ডিসেম্বর কিংবা জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন। বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগীদের প্রত্যাশা- এ সংসদ নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক। প্রয়োজনে সরকারকে ছাড় দিয়ে হলেও বিরোধী দলগুলোর আস্থা অর্জনের পরামর্শ দিয়েছে তারা। এ পটভূমিতে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোকে জাতীয় নির্বাচনে আনতে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও নানামুখী পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যখন বিশেষ ব্যবস্থায় কারাগার থেকে মুক্তি পান, তখন বিদেশ ভ্রমণ ও রাজনীতি না করার শর্ত দেওয়া হয়েছিল। তবে গত রোববার আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন, খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না, তবে রাজনীতি করতে বাধা নেই। এ ছাড়া বিএনপি নেতাকর্মীর নামে করা মামলাগুলোর পর্যালোচনা চলছে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। বিএনপি নির্বাচনে আসতে রাজি হলে কয়েক মাসের মধ্যে হতে পারে এসব মামলার ফয়সালা। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সরকারের এমন তৎপরতায় রাজনীতিতে নতুন মেরূকরণের আভাস মেলে।
সূত্র জানায়, বিএনপি নেতাদের সঙ্গে আগামী মার্চে কূটনীতিকদের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে বিরোধীদের আস্থা অর্জনে সরকারের ছাড় দেওয়ার বার্তাটি দলটির নেতাদের জানানো হতে পারে।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্রে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে সহযোগিতা চেয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। দলটিকে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসতে সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নকে (ইইউ) আহ্বান জানিয়েছে আওয়ামী লীগ।
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্ট বলেছেন- জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। এ জন্য নির্বাচন কমিশনকে সব ধরনের সহায়তা দেবে নির্বাচনকালীন সরকার। বিএনপি ভেতরে ভেতরে সংলাপ চাইছে। তবে সেটা তাদের স্পষ্ট করতে হবে। তারা আনুষ্ঠানিক সংলাপের কথা বললে ইতিবাচক সাড়া দেওয়া হবে। কেননা সংলাপে আপত্তি নেই আওয়ামী লীগের।
এদিকে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও আন্তর্জাতিক উইংয়ের প্রধান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় রেখে বিএনপির আগামী নির্বাচনে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। একমাত্র নির্দলীয় সরকারের অধীনে হলেই নির্বাচনে যাবে বিএনপি। সে নির্দলীয় সরকার নিয়ে শুধু কথা হতে পারে, অন্য কিছু নয়। বিএনপির এ অবস্থান দেশি-বিদেশি সবাই জানেন।
গত দুটি নির্বাচনের আগেও এ ধরনের আশ্বাস দিয়ে আওয়ামী লীগ ভোটারদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। মিথ্যা আশ্বাসের ফাঁদে আর পা দেবে না বিএনপি। এ বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেননি এবং করলেও কোনো লাভ হবে না।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার রাজনীতি করা নিয়ে আইনমন্ত্রীর বক্তব্যও কূটচাল ছাড়া আর কিছু নয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পশ্চিমা দেশের এক কূটনীতিক বলেন, ‘সহযোগী বন্ধুরা চায় বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হোক। এ জন্য সব ধরনের সহযোগিতা করতে আমরা প্রস্তুত। সরকারি দল বিভিন্ন বৈঠকে বিএনপির আগুনসন্ত্রাস ও নির্বাচনী সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে অসহযোগিতার বিষয়টি তুলে ধরে। এ ক্ষেত্রে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির বিষয়টি সামনে এনে কূটনীতিকদের বিএনপিকে বোঝাতে বলা হয়। বিপরীতে কূটনীতিকদের পক্ষ থেকে ছাড় দিয়ে হলেও বিরোধী দলগুলোর আস্থা অর্জনে পরামর্শ দেওয়া হয়।’
বিরোধী দলগুলোর আস্থা অর্জনে ছাড় দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে পশ্চিমা আরেক কূটনীতিক বলেন, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে আওয়ামী লীগের কাছে পরিকল্পনা জানতে চাওয়া হয়েছিল। তবে এ বিষয়ে তারা সুস্পষ্ট কিছু জানায়নি। এ প্রসঙ্গ তুললেই বিএনপির আগুনসন্ত্রাসের ফিরিস্তি দেওয়া শুরু করে তারা। এ সময় দলটির পক্ষ থেকে বিএনপিকে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ফেরত আনতে বিদেশিদের কাছে আহ্বান জানানো হয়।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোন সরকার ব্যবস্থায় নির্বাচন হবে- তা এ দেশের মানুষ ও সংবিধান ঠিক করবে। তবে অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায় পুরো বিশ্ব। এর প্রতিশ্রুতি সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা ছাড়া বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ হচ্ছে, তাদের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা। বিষয়টি আমলে নিয়ে বিরোধী দলগুলোর আস্থা অর্জনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি ইতিবাচক করে সংলাপের পরিবেশ তৈরির পক্ষে মত উন্নয়ন সহযোগীদের।
গত সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন ঢাকার জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস। বৈঠকে জলবায়ু পরিবর্তন ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা মোকাবিলা, রোহিঙ্গা সংকটসহ বাংলাদেশ-জাতিসংঘের বিভিন্ন সহযোগিতামূলক বিষয়ে আলোচনা হয়। এ ছাড়া বৈঠকে বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) সহযোগিতা করার প্রস্তাব জাতিসংঘের তরফ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেওয়া হয়। তবে এ প্রস্তাবের পক্ষে কোনো সাড়া দেননি তিনি।
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে উন্নয়ন সহযোগী ও বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সহযোগিতার প্রস্তাব নিয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, বিভিন্ন জায়গা থেকে আমরা প্রস্তাব পাচ্ছি। এ নিয়ে ইসির সঙ্গে যোগাযোগ করছি। কমিশনের অভিমতের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সফর করে গেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সিলর ডেরেক এইচ শোলে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন তিনি। এ নিয়ে আস্থার কথাও জানিয়েছেন মার্কিন এ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। সেই সঙ্গে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে মার্কিন ব্যাখ্যাও দিয়েছেন শোলে।
গত বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে ইইউভুক্ত দেশগুলোর রাষ্ট্রদূত ও প্রতিনিধিদের বৈঠক হয়। এতে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক করা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
এ বৈঠকে আওয়ামী লীগকে আগামী নির্বাচনে নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে ইইউ। তাতে স্বাগত জানিয়েছে সরকারি দল। যুক্তরাষ্ট্রও নির্বাচনে পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর আগ্রহ দেখিয়েছে।
এদিকে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচনী পর্যবেক্ষক পাঠানোর বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গত নির্বাচনে অনেক দেশের নির্বাচনী পর্যবেক্ষক আসাতে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছিল। তবে এবার সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে সরকার।
নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানো নিয়ে গত ৮ জানুয়ারি সিলেটে এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছিলেন, ‘নির্বাচনে পর্যবেক্ষক অ্যালাউ করা হবে এবং উই আর নাথিং টু হাইড।’
রাজনৈতিক বিশ্নেষকদের মতে, সরকারের প্রতিশ্রুতির ওপর ভরসা রাখছে বিদেশি বন্ধুরা। তবে সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন দেখতে পর্যবেক্ষণ দল পাঠাবে দেশ ও সংস্থাগুলো। প্রতিশ্রুতি থেকে সরকার সরে এলে, সে ক্ষেত্রে নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথাও জানিয়ে দিয়েছে বিদেশিরা। ফলে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক করতে সরকার, নির্বাচন কমিশন, মাঠ কর্মকর্তা, সুশীল সমাজ, উন্নয়ন সহযোগীদের পাশাপাশি বিরোধী দলগুলোকেও ভূমিকা রাখতে হবে।