মহাসমাবেশের পর ঢাকার চার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি নিয়ে দলে ভিন্নমতও ছিল।
অনেক নাটকীয়তার পর কম সময়ের প্রস্তুতিতে ২৮ জুলাই ঢাকায় মহাসমাবেশ করেছিল বিএনপি। পরদিন শনিবার ছিল রাজধানীর চার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি। এক দিন আগে যে বড় মহাসমাবেশ হয়েছিল, তার প্রভাব কমই ছিল এই কর্মসূচিতে। উপস্থিতি ছিল কম।
বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একাধিক নেতাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অবস্থান কর্মসূচি ঘিরে দলে ছিল সমন্বয়হীনতা। ফলে বড় মহাসমাবেশের পর রাজধানী ঢাকাকে ঘিরে পাঁচ ঘণ্টা অবরোধের যে অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়, কার্যত গত শনিবার তেমন কর্মসূচি হয়নি। অন্যদিকে একের পর এক মহানগর, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও বিভাগীয় পর্যায়ে নানা কর্মসূচি শেষে ঢাকায় মহাসমাবেশের পর আবার নতুন করে আজ সোমবার জেলা ও মহানগরে জনসমাবেশ কর্মসূচি নিয়েও মাঠপর্যায়ে প্রশ্ন উঠেছে। এর মাধ্যমে নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশা জাগতে পারে বলেও মনে করছেন অনেকে। কারণ, এক দফা আন্দোলনের চূড়ান্ত ধাপে এসে সারা দেশের নেতা-কর্মীদের চাওয়া ছিল ঢাকাকেন্দ্রিক কর্মসূচি।
মাতুয়াইল, ধোলাইখাল ও উত্তরায় পুলিশ-বিএনপি সংঘর্ষ
অবশ্য বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘এটা আন্দোলনের কর্মসূচি নয়। এটা হচ্ছে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা যৌথভাবে যে হামলা-সহিংসতা করেছে, তার প্রতিবাদ কর্মসূচি। এ ঘটনার প্রতিবাদ শুধু ঢাকায় করলে হবে না, দেশবাসীকে জানাতে হবে। আন্দোলনের কর্মসূচি আমরা এখনো দিইনি।’
‘দায়সারা’ অবস্থান কর্মসূচি
এই মুহূর্তে সারা দেশে আলোচনার কেন্দ্রে গত শনিবারের ঢাকার অবস্থান কর্মসূচি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক, এমনকি বিএনপির সাধারণ কর্মী-সমর্থকদের অনেকের মূল্যায়ন হচ্ছে, গত শুক্রবার ঢাকার মহাসমাবেশ বিএনপির নেতা-কর্মীসহ সাধারণ সমর্থকদের মনোবল ও সাহস যতটা উজ্জীবিত করেছিল, পরদিন ঢাকার চার প্রবেশমুখে ‘দায়সারা’ অবস্থান কর্মসূচি মহাসমাবেশের অর্জনকে অনেকটাই দুর্বল করে দিয়েছে। ফলে মহাসমাবেশের আলোচনার চেয়ে এখন অবস্থান কর্মসূচির নানা দুর্বলতাই সামনে আসছে। এটাকে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর সরকার পতনের ‘এক দফা’ আন্দোলনের জন্য একটি ‘ধাক্কা’ হিসেবে দেখছেন পর্যবেক্ষকদের অনেকে।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান, উপদেষ্টাসহ পাঁচজন নেতার সঙ্গে কথা হয়। সবাই স্বীকার করেন যে অবস্থান কর্মসূচিতে বড় রকমের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। তবে সেটি সাংগঠনিক দুর্বলতা, নেতৃত্বের কোনো অংশের সমন্বয়হীনতা নাকি অন্য কিছু, সেটিই এখন মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের একটি বড় অংশের কাছে জিজ্ঞাসা হয়ে উঠেছে। এত বড় মহাসমাবেশের পরদিন কেন চারটি স্থানে অবস্থান কর্মসূচিতে হাজার হাজার নেতা-কর্মীর উপস্থিতি হলো না, এর নেপথ্য কারণ কী—সেটি নিয়ে দলের ভেতরে–বাইরে নানা কথা হচ্ছে।
যদিও বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলছেন, মহাসমাবেশের পরদিন যে উদ্দেশ্যে তাঁরা ‘অবস্থান’ কর্মসূচি দিয়েছিলেন, সেটি অনেকটাই অর্জিত হয়েছে। তাঁরা দেখতে চেয়েছেন, নির্বাচন সামনে রেখে যখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি নিবন্ধিত, সে সময় এক দফা দাবির অবস্থান কর্মসূচি ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী লীগ কী ধরনের আচরণ করে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিদেশিদের সরকার আশ্বস্ত করছে যে তারা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করবে। তারা বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের কোনো ধরনের রাজনৈতিক নিপীড়ন করছে না। এর বিপরীতে বিএনপি দেখাতে চেয়েছে, বিরোধীদের রাজনৈতিক কর্মসূচির অধিকার দিচ্ছে না সরকার। এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত ঢাকার অবস্থান কর্মসূচি। পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের হামলায় বিএনপির নেতা-কর্মীরা নির্দিষ্ট অবস্থানে উপস্থিত হয়েও কর্মসূচি পালন করতে পারেননি।
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্যসচিব আমিনুল হক বলেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি করতে চেয়েছি। পুলিশ ও আওয়ামী লীগ যৌথভাবে আমাদের আঘাত করেছে। কী নৃশংসভাবে আওয়ামী লীগ রড, হকিস্টিক, লাঠি, চাপাতি, দা, ছুরি নিয়ে হামলা করেছে, সেই দৃশ্য সব মিডিয়া দেখেছে, কিন্তু কেউ দেখাতে পারেনি।’
‘সরকারের নাটক’
বিএনপির নেতারা মনে করছেন, অবস্থান কর্মসূচিকে ঘিরে সরকার হামলা-মামলা ও বাস পোড়ানোর মতো পুরোনো কৌশলের পাশাপাশি এবার মারধর করে আপ্যায়ন করার নতুন কৌশলও প্রয়োগ করেছে। এই কর্মসূচি থেকে বিএনপির দুজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও আমানউল্লাহ আমানকে পিটিয়ে তুলে নিয়ে গিয়ে পরে আবার তাঁদের আপ্যায়ন করা হয়। দলটির নেতারা বলছেন, এটা যে সরকারের নতুন নাটক, তা মানুষ বুঝেছে। সরকারের এই কৌশল মানুষ গ্রহণ করেনি।
বিএনপির আমানের জন্য হাসপাতালে খাবার ও ফল পাঠালেন প্রধানমন্ত্রী
গত শনিবার রাতে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ বিষয়টাকে মার্কিন নতুন ভিসা নীতির একটা পরিণতি বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, নিজেদের (সরকার) রক্ষা করার জন্য, নিজেদের নিরপরাধ প্রমাণ করার জন্য এ ধরনের নাটক তারা সাজিয়েছে।
আর ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনারের (ডিবির দায়িত্বে) আপ্যায়নের দৃশ্য ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়াকে নিম্ন রুচির নাটক বলে মন্তব্য করেন গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। তিনি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, ‘ঈশ্বরের কাছে আমার প্রার্থনা, চিতায় ওঠার আগে যেন এই সরকারের পতন দেখে যেতে পারি।’
কর্মসূচি নিয়ে মতভিন্নতা ছিল
দায়সারা ভাব, সমন্বয়হীতার পাশাপাশি মহাসমাবেশের পরদিনই ঢাকার অবস্থান কর্মসূচি নিয়ে দলে ভিন্নমত ছিল বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। কিন্তু দলের শীর্ষ নেতৃত্ব এই কর্মসূচি চেয়েছিলেন। মূলত অবস্থান কর্মসূচি দুর্বল বা যথাযথভাবে পালন না হওয়ার পেছনে এটিই অন্যতম কারণ বলছেন কেউ কেউ। বিশেষ করে বিএনপির ঢাকা মহানগরীর পাশাপাশি জাতীয়তাবাদী যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল এই কর্মসূচিতে যে ধরনের সহযোগিতা দেওয়ার কথা ছিল, সেটি বাস্তবে হয়নি।
গয়েশ্বর বললেন, আপ্যায়ন করে ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া ন্যক্কারজনক
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কারও কারও মত ছিল এখনই অবস্থান কর্মসূচি না দেওয়া। তাঁদের যুক্তি ছিল, মহাসমাবেশের কর্মসূচিতে সারা দেশ থেকে আসা নেতা-কর্মীরা ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত। অনেকে তিন দিন ধরে ঢাকায় এখানে-ওখানে রাত কাটান। এই যুক্তিতে তাঁরা এখন এমন কর্মসূচি না দেওয়ার মত দিয়েছিলেন। এর প্রভাব পড়ে কর্মসূচিতে। উচ্চপর্যায়ের নেতাদের অনেকে কর্মসূচি নিয়ে কিছুটা উদাসীন ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। কোন নেতা কোন প্রবেশমুখের কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেবেন, সেটিও অনেক রাত পর্যন্ত ঠিক করা হয়নি। আবার স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যানসহ জ্যেষ্ঠ নেতাদের যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, অনেকে সেটা পালন করেননি।
অবশ্য বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, ‘অবস্থান কর্মসূচিতে যা হয়েছে সেটা হতাশ হওয়ার মতো, কিন্তু আমরা হতাশ নই।’