দেশের সবচেয়ে বড় সিটি করপোরেশন গাজীপুরে ভোটারসংখ্যা প্রায় ১১ লাখ সাড়ে ৭৯ হাজার। কাল বৃহস্পতিবার এই সিটিতে প্রথমবারের মতো ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ হবে। ভোটারসংখ্যা এবং ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণে ধীরগতির কারণে ভোগান্তির আশঙ্কা করছেন নির্বাচন–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ভোটারদের কাছে ইভিএমকে পরিচিত করে তুলতে নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগ পর্যাপ্ত ছিল না বলে ভোটারদের অভিযোগ।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৪৮০টি ভোটকেন্দ্রের ৩ হাজার ৪৯৭টি কক্ষে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট গ্রহণ প্রসঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, পেশাজীবী প্রতিনিধি ও সাধারণ ভোটারের সঙ্গে কথা বলে প্রথম আলো। তাঁদের মতে, গাজীপুরের মানুষের ইভিএমে ভোট দেওয়া নিয়ে অস্বস্তি রয়েছে। অনেক প্রার্থী ও ভোটার ইভিএম সম্পর্কে অবগত নন। ভোটার উপস্থিতি ভালো হলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ভোট গ্রহণ শেষ করা যাবে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
প্রার্থীদের মধ্যেই ইভিএমে ভোট নিয়ে সংশয় আছে। গাজীপুর সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খানের চেয়ে অন্য প্রার্থীদের ইভিএম নিয়ে শঙ্কা বেশি।
আজমত উল্লা খান বলেন, ইভিএম নিয়ে মানুষের মধ্যে কিছুটা নেতিবাচক ধারণা আছে। আবার তরুণ ভোটারদের মধ্যে ইভিএমে ভোট দেওয়া নিয়ে আগ্রহও রয়েছে। ইসি প্রার্থীদের খুব কম সময় দিয়েছে। এ কারণে ভোটারদের সচেতন করতে সময় পাওয়া গেছে কম। ইভিএমে দেরি হলেও ভোটাররা যদি নির্ধারিত সময়ে কেন্দ্রে আসেন, তাহলে ভোট দিতেই পারবেন।
সিটি নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনের প্রাধান নির্বাচনী সমন্বয়কারী ও সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গাজীপুর সিটি এলাকার ভোটাররা ইভিএমে ভোট দেওয়ার মতো সচেতন নন। কোন বাটনে কীভাবে চাপ দিতে হবে, তাঁদের ধারণা নেই। ইভিএম নিয়ে সবার মধ্যে নেতিবাচক ধারণা আছে। আমরা কাল দেখব, ইভিএমে আসলেই ভোট সুষ্ঠু হচ্ছে কি না।
এ নির্বাচনে বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলনের মেয়রপ্রার্থী গাজী আতাউর রহমান বলেন, ইভিএমে বয়স্ক লোকদের হাতের ছাপ মিলতে চায় না। কিছু নির্বাচনে দেখা গেছে, ভোটারের হাতের ছাপ নেওয়ার পর গোপন কক্ষে অন্যজন ভোট দিয়ে দেন। এসব কারণেই ইভিএম নিয়ে শঙ্কা।
ইভিএমে ভোট গ্রহণ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে ৬টি আসনে ইভিএমে ভোট করতে গিয়ে কমিশনের লেজেগোবরে অবস্থা হয়েছিল। ইসি বেশ কয়টি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ইভিএমের মাধ্যমে নির্বাচন করার পরও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি, যার সর্বশেষ উদাহরণ রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এর আগে বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারে ভোগান্তি হলেও রংপুরে তা সব ‘রেকর্ড’ ছাড়িয়ে যায়।
রংপুর সিটি করপোরেশনের ভোটার ৪ লাখ সাড়ে ২৬ হাজার। পাঁচ মাস আগে ইভিএমে এই সিটিতে ভোট গ্রহণ হয়। ভোট গ্রহণের শেষ সময় ছিল বিকেল সাড়ে চারটা। সাড়ে চারটার পরও রংপুরের অন্তত ৩০টি ভোটকেন্দ্রে ভোটাররা ভোট দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী সাড়ে চারটার মধ্যে কেউ ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হলে তিনি ভোট দিতে পারেন। ইভিএমের ধীরগতির কারণে ভোটারদের রাত আটটার পরও ভোট দিতে হয়। অনেকের আঙুলের ছাপ না মেলায় দীর্ঘ সময় লাগে ভোট গ্রহণে।
রংপুরের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি ভোটার গাজীপুর সিটি করপোরেশনে। এ কারণে ইভিএমে ভোট হওয়া নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে। ইভিএম নিয়ে গাজীপুরে প্রচারও কম হয়েছে। ভোটারদের মধ্যে ইভিএম নিয়ে আগ্রহের চেয়ে শঙ্কাই বেশি। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের অন্তত ২০ জন ভোটারের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
নগরীর ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আসিফ মোস্তফা বলেন, ‘এর আগে তো কখনো ইভিএমে ভোট দিইনি। ইভিএম নিয়ে কোনো প্রচার-প্রচারণাও চোখে পড়েনি। অন্য নির্বাচনে দেখেছি ইভিএমের বাটনে অন্য কেউ চাপ দিয়ে দেয়। ভোটকেন্দ্রে গিয়ে কী পরিস্থিতি হবে বুঝতে পারছি না।’
তবে নির্বাচন কমিশন বলছে, গাজীপুরে ভোটারদের ইভিএমে ভোট দেওয়ার বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ১৫ মে থেকে ৮ দিন ইভিএমে মক ভোট দেওয়ার কার্যক্রম চলেছে। সিটি নির্বাচনে যাতে ভোটারদের ভোট দিতে সমস্যা না হয়, সে জন্যই এই কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত কারিগরি দল এ প্রশিক্ষণ দেয়। ভোটার ছাড়াও প্রত্যেক প্রার্থীর কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন একজন ব্যক্তিকে নির্বাচন কমিশন প্রশিক্ষণ দিয়েছে, যাতে ইভিএম–সংক্রান্ত ভ্রান্ত ধারণা দূর হয়।
গাজীপুর সিটি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা ফরিদুল ইসলাম বলেন, গাজীপুরে ভোটাররা এবারই প্রথম ইভিএমে ভোট দেবেন। এটি নিয়ে ভোটারদের মধ্যে নানা ধরনের ভীতি কাজ করেছে। এসব ভীতি দূর করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে ইসি। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের ডামি ইভিএম ব্যবহার করে ভোটারদের ভীতি দূর করার উদ্যোগ নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ইভিএমের ব্যবহার নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক থাকলেও আগামী নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০টি আসনে ইভিএমে ভোট নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ইসি। পরে সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। গত ৩ এপ্রিল কমিশনের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনেই ভোট হবে কাগজের ব্যালটে। কিন্তু ইভিএম নিয়ে মতানৈক্য থাকলেও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেটি ব্যবহার করছে ইসি।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার বলেন, ইভিএমে জটিলতার কারণে কিছু ভোটার তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত হন। জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার পরও সিটি করপোরেশনে কেন তা ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটি বোধগম্য নয়। এত ভোটারের সিটি, ইভিএম নিয়ে যে প্রচারের দরকার ছিল, সেটিতেও ঘাটতি রয়েছে।