বিদ্যুৎ মিলবে ২০২৫-এর শুরুতে

রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র

0
91
রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে আজ মিলবে ইউরেনিয়াম।

ইউরেনিয়াম আসার মধ্য দিয়ে পারমাণবিক স্থাপনা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র। আজ বৃহস্পতিবার এই পারমাণবিক জ্বালানি আনুষ্ঠানিকভাবে রূপপুর কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করবে কেন্দ্রের প্রস্তুতকারক রাশিয়ার রোসাটম কোম্পানি। জ্বালানি এলেও কেন্দ্রটি পরীক্ষামূলক উৎপাদনে যাবে আগামী বছরের সেপ্টেম্বরে। জনগণের কাছে বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছাবে ২০২৫ সালের শুরুতে।

দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এই প্রকল্পের অন্যতম সুবিধাভোগী হবে উত্তরাঞ্চল। সার্বিকভাবে দেশের প্রথম পারমাণবিক কেন্দ্রটি মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ২ শতাংশ অবদান রাখবে বলে আশা করছে সরকার।

রূপপুর কেন্দ্রে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের দুটি ইউনিট রয়েছে। প্রথম ইউনিটের ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক ড. শৌকত আকবর। দ্বিতীয় ইউনিটের অগ্রগতি ৭০ শতাংশ। তিনি জানান, আগামী এপ্রিলের মধ্যে প্রথম ইউনিট জ্বালানি স্থাপনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হবে। সঞ্চালন লাইন নির্মাণ শেষ হলে ইউরেনিয়াম ফুয়েল স্থাপন করা হবে। সেপ্টেম্বর মাসে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হবে। প্রথম ধাপে ২০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। প্রথম ধাপের সফলতার পর ধাপে ধাপে ৫০ ও ৭০ শতাংশ এবং শেষ ধাপে পুরোপুরি উৎপাদনে যাবে। এই ধাপগুলো পার হতে সাধারণত ১০ মাস সময় লাগে। ২০২৫ সালের শুরুতে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হবে।

প্রতিটি ইউনিটের জন্য ১৬৩টি ফুয়েল অ্যাসেমব্লি লাগবে। প্রতিটি অ্যাসেমব্লিতে ৩১২টি ইউরেনিয়াম রড থাকে। গত ২৮ সেপ্টেম্বর প্রথম ব্যাচের প্রথম চালানের ইউরেনিয়াম বাংলাদেশে আসে। ২৯ সেপ্টেম্বর তা রূপপুরে আনা হয়।

আজ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকল্প এলাকায় রূপপুর কর্তৃপক্ষের কাছে ইউরেনিয়াম হস্তান্তর করবেন রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পরমাণু শক্তি করপোরেশনের (রোসাটম) মহাপরিচালক আলেক্সি লিখাচেভ। অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি ভার্চুয়ালি যুক্ত হবেন। ইতোমধ্যে ইউরেনিয়াম হস্তান্তর প্রক্রিয়ার যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে কর্তৃপক্ষ।

সুবিধা পাবে উত্তরাঞ্চল 

গতকাল বুধবার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনকালে সাংবাদিকদের বলেন, এ প্রকল্পের জন্য সাত বছর নিরলসভাবে কাজ করা হয়েছে। করোনার সময়ও কাজ ব্যাহত হয়নি। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবন্ধু কাজ শুরু করতে চেয়েছিলেন। ফরাসি ও রুশদের সঙ্গে কথা শুরু করেছিলেন। তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে সফল হলো বাংলাদেশ। আমরা এখন নিউক্লিয়ার ক্লাবের গর্বিত সদস্য।

মন্ত্রী বলেন, আমরা সাড়ে ৬ বছরে এর চূড়ান্ত ধাপে পৌঁছে গেছি। বিশ্বে আর কোথাও সাত-আট বছরে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের রেকর্ড নেই। কোথাও কোথাও ১৫ বছর সময় লেগেছে। তিনি বলেন, আমরা প্রস্তুত হলেই চলবে না, ট্রান্সমিশন লাইন লাগবে। ২০২৫ সালের প্রথম দিকে জনগণের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছাবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এ প্রকল্পের মাধ্যমে পিছিয়ে থাকা উত্তরবঙ্গের মানুষের সুবিধা যেন নিশ্চিত হয়। আমরা সেদিকে নজর রাখছি।

নিরাপত্তা ঝুঁকি

রূপপুরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রকল্প পরিচালক শৌকত আকবর বলেন, বিভিন্ন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের ধাপে ধাপে অনুমোদন নিতে হয়েছে। মোট আটটি স্তর ছিল, প্রতিটি স্তর থেকে পরবর্তী স্তরে যেতে আইএইএর অনুমোদন নিতে হয়েছে। অর্থাৎ পরীক্ষায় পাস করে পরবর্তী ধাপে প্রবেশ করতে হয়েছে। আন্তর্জাতিক অনেক অথরিটি নিবিড় পর্যবেক্ষণ করেছে। এখানে ঘাটতির সুযোগ নেই।

তিনি বলেন, রেডিয়েশন নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। রেডিয়েশনের মাত্রা মানুষের সহন ক্ষমতার মধ্যে থাকবে। আমরা ২৩টি রেডিয়েশন স্টেশন চালু করব, সেখানে রেডিয়েশনের মাত্রা প্রদর্শিত হবে। যে কেউ দেখতে পারবেন। এসব স্টেশন ১৮ কিলোমিটার দূরে পর্যন্ত থাকবে। যদিও ১২.৫ কিলোমিটার দূরে মনিটরিংয়ের প্রয়োজন নেই। জনগণ এখন যেভাবে বসবাস করছে, সেভাবেই করতে পারবে।

জনবল প্রসঙ্গে শৌকত আকবর বলেন, প্রশিক্ষিত জনবল প্রস্তুত হয়েছে এবং তারা সুরক্ষা দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করেছে। প্রকল্প পরিচালক বলেন, আজ বৃহস্পতিবার থেকে আমরা আন্তর্জাতিক নিউক্লিয়ার ক্লাবের সদস্য হবো। কমিশনিংয়ের প্রথম দিন থেকে আমাদের প্রশিক্ষিত জনবল যুক্ত থাকবে। তারপর আমরা ভেবে দেখব নিজেরা চালাতে পারব কিনা।

ঋণ শোধ 

ঋণ পরিশোধ সম্পর্কে শৌকত আকবর বলেন, দ্বিতীয় ইউনিটের বাণিজ্যিক উৎপাদনের দুই বছর পর কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে। এ প্রকল্পে মোট ব্যয় হচ্ছে প্রায় ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। ব্যয়ের ৯০ শতাংশ অর্থ ঋণ দিচ্ছে রাশিয়া, যেটা ২৮ বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে।

বিদ্যুৎকেন্দ্রের অর্থ পরিশোধ নিয়ে কোনো জটিলতা আছে কিনা– জানতে চাইলে ইয়াফেস ওসমান বলেন, সারাবিশ্বেই এখন নানা রকম সংকট চলছে। আমরাও কিছু মোকাবিলা করছি। এটি নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। দু’পক্ষই বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে।

রূপপুরেই হবে আরও দুই ইউনিট 

২০৪১ সালের মধ্যে দেশের মোট বিদ্যুতের ৪০ শতাংশ ক্লিন এনার্জি থেকে পাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এর অংশ হিসেবে রূপপুরে আরও দুই ইউনিটের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করার কথা রয়েছ বলে জানান প্রকল্প পরিচালক।

পেছনের কথা 

১৯৬১ সালে এ দেশে প্রথম ২০০ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। ১৯৬৮ সালে পাবনা জেলার ঈশ্বরদীর রূপপুরে ২৬০ একর এবং আবাসিক এলাকার জন্য ৩২ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন ও কিছু আবাসিক ইউনিটের নির্মাণকাজ আংশিক সম্পন্ন হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই প্রকল্প বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু তা বেশিদূর এগোয়নি।

১৯৮৬ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ১২৫ মেগাওয়াটের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ-সংক্রান্ত একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয়। এই প্রকল্পটিও বাস্তবায়িত হয়নি। ১৯৮৭-৮৮ সালে জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডের দুটি কোম্পানি দ্বিতীয়বার ফিজিবিলিটি স্টাডি করে। এর মাধ্যমে প্রকল্পের আর্থিক ও কারিগরি যৌক্তিকতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। এতে ৩০০ থেকে ৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সুপারিশ করা হয়। ১৯৯৭ থেকে ২০০০ সালে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার উদ্যোগে ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

২০০৯ সালের ১৩ মে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন এবং রাশান স্টেট অ্যাটমিক এনার্জি করপোরেশনের (রোসাটম) মধ্যে ‘পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার’বিষয়ক একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়।

২০১০ সালের ১০ নভেম্বর জাতীয় সংসদে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ২০১১ সালের ২ নভেম্বর বাংলাদেশ এবং রাশিয়া সরকারের মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন-সংক্রান্ত আন্তঃরাষ্ট্রীয় সহযোগিতা চুক্তি (আইজিএ) স্বাক্ষরিত হয়।

২০১৩ সালের ১৫ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাশিয়া সফরকালে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রস্তুতিমূলক কাজ সম্পাদনের জন্য স্টেট এক্সপোর্ট ক্রেডিট চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৩ সালের ২ অক্টোবর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রথম পর্যায় কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা।

২০১৫ সালের ১৮ আগস্ট পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনার জন্য নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (এনপিসিবিএল) গঠন করা হয়।

২০১৬ সালের ২১ জুন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সাইট লাইসেন্স দেয় পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। ওই বছরের ২৬ জুলাই প্রকল্পের মূল পর্যায়ের কার্যাবলি সম্পাদনের জন্য বাংলাদেশ এবং রুশ সরকারের মধ্যে স্টেট ক্রেডিট চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়।

২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর প্রথম ইউনিটের প্রথম কংক্রিট ঢালাই প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেন। ২০২১ সালের ১০ অক্টোবর এবং ২০২২ সালের ১৮ অক্টোবর বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ও দ্বিতীয় ইউনিটের পারমাণবিক চুল্লিপাত্র বা রিঅ্যাক্টর প্রেশার ভেসেল স্থাপনের কাজ উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.