বাস বা প্লেনের চেয়ে দূর যাত্রায় অনেক দেশেই ট্রেন ভ্রমণ জনপ্রিয়। এক কাপ কফি হাতে জানালার পাশে বসে বাইরের নৈসর্গিক নানা দৃশ্য আর ট্রেনের ঝিকঝিক শব্দ অনেককে যেমন স্মৃতিকাতর করে তোলে, তেমনি কেউ আবার ডুবে যান ভাবনার অতলে। বহু দেশে এমন সব রেলপথ আছে, যেগুলোতে ভ্রমণ সত্যি আনন্দময়। কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর রেলরুট কোনটি– প্রশ্ন করা হলে অনেকে উত্তর দিতে গুলিয়ে ফেলতে পারেন। বিষয়টি তর্কসাপেক্ষ হলেও নরওয়ের রাজধানী অসলো থেকে দেশটির পশ্চিম উপকূলীয় শহর বার্গেন পর্যন্ত যাঁরা ট্রেনে ভ্রমণ করেছেন, তাঁরা এ পথের সৌন্দর্য দেখে অস্ফুটে হলেও ‘দারুণ’ কিংবা ‘চমকপ্রদ’ বলতে বাধ্য হন। চলুন কল্পনায় ঘুরে আসা যাক নান্দনিক নিসর্গের ভেতর দিয়ে এক নয়নাভিরাম রেল ভ্রমণে।
৪৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলরুটে ভ্রমণ নিয়ে সম্প্রতি বিবিসিতে অভিজ্ঞতা লিখেছিলেন অ্যান্থনি হ্যাম নামে এক পর্যটক। লেখায় তিনি তুলে ধরেছেন, অসলো থেকে ট্রেনে চেপে এই রুটের ৩৯টি স্টেশন পার হতে গিয়ে তিনি প্রকৃতির বিচিত্র সৌন্দর্যের মুখোমুখি হয়েছেন। তিনি একে বর্ণনা করেছেন বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর ট্রেন ভ্রমণ হিসেবে।
নভেম্বরের এক কনকনে শীতের সকালে অ্যান্থনি অসলো থেকে ট্রেনে চড়ে বসেছিলেন বার্গেনের উদ্দেশে। প্রায় এক দশক ধরে নরওয়ের বিভিন্ন জায়গা ঘুরলেও বিখ্যাত এই ট্রেনযাত্রায় তিনি ছিলেন প্রথম। অসলো থেকে বার্গেন যেতে প্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টার মতো সময় লাগে। সুমেরু অঞ্চলের মধ্যে পড়ায় এমনিতেই নরওয়েতে দিন অনেক ছোট। তাই দিনের আলোতে পর্যটকদের এই রেল ভ্রমণের সুযোগ দিতে অসলো থেকে সব সময় ট্রেন ছাড়ে ঠিক সকাল ৮টা ২৫ মিনিটে। সেদিন সময়মতোই ট্রেন ছেড়েছিল। অসলো স্টেশন ছেড়ে ট্রেন যত এগোতে থাকল, জানালার পাশে বসে থাকা অ্যান্থনি চারপাশের সৌন্দর্য দেখে অভিভূত হয়ে পড়লেন। তিনি লেখেন, ট্রেন যখন প্ল্যাটফর্ম ত্যাগ করল, বুঝতে শুরু করলাম, এমন মুহূর্তের জন্যই আমি বহুদিন অপেক্ষা করেছিলাম।
অ্যান্থনি জানান, ট্রেন শহরের কেন্দ্র থেকে দূরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখে পড়ল অসলোজর্ডের দুর্দান্ত সব দৃশ্য। সারি সারি পাহাড়ের ধারে সুন্দর কাঠের ঘর, বাইগডয়ের দারুণ জাদুঘরগুলো; যেখানে হয়তো রক্ষিত আছে অতীতে ভাইকিংদের মহাকাব্যিক গল্পগুলো। গোটা ভ্রমণে আমাদের ট্রেন কখনও তুষারের টুপি পরা সুউচ্চ পর্বতের পাদদেশের ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে টানেল অতিক্রম করেছে। পাশেই চঞ্চল হয়ে বয়ে চলেছে পাহাড়ি খরস্রোতা নদী। কখনও দেখেছি হলুদ হয়ে যাওয়া বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ শেষে পাহাড়ের গায়ে যেন হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছোট ছোট কাঠের বাড়ি। কখনওবা ট্রেন আঁকাবাঁকা হয়ে চলেছে পর্বতের ঢালে জমে থাকা বরফের পাশ দিয়ে বয়ে চলা শান্ত নদীর ধার দিয়ে। তুষার জমে সাদা রূপ ধারণ করা ঝাউ বনেরও দেখা মিলেছে।
এই রুটে নরওয়ে রেল কর্তৃপক্ষের হয়ে গত তিন দশক ধরে কাজ করেন জর্গেন জোহানসেন। তিনি বলেন, এই রুটে প্রথম যাঁরা ভ্রমণ করেন, আমি তাঁদের মুখ দেখতে ভালোবাসি। ট্রেনের বাইরের চারপাশের রূপ দেখতে কখনোই আমার ক্লান্তি লাগে না। কিন্তু মানুষ যখন মুগ্ধ হয়ে সেটা প্রথমবার দেখে, তা আমি উপভোগ করি।
ভ্রমণের সবচেয়ে প্রিয় মুহূর্তের কথা বলতে গিয়ে অ্যান্থনি জানিয়েছেন, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে হাজার কিলোমিটার ওপরে ৬ হাজার ৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ইউরোপের সবচেয়ে বড় মালভূমি হারদানগেরভিদ্দার ভেতর দিয়েও পথ অতিক্রমের কথা। তিনি লিখেছেন, হারদানগেরভিদ্দার ভেতর দিয়ে ট্রেন যাওয়ার সময় চারপাশের নীরবতা ছিল সত্যি নাটকীয়। যাত্রীরা সবাই বিস্ময়ে চুপ হয়ে ছিলেন। শুধু ঘোষক যখন মিরদাল স্টেশনে আমাদের আসন্ন আগমনের ঘোষণা দিলেন, তখনই কেবল আমরা অনেকক্ষণ পর কোনো মানুষের কণ্ঠস্বর শুনে চমকে যাই। হারদানগেরভিদ্দার যেদিকে তাকাই, সব যেন সুন্দর। এখানে পৃথিবী যেন সবুজ; নদী, লেকগুলো স্বচ্ছ আর আকাশ নীল। সাড়ে ছয় ঘণ্টার ৪৯৬ কিলোমিটারের এই ট্রেনরুট প্রকৌশল বিদ্যার এক বিস্ময়!