজির হয় না, তবু আনন্দ-উপাচার-উচ্ছ্বলতায় উদ্যাপনের ডালা এতটুকু অপূর্ণও থাকে না। কেননা, ধর্ম–মত–নির্বিশেষে সবাইকে বাংলা বর্ষবরণ এমন এক অচ্ছেদ্য বন্ধন ঘেরের মধ্যে দাঁড় করায়, সেই বেষ্টনীর নাম ভ্রাতৃত্ব; তার স্পন্দনে রণিত মানুষের হৃদয়। এই বন্ধন-স্পন্দনের সারকথাটি সর্বজনীনতা। এ কারণে পয়লা বৈশাখ বাংলাদেশের সবচেয়ে সেক্যুলার উৎসব, সর্বজনীন লোকাচার। যেভাবে ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ কিংবা ১৬ ডিসেম্বর সব মানুষের; ধনবান-নির্ধনের বিভাজন বা শহর-মফস্সলের ফারাক এখানে অনুপস্থিত; মত-বিশ্বাসের ভেদ এখানে বাজে মৈত্রীর ঐকতানে।
পঞ্জিকার পাতায় বাংলা বর্ষবরণের লগ্নটিকে তাই চিহ্নিত করা গেলেও বাঙালি-জীবনে তার বিস্তারকে সীমায়িত করা যায় না। করাল করোনাকালে বৈশাখী ঢোল বাজেনি বটে, কিন্তু মানুষের মনে তার ছন্দ-দুলুনি যে চিরদিনের! দুঃসময়ের সেই আয়োজনশূন্যতায় তাই বাংলা নববর্ষের তাৎপর্য বিফল হয়নি, তার আবেদনও কমেনি এতটুকু। এরই মধ্যে ‘করোনা-কুয়াশা’ কাটিয়ে প্রখর হয়েছে ‘সুসময়ের’ সূর্য; তাই বৈশাখবরণে যোগ হয়েছে আগের সেই আলো-ঝলমলতা। দুঃসময়কে পরাহত করে পেছনে ফেলে আসার স্বস্তি মানুষকে অনেক বেশি উজ্জীবিত করছে উৎসবমুখর হতে। আর প্রকৃতির অঙ্গনে তো বৈশাখের উপস্থিতি বরাবরের মতোই অবারিত।
দিনক্ষণের হিসাব ধরে বৈশাখ আসার আগেই কিন্তু তার অপার রূপ-লক্ষণ ফুটে উঠতে থাকে দশদিকে। আকাশের সুনীল শামিয়ানা, সফেদ মেঘখণ্ডের অলস ভেসে চলা, কনকরঙা রোদ্দুরের ঔজ্জল্য, আমের মুকুলের মন-মাতানো গন্ধ আর আচমকা আকাশ আড়াল করা কালবৈশাখীর আগমনে লেখা থাকে বৈশাখের বার্তা। গাঁয়ের বাঁকে বাঁকে বয়ে চলা হাঁটুজলের নদী, দূরের মেঠোপথে ধুলো উড়িয়ে গরুর গাড়ির মন্থর চলাচলও তো সাক্ষ্য দেয় বৈশাখেরই।
সংস্কৃতি বা ঐতিহ্যগত পরম্পরার ভিন্নতা, জাতিভেদ ও দেশকালের ফারাকে নববর্ষ ধরা দেয় হরেক আঙ্গিকে। তবে প্রায় সব সমাজেই, সব দেশেই নতুন বছরের শুভারম্ভের প্রাণভোমরা কিন্তু উৎসবময়তাই। বছরের প্রথম দিনটি আনন্দের, শান্তির, কল্যাণের এমনকি প্রার্থনার দিন হিসেবেও বিবেচিত কোনো কোনো জনপদে। পুরোনো বছরের ভুলভ্রান্তি থেকে, না-পাওয়া থেকে, স্বপ্নভঙ্গ থেকে, হতাশা থেকে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠার প্রত্যয়-স্পন্দিত বুকে মানুষের চাওয়া থাকে—গত দিনের না-নেতি-নেইগুলো যেন হ্যাঁ-ইতি-প্রাপ্তিতে বদলে যায় আগামী দিনে!
নববর্ষের আগমন তাই আশায় বুক বাঁধার, স্বপ্নে আবিষ্ট হওয়ার, এমনকি জীবনের গুরুতর হিসাব কষার, হিসাব মেলানোর মুহূর্ত। ফলে কালের চলনে পুরোনো বছরের বিদায়-আকাশে নতুন সূর্যের উন্মীলন শুধু নয়, বিগত বছরের খামতিকে আগামীতে পূর্ণতা দেওয়ার আকাঙ্ক্ষার নামও নববর্ষ। ঐতিহ্যগতভাবেই বাংলার জনপদে পয়লা বৈশাখের আনন্দ ও আয়োজন যেন দুই সহোদর; শুভ কামনা ও মঙ্গলময়তা তার দুই সহচর। তাই বাংলা নববর্ষের বরণডালা বরাবরই উপচে পড়ে আনন্দ-আয়োজনের প্রাচুর্যে। বৈশাখ ঘিরে নানা জনপদে বৈশাখী মেলা, লাঠি খেলা, কুস্তি, হা–ডু–ডু এমনকি ষাঁড় বা মোরগের লড়াইয়ের আয়োজন করা হয়। যদিও এসবই এখন পড়তির দিকে। একটা সময় বাংলার কৃষকেরা চৈত্র মাসের শেষ দিনে খাজনা পরিশোধ করতেন। পর দিন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখে ভূমিমালিকেরা তাদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। পরবর্তী সময়ে এই রেওয়াজ ছড়িয়ে পড়ে ব্যবসায়িক পরিমণ্ডলেও। গ্রাহকদের মিষ্টিমুখ করিয়ে ব্যবসায়ীরা শুরু করতেন নতুন বছরের সূচনা। হালখাতার এ আয়োজনেও পড়েছে ভাটার টান। এরপরও যতটুকু যা টিকে আছে, তাও দিনটিকে আলাদা করার জন্য যথেষ্ট। আর ঢাকায় রমনার বটমূলে ছায়ানটের আয়োজন আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা তো বাংলা নববর্ষের ‘ট্রেডমার্ক’ হয়ে উঠেছে। সব মিলিয়ে বাংলা নববর্ষের আয়োজন সাতরঙা, বাঙালি সংস্কৃতির আকাশে রংধনু সে।
অনেক ঘটনা-দুঘর্টনা, প্রাপ্তি-বঞ্চনা আর আনন্দ-বেদনার সাক্ষী হয়ে কালের গর্ভে তলিয়ে গেল আরও একটি বছর, এভাবেই ফিবছর মূল্যায়িত হয় বিদায়ী বছরটি। করোনাক্রান্ত বাংলা ১৪২৭ সনকে ঠিক এই গৎবাঁধা বয়ানে বিদায় জানানোর উপায় ছিল না, ১৪২৮ সনকেও একইভাবে শুভবোধে, আয়োজনের সঙ্গে বরণের পথ ছিল রুদ্ধ। কত অনাকাঙ্ক্ষিত অসময়ের মৃত্যুর সাক্ষী হয়ে থাকল দুটি বছর। তবে সেই দুঃসময় পরাস্ত হয়েছে, সতকর্তার অংশ হিসেবে ১৪২৯ সন বরণের আয়োজনও ছিল কিছুটা সীমিত; এবার সেসবের বালাই নেই।
কিন্তু কথা হলো, ব্যক্তি আমি, পারিবারিক আমি, নাগরিক আমি সত্যি কি পুরোনো ভুল থেকে শিক্ষা নিই, খামতিগুলো শুধরে নিই? সমাজ, রাষ্ট্রের কাণ্ডারিরা কি অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হয়ে সম্ভাবনার বিপুল সড়কে সতর্কভাবে পা রাখেন? সভ্যতাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরা করোনাকাল কি এই কথাটিই এলান করেনি, ভুলের পুনরাবৃত্তি আর নয়! প্রকৃতির বুকের ছাতি গুঁড়িয়ে সভ্যতার সৌধ নির্মাণের চেয়ে আত্মঘাতী আর কিছু হতে পারে না! নগদ লাভের গুড়ের স্বাদ মিঠা বটে, কিন্তু দিন শেষে তা স্বাস্থ্যের জন্য হানিকর।
জীবন কোনোভাবেই সরলপথ নয়, তা সে ব্যক্তিক, সামাজিক বা রাষ্ট্রিক হোক; তার বহু বাঁক, বহু উচ্চাবচ, বহু চড়াই-উতরাই।
জীবনের যাত্রাপথে পূর্ণতা আর শূন্যতা চলে পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে, সমানতালে বাজে তার মন্দিরার সুর-বেসুর। কিন্তু জীবন তো সংকটে-অভিঘাতে ভেঙে না পড়ার দীক্ষাস্থল, বৈরী সময়ের সঙ্গে যুঝাযুঝির মঞ্চ, পিছিয়ে পড়েও এগিয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তাই মানুষের মনে সদাজাগ্রত। এর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ দেখা মেলে মেহনতি মানুষের জীবনযাপনের ভেতর, সংগ্রামের মধ্যে। নুনে-ভাতে পেট ভরাতেই ২৪ ঘণ্টার বেশিটাই চলে যায় তাঁদের শ্রমে-ঘামে, তবু তাঁদের জীবন শুধু ‘জীবিকানির্ভর’ নয়। হররোজ কর্মক্লান্ত গতরে ঘুমে নেতিয়ে পড়ার আগে এবং ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে নিশ্চিত তাঁরা সুন্দর–সবল আগামীর ছবিই দেখেন! উৎসব তাদের ‘সাদা-কালো’ জীবনকেও ছোঁয় ‘রঙিন’ আবীরে। সেই উৎসবের নাম বৈশাখবরণ, যে উৎসব মনে জোগায় সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন-সাহস-সঞ্জীবনী।
হাসান ইমাম