বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের কৃষক হয়ে ওঠার গল্প

0
147
ড. আবু বকর সিদ্দিক প্রিন্স,বরিশাল ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক ও মার্কেটিং বিভাগের প্রধান।

ড. আবু বকর সিদ্দিক প্রিন্স। বরিশাল ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক ও মার্কেটিং বিভাগের প্রধান তিনি। তার রয়েছে আরও একটি পরিচয়, কৃষক। সাত একর জায়গায় তার একটি খামারও রয়েছে। বাগানটিতে রয়েছে দেশি বিদেশি ৩৬ জাতের ফলদ, বনজ ও ঔষধী মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার গাছ। এছাড়াও রয়েছে, গরুর খামার, মাছের খামার এবং জৈব সারের প্লান্ট।

শনিবার (১৪ মে) ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার রাঙ্গামাটিয়া ইউনিয়নের বাবুলের বাজারে নিজের বাগানে চাষ করা ১৬ কেজি কচুর লতি বিক্রি করছিলেন ড. আবু বকর সিদ্দিক প্রিন্স। বাজারে একটি প্লাস্টিকের টুলের ওপর বসে কচুর লতি বিক্রি করার সময় স্থানীয় এক ব্যক্তি ছবিসহ ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করেন। বিষয়টি মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। এরপর থেকেই প্রশংসায় ভাসছেন ড. আবু বকর সিদ্দিক প্রিন্স।

jagonews24

ছবিটি শেয়ার করেন ময়মনসিংহের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অনসাম্বল থিয়েটারের সভাপতি আবুল মনসুর। তিনি লেখেন, ‘কেউ হয়তো ভাবতেই পারেন, ছবির মানুষটি এমনিতেই বসে আছেন। কিন্তু না, উনি নিজের উৎপাদিত কৃষিপণ্য গ্রামীণ হাটবাজারে বসে বিক্রি করছেন। ছবিতে দেখতে পাওয়া লোকটির নাম ড. আবু বকর সিদ্দিক। ডাকনাম প্রিন্স। লোকটি একজন আপাদমস্তক কৃষক। শহুরে আয়েশী জীবন ত্যাগ করে গ্রামেই নিয়মিত বসবাসে অভ্যস্ত হয়েছেন। দেশসেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ, এমবিএ এবং পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করে কৃষিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন তিনি।’

জানা যায়, ড. আবু বকর সিদ্দিক প্রিন্স বরিশালের ঝালকাঠির রাজাপুরের অবসরপ্রাপ্ত একজন সেনা কর্মকর্তার ছেলে। বাবার সেনাবাহীতে চাকরির সুবাদে পরিবারসহ ঢাকায় সেনা নিবাসে বসবাস করতেন তিনি। ২০০২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে ২০০৮ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এআইইউবি থেকে কৃষি ব্যবসায় এমবিএ ডিগ্রি নেন। এরপর ২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল এবং ২০১৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডিও করেন তিনি।

jagonews24

বর্তমানে তিনি বরিশাল ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক ও মার্কেটিং বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

তবে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার রাঙ্গামাটিয়া ইউনিয়নের হাতিলেইট গ্রামে তার শ্বশুরবাড়িতে বসবাস করেন। এই সুবাধে গত ৮ বছর ধরে তিনি কৃষিকে ভালোবেসে এই গ্রামেই বাণিজ্যিকভাবে ৭ একর জমিতে ‘কৃষাণ সমন্বিত কৃষি উদ্যোগ’ নামে গড়ে তুলছেন বিশাল কৃষি খামার।

ড. আবু বকর সিদ্দিক প্রিন্স বলেন, ছোট থেকে কৃষির প্রতি তার ভালোবাসা কাজ করে। সেই ভালোবাসা থেকেই ২০০৬ সালে ভারতের পাঞ্জাবে গিয়েছিলেন একটি প্রশিক্ষণ নিতে। সেখানকার কৃষিব্যবস্থা দেখে আরও আকৃষ্ট হন কৃষিকাজের প্রতি। ২০১৪ সালে শখের বশে নিজের গ্রামে ফলের বাগান করেন। এরপর দেশ-বিদেশ থেকে উন্নত ফলগাছের চারা ও বীজ সংগ্রহ করে বাগানে লাগাতে থাকেন। এখন তাঁর সাত একর জমিতে ৩৬ প্রজাতির ফলদ, বনজ, ফুল ও ঔষধীসহ ১০ হাজার গাছ রয়েছে। প্রায় সব গাছে ফুল ও ফল ধরেছে।

jagonews24

এসব গাছের মধ্যে রয়েছে, ড্রাগন ফল, মাহালিশা, কিউজাই, ব্রুনাই কিং, বাউ-৪, কাঁচামিঠা, তাইওয়া গ্রিন, কাটিমন, পালমার, মল্লিকাসহ ১০ প্রজাতির আম, চায়না থ্রি, মঙ্গলবারিসহ তিন প্রজাতের লিচু, মিসরীয় শরিফা, স্ট্রবেরি, চেরি, থাই পেয়ারা, আম, লেবু, জাম্বুরা, লটকন, মাল্টা, সফেদা, আতাফল, কদবেল, আমলকী, ডেউয়া, ডুমুর, কাঠবাদাম, জামরুল, থাই জাম্বুরা, লটকন, মল্টা ও কলা ইত্যাদি ফলগাছ।

তিনি বলেন, আমি সবসময় নিরাপদ ও বিষমুক্ত ফল আবাদ করি। এজন্য বাগানে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সারের প্লান্ট তৈরি করেছি। বাগানে সব প্রকার গাছেই নিজের উৎপাদিত কেঁচো সার ও জৈব সার ব্যবহার করা হয়। ফলগাছে পোকা-মাকড় নিধনে বেশি ব্যবহার করেন বিভিন্ন ধরনের ট্র্যাপ বা ফাঁদ।

jagonews24

বাগানের ভেতরে রয়েছে একটি মাছের খামার। পুকুরে দেশি প্রজাতির মাছের চাষ করা হয়। পুকুর পাড়ে রাজহাঁস আর চীনা হাঁসের ছোট্ট একটি খামারও আছে। মাছের জন্য বাজার থেকে আলাদা খাদ্য কিনতে হয় না। পুকুরপারে একটি শেডে কিছু গবাদি পশুও লালন-পালন করছেন।

বাজারে বসে কচুর লতি বিক্রির বিষয়ে তিনি বলেন, আমি এই প্রথম বাজারে গিয়ে কচুর লতি বিক্রি করেছি বিষয়টি এমন না। এর আগেও অনেকবার বাজারে অন্যান্য ফলমুল বিক্রি করতে গিয়েছি। এটা সবার কাছে অস্বাভাবিক লাগলেও আমার কাছে স্বাভাবিক। কারণ আমি পিএইচডি করেছি বলে বাজারে গিয়ে কিছু বিক্রি করতে পারব না বিষয়টি এমন না।

jagonews24

তিনি আরও বলেন, এই বাগান করতে আমার সব মিলিয়ে ২৫ লাখ টাকা লোন আছে। এগুলো কোনো কৃষি লোন না। ঋণগুলো ব্যাংক, এনজিও, বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে নেওয়া। এগুলো পরিশোধ করতে পারলে আমার অন্য কোনো সমস্যা থাকবে না।

সবশেষ তিনি বলেন, দেশে এমন উদ্যোক্তা হাজার হাজার আছে। যারা এসব কাজের উদ্যোগ নিয়েও এখন করতে পারছে না বা ছেড়ে দিচ্ছে। তাদের সরকার থেকে লোন দিয়ে সহায়তা করা জরুরি বলে আমি মনে করি।

 মঞ্জুরুল ইসলাম,  ময়মনসিংহ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.