ফেরদৌসী জাহান ওরফে স্বর্ণার (২৫) অভিযোগ, যৌতুকের জন্য শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে আসছিলেন স্বামী। তাঁর সুখের কথা ভেবে ১০ লাখ টাকা দিয়েছিলেন তাঁর বাবা। কিন্তু কিছুদিন পর আরও পাঁচ লাখ টাকার জন্য তাঁকে চাপ দিতে থাকেন স্বামী।
একপর্যায়ে গত ২ ফেব্রুয়ারি মারধর করে তাঁকে বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়। প্রতিকার চেয়ে মিরপুর থানায় গেলে তাঁকে থানার সার্ভিস ডেস্কে পাঠান। সেখান থেকে আইনি সহায়তা নেন ফেরদৌসী।
শুধু ফেরদৌসীই নন, গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত আট মাসে সারা দেশে থানার এই নারী, শিশু, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী সার্ভিস ডেস্ক থেকে সেবা ও আইনি সহায়তা নিয়েছেন ১ লাখ ৪২ হাজার ৮৬৯ জন। সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এই ডেস্কে নারী নির্যাতনের অভিযোগ বেশি আসে। সেবা নিয়ে সন্তুষ্ট সেবা গ্রহীতারা।
নারী, শিশু, বয়স্ক (ষাটোর্ধ্ব) ও প্রতিবন্ধীদের আইনি সহায়তা ও সেবা দেওয়ার জন্য দেশের প্রতিটি থানায় সার্ভিস ডেস্ক চালু করা হয়েছে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কিছু থানায় পরীক্ষামূলক এই সেবা চালু করা হয়েছিল। পরে ২০২২ সালের ১০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রতিটি থানায় আনুষ্ঠানিকভাবে এ সার্ভিস ডেস্কের উদ্বোধন করেন।
ডিএমপির সদর দপ্তরের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ) বিপ্লব বিজয় তালুকদার বলেন, থানার সার্ভিস ডেস্ক থেকে এখন প্রতিদিন অনেক মানুষ সেবা ও আইনি সহায়তা পাচ্ছেন।
সেবায় সন্তোষ
রাজধানীর মিরপুরের দক্ষিণ মনিপুরের বাসিন্দা ফেরদৌসী জাহান জানান, সার্ভিসে ডেস্কের সহায়তায় স্বামীর বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন তিনি। পুলিশের সার্ভিস ডেস্কের সেবায় সন্তোষ প্রকাশ করেন তিনি।
থানার সার্ভিস ডেস্কের সেবা গ্রহীতাদের আরেকজন স্বর্ণালি সরকার। রাজবাড়ীর এই বাসিন্দা স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে পড়েন। মাঝেমধ্যে রাজধানীর ফার্মগেটে ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে আসেন তিনি। স্বর্ণালি বলেন, ‘২০২০ সাল থেকেই আমার ছবি ব্যবহার করে একাধিক ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে প্রতারণার পাশাপাশি মানহানিকর তথ্য ছড়াতে থাকে একটি চক্র। এ ব্যাপারে আমি রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি থানায় জিডি করেছিলাম। গত ৩০ মার্চ তেজগাঁও থানার সার্ভিস ডেস্কে গেলে ঘটনার তদন্ত শুরু করে পুলিশ।’
ছয় মাসে ডিএমপিতে সেবা নিয়েছেন ১৮ হাজার জন
ডিএমপি সদর দপ্তর সূত্র জানায়, গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ছয় মাসে ডিএমপির আটটি বিভাগের ৫০ থানার সার্ভিস ডেস্ক থেকে ১৭ হাজার ৯২৯ জন সেবা ও আইনি সহায়তা নিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৮৭৮টি ছিল নারী নির্যাতন–সংক্রান্ত সেবা। এ ছাড়া দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩৯৯টি যৌতুক আর তৃতীয় সর্বোচ্চ ১৯১টি ধর্ষণ–সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে সেবা ও আইনি সহায়তা দেওয়া হয়। উত্ত্যক্ত করার ৮৬টি অভিযোগও আসে সার্ভিস ডেস্কে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত গত আট মাসে সারা দেশে সার্ভিস ডেস্ক থেকে ১ লাখ ৪২ হাজার ৮৬৯ জনকে সেবা ও আইনি সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
নারীদের নিঃসংকোচে বলার সুযোগ
প্রতারণা, পারিবারিক কলহ, মুঠোফোন চুরি, যৌতুক ও নির্যাতন এবং ভয়ভীতি ও হুমকি–সম্পর্কিত অভিযোগ আসে সার্ভিস ডেস্কে। বিড়ম্বনার আশঙ্কা থেকে অনেকে মামলা বা ঘটনা প্রকাশ করতে চান না। তাঁদের জন্য সহায়ক হয়ে উঠেছে সার্ভিস ডেস্ক।
কয়েক দিন আগে মিরপুর মডেল থানায় দেখা যায়, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) কক্ষের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে রয়েছে সার্ভিস ডেস্ক। ডেস্কের দায়িত্বে থাকা এসআই কাঞ্চন নাহার বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাদী-বিবাদীর সঙ্গে বসে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হয়। সমাধান না হলে ভুক্তভোগীকে দিয়ে জিডি বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে মামলা করানো হয়।
এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ভুক্তভোগীদের বেশির ভাগই নারী। এ ডেস্কে সবাই নারী পুলিশ থাকায় যেকোনো কথা স্বচ্ছন্দে বলতে পারেন তাঁরা। এই ডেস্কে দায়িত্বরত দুজন এসআই, তিনজন এএসআই (সহকারী উপপরিদর্শক), ১০ জন কনস্টেবলের সবাই নারী।
তেজগাঁও থানার সার্ভিস ডেস্কের দায়িত্বে আছেন এসআই মোসাম্মৎ জেসমিন বেগম। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে অনেকেই এই ডেস্ক সম্পর্কে জেনে গেছেন। তাই অনেকেই থানার ডিউটি অফিসারের কক্ষে না গিয়ে সরাসরি এই ডেস্কে চলে আসেন।
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র ও সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মো. মনজুর রহমান বলেন, নারী, শিশু, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেবা ও আইনি সহায়তা দিতে সার্ভিস ডেস্ক সফলতার সঙ্গে কাজ করছে।