চীন ও ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করেই যুক্তরাষ্ট্রের চাপ সামলাতে চাইছে আওয়ামী লীগ সরকার।
প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি, এরপর কংগ্রেসম্যান ও ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যদের চিঠি—এসব ঘটনায় আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর একধরনের চাপ তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক পদক্ষেপের কঠোর সমালোচনা করেছে চীন। দেশটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারকে সমর্থন জানিয়ে প্রকাশ্যে বক্তব্য দিয়েছে।
চীনের এমন অবস্থানে দেশটির প্রতি বাংলাদেশ আরও বেশি ঝুঁকে পড়ছে কি না—এমন আলোচনা শুরু হয়েছে। তবে ক্ষমতাসীন দলের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, চীনের সমর্থন পেলেও তাদের প্রতি পুরোপুরি ঝুঁকে পড়া আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়।
সরকারকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে। চীন ও ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করেই পরিস্থিতি সামলাতে চাইছে আওয়ামী লীগ সরকার। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ কমানোর লক্ষ্যে সরকার নিজে থেকেও নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের চাপ কমাতে আওয়ামী লীগ সরকার কংগ্রেসম্যানদের চিঠির অভিযোগের জবাব দেওয়াসহ বিভিন্ন তৎপরতা চালাচ্ছে। এই তৎপরতার পাশাপাশি ভারতের ওপরও নির্ভর করছে সরকার। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এ মাসেই যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাচ্ছেন। নরেন্দ্র মোদি এই সফরে শেখ হাসিনার সরকারের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ কমানোর চেষ্টা করবেন—এমন একটা আলোচনা আওয়ামী লীগ ও সরকারের ভেতরে রয়েছে। যদিও মন্ত্রীদের অনেকে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপের সমালোচনা করে বক্তব্য দিচ্ছেন।
বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা দিলে ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র
তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির পরও দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিরোধ নিরসনের চেষ্টা করা বা বিরোধী দলের দাবির ব্যাপারে সরকারের নমনীয় হওয়ার ইচ্ছা বা লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। দেশের সংবিধানে যে ব্যবস্থা আছে, সে অনুযায়ীই সরকার যথাসময়ে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী ফোরাম সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো ‘অবৈধ উপায়’ খোঁজার সুযোগ সরকার দেবে না। এটাই এখন তাঁদের অবস্থান।
বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার ক্ষেত্রে যারা বাধা তৈরি করবে, তাদের জন্য বিধিনিষেধ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করে গত ২৪ মে। এ নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হয়। এই ঘটনাপ্রবাহে যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান পার্টির ছয়জন, পরে ডেমোক্রেটিক পার্টির ছয়জন কংগ্রেসম্যান পৃথকভাবে চিঠি দেন দেশটির সরকারের কাছে।
বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য পদক্ষেপ চেয়ে ব্লিঙ্কেনকে ৬ কংগ্রেসম্যানের চিঠি
তাঁরা বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করা এবং মানবাধিকার ও সংখ্যালঘুদের অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে ইউরোপীয় পার্লামেন্টেরও ছয়জন সদস্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি-বিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেলকে একটি চিঠি লেখেন। তাঁদেরও চিঠির বিষয় একই রকম।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) এক বিবৃতি দিয়ে জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের নিয়োগের ক্ষেত্রে মানবাধিকার-সংক্রান্ত বিষয় যাচাই-বাছাইয়ের আহ্বান জানিয়েছে।
‘ভারতের ওপর নির্ভর’
গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগ এবং পদক্ষেপকে আওয়ামী লীগ সরকার প্রকাশ্যে চাপ হিসেবে স্বীকার করতে চাইছে না; বরং আওয়ামী লীগের নেতা ও মন্ত্রীদের অনেকে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করছেন।
তবে পরিস্থিতিটাকে সরকার ও দেশের রাজনীতির জন্য উদ্বেগজনক বলে মনে করেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা। সাবেক একজন পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, চাপ ও উদ্বেগের বিষয় যে রয়েছে, সেই বাস্তবতাকে অস্বীকার না করে সরকারের কৌশল ঠিক করা উচিত।
মোদির আলোচনায় থাকছে বাংলাদেশ
এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তৌহিদ হোসেন উল্লেখ করেন, এই অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রভাব সৃষ্টির চেষ্টা বেড়েছে। আর এই ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে প্রধান দলগুলোর মধ্যে বিরোধ রয়েছে। এই পরিস্থিতির সুযোগেই যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলছে। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশি কূটনীতিকদের আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক বা দৌড়ঝাঁপ চোখে পড়ছে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে চীন বড় অংশীদার। ফলে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের দৌড়ঝাঁপের প্রেক্ষাপটে চীনও তৎপর হয়েছে। র্যাবের সাতজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা, গণতন্ত্র সম্মেলনে আমন্ত্রণ না জানানো এবং ভিসা নীতিতে বিধিনিষেধ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এসব পদক্ষেপের সুযোগ নিয়ে চীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছে। সে কারণে বাংলাদেশ চীনের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়বে কি না—সেই প্রশ্ন উঠেছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে মন্ত্রীদের নানা বক্তব্যে সরকারের অস্থিরতা প্রকাশ পাচ্ছে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলছেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক দেশ যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব থেকে বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন হতে চায় না। সে কারণে সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন নিরসনের চেষ্টা শেষ পর্যন্ত করে যাবে।
এমন অবস্থানের সমর্থনে দুজন মন্ত্রী বলেন, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কৌশলগত। আর ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের সম্পর্ক রয়েছে। ফলে ভারত পরিস্থিতি সামলাতে সরকারের পাশে থাকবে। চীনও পাশে থাকবে আওয়ামী লীগ সরকারের। কিন্তু চীনের প্রতি পুরোপুরি ঝুঁকে পড়ার সম্ভাবনা নেই। চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সীমা অতিক্রম যাতে না করে, সে বিষয়ে সরকার সতর্ক। এ বিষয়টি ভারতের জন্যও বিশেষভাবে স্পর্শকাতর।
যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে বিভিন্ন বৈঠকে আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে দলটির তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক সেলিম মাহমুদ অংশ নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ভারতের উত্তর–পূর্বের রাজ্যগুলোর নিরাপত্তা প্রশ্নে আওয়ামী লীগ সরকারের ভূমিকাকে ভারত অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। বন্ধুত্বের বিভিন্ন ইস্যুর মধ্যে নিরাপত্তা ইস্যুতে দুই পক্ষেরই স্বার্থ একই। ফলে ভারত আওয়ামী লীগ সরকারের পাশে থাকবে বলেই আমরা বিশ্বাস করি।’
কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ভারত এখনো বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে বিএনপিকে বিবেচনা করে না। ভারতও নিজেদের স্বার্থে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের পাশে থাকবে বলেই তাঁদের বিশ্বাস।
আওয়ামী লীগ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি ঘোষণার পর পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে ভারত প্রকাশ্যে কোনো বক্তব্য দেয়নি। তবে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক পর্যায়ে কথাবার্তা হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যুক্তরাষ্ট্র সফরে বাংলাদেশের পক্ষে বরফ গলানোর চেষ্টা করবেন বলে কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন থেকে বেরিয়ে আসতে সরকার নিজেদের মতো করে কৌশল ঠিক করছে। এর অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী বাংলাদেশি যাঁদের সেখানকার কমিউনিটিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাব রয়েছে, তাঁদের মধ্যে যাঁরা আওয়ামী লীগের সমমনা বা সমর্থন করেন, তাঁরা সংগঠিত হয়ে কংগ্রেসম্যানদের চিঠির জবাব দিচ্ছেন।
প্রবাসী সংখ্যালঘুরাও কংগ্রেসম্যানদের কাছে চিঠি দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে বক্তব্য তুলে ধরছেন। বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মানবাধিকার ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার খর্ব হওয়ার যেসব অভিযোগ কংগ্রেসম্যানরা করেছেন, চিঠিতে এসব খণ্ডন করে সরকারের পক্ষে যুক্তি দেওয়া হয়েছে। সরকার যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করেছে বলেও জানা গেছে।
নির্বাচনমুখী সরকার
নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা কয়েকটি দেশের পদক্ষেপের পেছনে ষড়যন্ত্রও দেখছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। আর সে ক্ষেত্রে তাঁদের অভিযোগের তির মূলত বিরোধী দল বিএনপির দিকে। যদিও বিএনপি নেতারা অভিযোগ অস্বীকার করছেন।
ক্ষমতাসীন দলের অন্য একাধিক সূত্র বলছে, দেশের ভেতরে ও বাইরে থেকে সরকারের ওপর চাপ আরও বাড়াতে পারে। এ ধরনের চেষ্টায় কোনো পক্ষ থেকে সংবিধান ও রাজনীতির বাইরে অন্য কিছু করার চিন্তা থাকতে পারে, এই সন্দেহও রয়েছে সরকার ও আওয়ামী লীগের ভেতরে।
সে জন্য যুক্তরাষ্ট্রের চাপ কমানো সম্ভব না হলেও যথাসময়ে নির্বাচন করার অবস্থান থেকে কোনোভাবেই পিছপা হবে না সরকার। নির্বাচনে বিএনপি না এলে জামায়াতসহ অন্য দলগুলোকে নির্বাচনমুখী করার কৌশলও সরকারের ভাবনায় রয়েছে।
২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন যে আর করা যাবে না, সেই আলোচনাও সরকার এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে রয়েছে। তবে বিএনপি এবার ভোটে না এলে সরকার কীভাবে এগোবে, সেই কৌশল এখনো স্পষ্ট নয়।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী ফোরাম সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমরা সংবিধানের বাইরে যাব না। সংবিধান অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন করাই আমাদের এখন প্রধান লক্ষ্য।’