ইতিহাস শোয়া মানুষকে দাঁড় করিয়ে দেয় না। শোয়া থেকে উঠে দাঁড়াতে হয় নিজের জোরে। শুধু দাঁড়ানো লোককেই ইতিহাস তুলে নেয় না। নিজের যোগ্যতায় মাটির পদাতিকদের থেকে কিছুটা ওপরে উঠতে হয়। সেই উত্থিত মানুষের ওপরই ভর করে ইতিহাস। তাকে তুলে নেয় ইতিহাসের যানে। বিএনপি চাইছে ইতিহাসের সেই সুযোগটা নিতে। তার জন্য আগে তাকে দাঁড়াতে হবে। এতদিন বিভিন্ন জনপদে ঢাকঢাক গুড়গুড় আয়োজন চলেছে। এখন ঢাকায় বড় মহাসমাবেশ নিয়ে তারা দাঁড়াতে চাইছে ক্ষমতার সম্মুখে। তৈরি করতে চাইছে নতুন ইতিহাস।
কিন্তু পুলিশ বেজায় বেরসিক। তারা বেছে বেছে মিহি চালাকিটাই করল। বলল, ছুটির দিন ছাড়া আন্দোলন করা যাবে না। বিএনপি কি তাদের বোঝাতে পারবে– দরখাস্ত করে ক্যালেন্ডারে ছুটির লাল শুক্রবার দেখে সংগ্রাম করা যায় না। সংগ্রামের নিজস্ব গতি আছে। সেই গতির সঙ্গেই তাল মিলিয়ে ছুটতে হবে ক্যালেন্ডারকে। সেই গতি এখনও আসেনি আন্দোলনে।
আইন অমান্য করে, পুলিশি নিষেধাজ্ঞা উড়িয়ে দিয়ে মহাসমাবেশ করতে পারবে না বিএনপি। মার্কিন ভিসা নীতি, র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের তদবির তাহলে বিগড়ে যেতে পারে। বিদেশিরা চান বিএনপি অহিংস ও নিয়মতান্ত্রিক পথে চলুক। বিএনপি নিজে যে ব্যারিকেড সরাতে পারেনি; সেটা অনেকটা সরিয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক চাপ। কিন্তু শেষ খেলাটা খেলতে হবে তাদেরই। বুদ্ধির কৌশল আর জনতার বাহুবলকে মোক্ষম কায়দায় বিনিয়োগ করার চ্যালেঞ্জ এখন দলটির সামনে।
তবে স্বীকার করতেই হবে, বিএনপি ছন্দ ফিরে পেয়েছে। দলের কর্মসূচিকে গোছানো এবং অহিংস চেহারায় এখন পর্যন্ত রাখতে পেরেছে তারা। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের দিকে আন্দোলনকে নিয়ে যেতে হলে চেনা পথের বাইরে যেতে হবে দলকে। যে সরকার পতনের আন্দোলনের কথা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলছেন, সেটা কোনো গোলাপজল ছিটানো সাজানো মাহফিল না। মাও সেতুং বলেছিলেন, বিপ্লব কোনো ভোজসভা না।
তবে একটা দিক থেকে তারা ক্ষমতাসীন দল এবং প্রশাসন থেকে এগিয়ে। গত ছয় মাসের রাজনৈতিক সহিংসতায় ৩০ জনের মতো মানুষ নিহত হয়েছে। এর বড় অংশই বিএনপির লোক। মামলা হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার। আসামির সংখ্যা বেশুমার। তারপরও বিএনপি প্রতিরোধে নেমে পড়েনি। ঘেরাও, হরতাল বা অবরোধ দেয়নি। জাতিসংঘ, মার্কিন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা এসব খেয়াল রাখছেন, হিসাবে রাখছেন। মানুষের কাছেও এই সংযম সমাদর পাচ্ছে।
ফলে বল এখন সরকারের কোর্টে। কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ আছে; বিএনপির এক দফার হুমকি আছে। সরকারকেই ঠিক করতে হবে– দেশি-বিদেশি চ্যালেঞ্জ তারা কীভাবে প্রশমিত করবে; তারা কীভাবে খেলবে; সেই খেলার নিয়ম কী হবে।
কার হাতে প্রথম রক্ত লাগবে– সেটাই এখন প্রশ্ন। রক্তপাত কিছু হয়েছে; ঢাকার বাইরে। কিন্তু মাহেন্দ্রক্ষণের অখণ্ড মনোযোগ সেসব পায়নি। মার্কিন ভিসা নীতি, আন্তর্জাতিক আগ্রহ এবং জনমতের চাপ দুটি দল এবং তাদের মিত্রদের অহিংস থাকতে বলছে। মিডিয়ার চাপও আছে। তাই বিএনপি অসুবিধাকে সুবিধা বানিয়ে ফেলেছে। মার খেয়েও অহিংস থেকে উল্টো সরকারকেই চাপে ফেলেছে। সেই চাপ কাটাতে ক্ষমতাসীনরা কি বিএনপির জনস্রোত রুখে দেবে? বিএনপির পছন্দের জায়গায় পছন্দের দিনে সমাবেশ করতে না দেওয়া তো তারই লক্ষণ। মামলা তো হচ্ছেই, সরাসরি রাজপথে হামলা-নির্যাতন কি আর আগের মতো করা যাবে? যদি সরকার চূড়ান্ত কঠোর হয়, তাহলে নৈতিক বিজয় হবে বিএনপির। নিজেদের ওপর সহিংসতার কলঙ্ক যে চেপে আছে, তা থেকে মুক্ত হওয়া তাদের খুবই প্রয়োজন। প্রয়োজন সরকারকে মানবাধিকারের নির্দয় লঙ্ঘনকারী হিসেবে প্রমাণ করা।
সরকারই আক্রমণাত্মক, ক্ষমতাসীনরাই শান্তি ভঙ্গকারী– এটা প্রমাণ করা গেলে বিএনপির নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির ভিত মজবুত হয়। গণতন্ত্রকামী দেশি-বিদেশি শক্তি এবং জনমত তাদের কোলে চলে আসবে তখন। শুরুতে বলা ইতিহাসের সুযোগটা তখন তাদের নাগালে চলে আসতে পারে। যে পদ্ধতিতে বিএনপির জন্য আন্দোলনের মাঠ কিছুটা নিরাপদ করা গিয়েছিল, সেই পদ্ধতিগুলো তখন তাদের পক্ষে কাজ শুরু করতে পারে। সেই পর্যন্ত বিএনপিকে জমায়েত দিয়ে, জনগণের ওপর প্রভাবের প্রদর্শনী দিয়ে জোরদারভাবে মাঠে থাকতে হবে।
সরকারও বিচক্ষণ বটে। তারা আন্দোলনের পালে হাওয়া কাড়তে আগাম নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে পারে। মুশকিল হলো, একবার নির্বাচনী তপশিল ঘোষিত হয়ে গেলে সেটা ঠেকানো কঠিন। আন্দোলনকারী অনেকে, দলের মাঠ পর্যায়ের অনেকের মনে তখন সংসদীয় আসনের লোভ লকলকিয়ে উঠতে পারে। আলগা হয়ে যেতে পারে সংগ্রামের জোট। এভাবে বিরোধীদের রাজপথে দাঁড় করিয়ে রেখেই সরকার যেনতেনভাবে নির্বাচন করিয়ে নিতে পারে। বাংলাদেশে ভোট বর্জনে নির্বাচন ঠেকে থাকে না। এরশাদের নির্বাচন বিএনপি বর্জন করেছিল; তারপর আরও তিন বছর এরশাদ ক্ষমতায় থেকেছেন। বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে কামিয়াব হয়নি। সুতরাং, তাদের যা করতে হবে তা করতে হবে তপশিল ঘোষণার সুযোগ না দিয়েই। এর জন্যই আন্দোলনের ভর ও বেগ দ্রুতই বাড়াতে হবে তাদের।
চতুর প্রশাসন সে জন্যই বোধ হয় বৃহস্পতিবারের সমাবেশ শুক্রবারে নিতে বলছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বদলে তাদের প্রান্তের দিকে অর্থাৎ গোলাপবাগের মাঠে আটকাতে চাইছে। এখনই প্রশাসনের সঙ্গে সংঘাতে যেতে না চাওয়া বিএনপি তাই বেকায়দাতেই পড়েছে।
তাহলেও মূল পরিস্থিতি একই থাকছে। বিএনপি আগে হোক বা পরে, ঢাকার রাজপথে ঢল নামানোর মরিয়া পদক্ষেপ নেবেই। ডান-বাম ও মধ্যপন্থিদের ভালো একটি অংশও বসে থাকতে পারবে না। যুগপৎ আন্দোলনের সেই ঢেউকে বল প্রয়োগ করে দমানো ছাড়া সরকারের তরফে আর কী উপায় থাকতে পারে?
বল প্রয়োগ হবেই। পাল্টা বল প্রয়োগও এড়ানো যাবে না। বাংলাদেশের ইতিহাস সেটাই বলে। কিন্তু যে আগে খেলার নিয়ম ভেঙে রক্ত ঝরাবে, বেকায়দায় পড়ার আশঙ্কা তারই বেশি।
এসব দেখে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের সেই গল্পর কথা মনে পড়ছে। এই গল্পটা ব্যবহার করে এই লেখক এ রকম একটা আশঙ্কার কথা লিখেছিলেন ২০০৬ সালে জরুরি অবস্থা ঘোষণার কয়েক দিন আগে। গল্পটা এমন: ঠিক দুপুর বেলা। পেটপুরে খেয়ে এক হুলো ফুটপাতে ঘুমাচ্ছে। কোথা থেকে এক ইঁদুর এসে তার গোঁফ ধরে টানতে লাগল। বিরক্ত বিড়াল বাঁ চোখ মেলে জিজ্ঞাসা করে, ‘কী চাই?’
ইঁদুর বলে, ‘আজ্ঞে, আপনি আমাকে খান।’
: আরে আমার পেট ভরা। আর নিতে পারব না রে।
এ কথা বলেই সে আবার নাক ডাকাতে লাগল। কিন্তু ইঁদুর নাছোড়বান্দা। আবার বিড়ালকে খোঁচা: না, ‘আমাকে আপনার খেতেই হবে।’
তাচ্ছিল্যের চাহনি মেরে একটু সরে গিয়ে আবার চোখ বুজল বিড়াল। এবার ইঁদুর বিড়ালের লেজ ধরে টানে। বিরক্ত হলেও বিড়ালের মনে করুণা জাগ্রত হলো। বলল, ঠিক আছে খেতে পারি, তবে শর্ত আছে। ওই যে দেখছ অন্ধ বালকদের স্কুল। এই আমি ফুটপাতে লেজ ফেলে রাখলাম। একটু পরে স্কুল ছুটি হবে। ওই বালকদের কেউ যদি ভুল করে আমার লেজে পা দেয়, তাহলে আমি তোমাকে খাব।
সব শুনে ইঁদুর বলল, আমারও একটা এক দফা শর্ত আছে। আপনি হাঁ করে ঘুমাবেন আর আমি আমার মাথাটা আপনার মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখব। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। লেজে পা পড়লেই আপনি আমাকে গপ করে খেয়ে ফেলবেন। ধরা দেওয়াই এখন ইঁদুরের কৌশল। বিড়ালটারও পেট ভারী, কতটা হজম করতে পারবে ঠিক নেই। তাই সে হাঁ করে ঘুমাল। সেই হাঁর মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল ইঁদুর। অন্ধদের স্কুল কখন ছুটি হবে?
রাজনীতির টম অ্যান্ড জেরির খেলায় এখন ইঁদুরই চায় বিড়াল দাঁত বের করুক। বিড়াল কি নিজেকে সামলাতে পারবে?
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক এবং সমকালের পরিকল্পনা সম্পাদক