বিপর্যয়ে উদ্ধারকাজে সক্ষমতায় ঘাটতি

0
148

উপকূলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেলের স্বীকৃতি পেলেও নগরকেন্দ্রিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় এখনও অনেক পিছিয়ে। ভূমিকম্প, অগ্নিকাণ্ড, বিস্ফোরণসহ মানবসৃষ্ট বহু ঝুঁকির ক্ষেত্রে নেই যথেষ্ট প্রস্তুতি। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বিল্ডিং কোড না মানা, দুর্ঘটনা-পরবর্তী জরুরি উদ্ধার ও অনুসন্ধান কাজের অনভিজ্ঞতায় ক্রমেই বাড়ছে ঝুঁকিগুলো। দুর্বল ও ভঙ্গুর পদ্ধতির গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির লাইন নগরের দুর্যোগ পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে।

এ অবস্থায় আজ শুক্রবার পালিত হচ্ছ জাতীয় দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবস। ‘স্মার্ট বাংলাদেশের প্রত্যয়, দুর্যোগ প্রস্তুতি সব সময়’– এই স্লোগানে সারাদেশে দিবসটি পালিত হচ্ছে। এ উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁরা বলেছেন, সঠিক সময়ে যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করা গেলে দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস করে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমন্বয়হীনতা আর সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে নগর দুর্যোগে উদ্ধার তৎপরতা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার বিশাল কার্যক্রম একই ছাতার নিচে আনতে না পারলে দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে সুষ্ঠুভাবে উদ্ধারকাজও চালানো সম্ভব হবে না।

 

 

উদ্ধারে সময় লাগছে বেশি : ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ উদ্ধারে সময় লাগে এক মাস। তার পর দুর্যোগে দেশের উদ্ধারকাজের সক্ষমতা নিয়ে বড় প্রশ্ন ওঠে। এর পর এ নিয়ে নেওয়া হয় নানা পদক্ষেপ। তবে এসব উদ্যোগ ও পরিকল্পনায় খুব একটা উন্নতি হয়নি উদ্ধার কার্যক্রমের। যে কোনো অগ্নিকাণ্ড কিংবা বিস্ফোরণের পর উদ্ধার করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে। উদ্ধারকাজে লেগে যায় দীর্ঘ সময়। এতে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বেড়ে যায়। যার সর্বশেষ প্রমাণ, রাজধানীর পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণ ও ধ্বংসযজ্ঞ থেকে হতাহতদের উদ্ধারে বেগ পেতে হয়েছে উদ্ধারকারী সংস্থাগুলোকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরু গলি, রাস্তায় যানজট ও দুর্ঘটনাস্থল ঘিরে মানুষের ভিড়ের কারণে উদ্ধারকারী দলকে ঘটনাস্থলে যেতেই লাগছে দীর্ঘ সময়। তার ওপর সমন্বয়ের অভাব, জনবল সংকট, উদ্ধারকর্মীদের দক্ষতা ও আধুনিক যন্ত্রপাতির ঘাটতি তো আছেই। বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন, দু-একটি ভবন বিস্ফোরণের পর উদ্ধারে এত দীর্ঘ সময় ব্যয় হলে বড় ভূমিকম্প মোকাবিলায় বাংলাদেশের সামর্থ্য নিয়ে এখনই ভাবতে হবে।

২০১৬ সালে রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি কমপ্লেক্সের একটি ফ্লোরের একাংশের আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের ২৯টি ইউনিটের সময় লাগে ১০ ঘণ্টারও বেশি। আর ২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি গুলশানের ডিসিসি মার্কেটে আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের ২২টি ইউনিট, নৌবাহিনী, রোভার স্কাউট, রেড ক্রিসেন্টের কর্মীদের লাগে প্রায় ১৬ ঘণ্টা। ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ বনানীর এফ আর টাওয়ারে ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিটের আগুন নেভাতেই সময় লেগে যায় সাত ঘণ্টারও বেশি। চুড়িহাট্টার আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে খাবি খেতে হয় দমকলের লোকজনকে। ২০২০ সালের ৫ নভেম্বর রাজধানীর ডেমরার কোনাপাড়া মাদ্রাসা রোডে পাশা টাওয়ারের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ১৬টি ইউনিটের ১০ ঘণ্টা লাগে। সর্বশেষ সিদ্দিকবাজারে ভবন বিস্ফোরণের পর চলা উদ্ধারকাজ সাময়িক স্থগিত হয় মঙ্গলবার রাত ১১টায়। কিন্তু ফের উদ্ধারকাজ শুরু করতেই বুধবার সকাল ১০টা বেজে যায়। গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত উদ্ধার অভিযান শেষ করতে পারেননি ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
তারা বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে উদ্ধার অভিযান চালাতে বিশেষজ্ঞ দলের পরামর্শ দিতে হয় উদ্ধারকর্মীদের। বুধবার বেলা ৩টা পর্যন্ত তাঁরা কয়েকটি সংস্থার সহযোগিতা চেয়েও পাননি। এ ছাড়া ভবনটির বেজমেন্টে উদ্ধার অভিযান চালাতে প্রয়োজন হয় শোরিং (ঠেক দেওয়ার) নামের বিশেষ যন্ত্রের, যা ফায়ার সার্ভিসের কাছে নেই। তাঁরা রাজউক ও সিটি করপোরেশনের কাছে এ যন্ত্রের জন্য সহযোগিতা চেয়েও পাননি বলে অভিযোগ করেন।

সংকট ও সমন্বয়হীনতা : বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রানা প্লাজা ধসের পর ২০১৫ সালে ফায়ার সার্ভিসে যোগ হয় আধুনিক যন্ত্রপাতি। চীন থেকে আনা হয় ২১ হাজার লিটার ধারণক্ষমতার ওয়াটার টেন্ডারসহ ধ্বংসাবশেষ সরানোর নানা যন্ত্র। দক্ষতা বাড়াতে দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। তার পরও দুর্ঘটনায় সক্ষমতা নিয়ে বারবার প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

অন্যদিকে, বাংলাদেশে যখনই কোনো দুর্যোগ হয়, প্রথমেই সেই দুর্যোগে যে প্রতিষ্ঠানটির সাড়া দেওয়ার কথা, সেটি হলো সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। উপকূলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় এ প্রতিষ্ঠানটির সাফল্য থাকলেও নগরে অগ্নিকাণ্ড কিংবা ভবন ধসের মতো ঘটনায় সংস্থাটির তেমন তৎপরতা চোখে পড়ে না।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে ২৪ হাজার ১০২টি অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে। এতে নিহত হয়েছেন ৮৫ জন এবং আহত হয়েছেন ৩৭৭ জন। এর বাইরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মী নিহত হয়েছেন ১৩ জন এবং আহত হয়েছেন ৩০ জন। এসব দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩৪২ কোটি টাকা।

অভিযোগ রয়েছে, বড় কোনো দুর্ঘটনার পরপরই ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো নানা অভিযান পরিচালনা করে। কিন্তু অন্য সময় তেমন কঠোর ভূমিকায় তাদের দেখা যায় না।

ফায়ার সার্ভিসে সাম্প্রতিক সময়ে নতুন যন্ত্রপাতি যুক্ত করা হলেও আরও কিছু আধুনিক যন্ত্রপাতি না থাকার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা চলছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। সংস্থাটির দেওয়া তথ্য মতে, সারাদেশে অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার সরঞ্জাম, গাড়ি– সব মিলিয়ে ৪ হাজার ৩৯৪টি যন্ত্রপাতি আছে। এর বেশিরভাগই ঢাকার ফায়ার স্টেশনে। দেশের ৪৯২টি ফায়ার স্টেশনের মধ্যে ১১২টিই ঢাকায়। কিন্তু ঢাকায় ছোটখাটো অগ্নিকাণ্ড দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনার সক্ষমতা থাকলেও বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সংস্থাটির দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সংশ্লিষ্ট কর্মীদের আন্তরিকতা, সাহস এবং মানবিক তৎপরতা সমালোচনার ঊর্ধ্বে হলেও জনবল এবং আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবে সংস্থাটির দুর্বলতা তাদের সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বর্তমানে এ সংস্থার প্রাধিকারপ্রাপ্ত মোট জনবল ১৩ হাজার ১১০ জন। কর্মরত আছেন ১০ হাজার ৮৯৩ জন। যার মধ্যে ফায়ারম্যানের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। ফায়ার সার্ভিসে অন্তত ৩০ হাজার জনবল প্রয়োজন বলে মনে করেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা।

ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে ল্যাডার (মই) রয়েছে ২০টি। ঢাকায় রয়েছে মাত্র ৯টি। এর মধ্যে সম্প্রতি সর্বোচ্চ ৬৪ মিটারের দুটি ল্যাডার কেনা হয়েছে। ৫৪ মিটার ও ২৭ মিটারের ল্যাডার রয়েছে। বিশেষায়িত গাড়িও বাড়ানো হয়েছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ড. মেহেদী হাসান আনসারী বলেন, দুর্যোগে উদ্ধারকাজ পরিচালনার জন্য দেশে ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার নেই। উদ্ধার কার্যক্রম দ্রুত পরিচালনার জন্য যে ধরনের প্রযুক্তি থাকা দরকার, তা আমাদের সংস্থাগুলোর নেই। আবার যেসব আধুনিক প্রযুক্তি রয়েছে, তা ব্যবহার করতে জানা কর্মীর অভাব রয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ দুর্যোগের ঝুঁকির মাত্রা কমিয়ে আনতে পারে। বিল্ডিং কোড থাকলেও সেটির কার্যকর প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন নেই। রাজউক, সিটি করপোরেশন, দুর্যোগ মন্ত্রণালয় ও ফায়ার সার্ভিসের মধ্যে সমন্বয় আরও বাড়াতে হবে। ফায়ার সার্ভিসের বড় অনেক যন্ত্রপাতি আছে, তবে আমাদের ছোট গাড়ি ও যন্ত্রের প্রয়োজন রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ও নগর দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, আমাদের দেশে নগর দুর্যোগে কমান্ড-সিস্টেম এখনও গড়ে ওঠেনি। সিভিল ডিফেন্সকে অবশ্যই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের আওতায় আনতে হবে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, উদ্ধারকাজের জন্য অধিদপ্তরের তেমন জনবল নেই, তাই আধুনিক সরঞ্জামগুলো তিন বাহিনীর পাশাপাশি কোস্টগার্ড, ফায়ার সার্ভিস ও সিটি করপোরেশনকে দেওয়া হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডসহ নগরে নানা দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের সক্ষমতা বেড়েছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.