প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে মানুষ রাজধানী ছাড়ছেন। শেষ মুহূর্তে ভোগান্তি ছাড়াই এবার সড়ক-নৌ-রেলপথে ঈদযাত্রা করছেন ঘরমুখো মানুষ। শনিবার (২৯ মার্চ) সন্ধ্যা থেকে রোববার (৩০ মার্চ) দেশের চারটি মহাসড়কের কোথাও বড় ধরনের যানজটের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। অধিকাংশ ট্রেনই সময় মেনে ছেড়ে যাচ্ছে। লঞ্চেও মানুষের চাপ থাকলেও সেভাবে ভোগান্তি হচ্ছে না।
রোববার (৩০ মার্চ) সকাল ৮টা থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ঘুরে দেখা যায়, রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রী সিরাজুল ইসলাম পরিবার নিয়ে ঈদ উদযাপন করতে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, আমি ৯ বছর ঢাকায় চাকরি করছি। ঈদে সবসময় ট্রেনে যাতায়াত করি। আগে কখনো কমলাপুর স্টেশনে এত সুশৃঙ্খল পরিস্থিতি দেখিনি। পৌনে ৯টায় স্টেশনে এসেছি৷ এসেই প্ল্যাটফর্মে ট্রেন দাঁড়ানো পেয়েছি। ব্যাগ-পত্র নিয়ে উঠে বসলাম। এখন দেখছি ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে। একেবারে জাস্ট টাইম। বাসায় যাওয়ার আগেই খুশিতে মন ভরে গেলো।
রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানান, ঈদযাত্রার সপ্তম দিনে রোববার সকাল থেকে নির্ধারিত সময়ে সব ট্রেন গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে গেছে। আন্তঃনগর ট্রেনে কোনো শিডিউল বিপর্যয় নেই। এমনকি কমিউটার ও লোকাল ট্রেনগুলোও যথাসময়ে ছেড়ে যাচ্ছে। শুধু কর্ণফুলী কমিউটার ট্রেনটি ১১ মিনিট দেরিতে ছেড়েছে আজ।
স্টেশন মাস্টারের দেওয়া তথ্যমতে, সকাল সাড়ে ৯টায় দেওয়ানগঞ্জ ঈদ স্পেশাল, পৌনে ১০টায় তিতাস কমিউটার, ১০টায় জামালপুর এক্সপ্রেস, সোয়া ১০টায় একতা এক্সপ্রেস এবং সাড়ে ১০টায় কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেন ছেড়ে যাবে। সবগুলো ট্রেন এখন কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে রয়েছে। ফলে দেরি হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।
সকাল থেকে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনগুলো হলো- ধূমকেতু, পর্যটক, পারাবত, নীলসাগর, সোনার বাংলা, তিস্তা, মহানগর প্রভাতী, মিঠাপুকুর প্রভাতী, সুন্দরবন, মহুয়া, বুড়িমারী, কর্ণফুলী, রংপুর এক্সপ্রেস ও তিতাস কমিউটার। আজ সকাল থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত কমলাপুর থেকে মোট ৫১টি ট্রেন সারাদেশে গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যাবে।
এদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের যাত্রীরা বড় ধরনের ভোগান্তি ছাড়াই গতকাল নারায়ণগঞ্জ পাড়ি দিয়েছেন। ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক হওয়ায় যাত্রীরা খুশি।
অন্যান্য বছরের অভিজ্ঞতা থেকে ভোগান্তির শঙ্কা নিয়ে শনিবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থেকে সাইনবোর্ডে এসেছিলেন; কিন্তু রাস্তায় বেরিয়ে কোনোরকম ভোগান্তিতে না পড়ায় স্বস্তি প্রকাশ করেছেন রাজিয়া। তিনি বলেন, বাচ্চাদের নিয়ে এত সহজে বাসে উঠতে পারব ভাবি নাই। খুব ভালো লাগছে।
রোববার সকাল থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড ও শিমরাইল এলাকায় সরেজমিনে যাত্রীদের ভোগান্তি চোখে পড়েনি৷
ঈদ উপলক্ষে সড়কে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে যাত্রী ও পরিবহনের চাপ বেশি থাকলেও গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক দুটির নারায়ণগঞ্জ অংশে রোববার যানজট দেখা যায়নি। তবে এক লেন থেকে ছয় লেনে উন্নীত করার কাজ চলমান থাকায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে থেমে থেমে চলছিল যানবাহন৷ এ সময় মহাসড়ক দুটিতে হাইওয়ে পুলিশের পাশাপাশি আনসার সদস্যদের তৎপরতা দেখা গেছে৷
শিমরাইল হাইওয়ে ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক আবু নাঈম সিদ্দিকী বলেন, যাত্রীদের ভোগান্তিহীন ঈদযাত্রা নিশ্চিত করার বিষয়টি দেশের মানুষের প্রতি আমাদের ঈদের উপহার। যাত্রীদের হাসিমুখ দেখলে পুলিশ ও আনসারদের পরিশ্রম আর গায়ে লাগে না।
ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলের পথে দিনভর স্বস্তির যাত্রার পর শনিবার সন্ধ্যার পর থেকে ঘরমুখী মানুষ আর যানবাহনের ভিড় বেড়েছে। এতে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের চন্দ্রা এলাকার তিন দিকে যানবাহনের ধীরগতি রয়েছে। সেখানে থেমে থেমে যানবাহন চলছে।
নাওজোড় হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি, রইছ উদ্দিন বলেন, ইফতারের সময় পুলিশ সদস্যরা ইফতার করতে যাওয়ায় যানবাহনের কিছুটা বিশৃঙ্খলা হয়। তখন যানবাহনের কিছুটা ধীরগতি সৃষ্টি হয়। তবে ইফতারের পর আবার স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে।
এদিকে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢাকা–ময়মনসিংহ মহাসড়কের চান্দনা চৌরাস্তায় কিছুটা জটলা ও যানবাহনের ধীরগতি থাকলেও যানজটের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
শিল্প ও হাইওয়ে পুলিশ জানায়, শিল্প–অধ্যুষিত গাজীপুরে ২ হাজার ১৭৬টি নিবন্ধিত কলকারখানা। এর মধ্যে ১ হাজার ১৫৪টি পোশাক কারখানা। এসব কারখানায় কাজ করেন কয়েক লাখ কর্মী। শুক্রবার পর্যন্ত ১ হাজার ৪৭৯টি কারখানা ছুটি হয়েছে। এসব কারখানা ছুটি হওয়ার পর শ্রমিকেরা বাড়ি ফিরতে শুরু করেছেন।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম প্রবেশদ্বার পদ্মা সেতু এলাকায় ঈদে ঘরমুখী মানুষ ও যানবাহনের চাপ দুই দিন ধরে অব্যাহত আছে। শনিবার সকাল থেকে এক্সপ্রেসওয়ে ও সেতু এলাকায় যানবাহনের চাপ ছিল। তবে কোনো রকম ভোগান্তি ছাড়াই স্বস্তিতে পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে গন্তব্যে যেতে পারছেন এ পথের যাত্রীরা। পদ্মা সেতু দিয়ে ৩৯ হাজার ৬৩৭টি যানবাহন পারাপার হয়েছে।
এদিকে যমুনা সেতুর ওপর দুর্ঘটনা, গাড়ি বিকল ও অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ বেড়ে ঢাকা-টাঙ্গাইল-যমুনা সেতু মহাসড়কের টাঙ্গাইলের ১৩ কিলোমিটার অংশে থেমে থেমে যানজট ও ধীরগতি সৃষ্টি হয়েছে।
শনিবার (২৯ মার্চ) দিবাগত রাত ৩টা থেকে মহাসড়কের এলেঙ্গা থেকে যমুনা সেতুপূর্ব পর্যন্ত ধীরগতি রয়েছে। এতে এ সড়ক দিয়ে ঘরমুখো মানুষ ভোগান্তিতে পড়েছেন কিছুটা।
এদিকে অতিরিক্ত গাড়ির চাপ সামাল দিতে মধ্যরাতে ও সকালে যমুনা সেতুর ঢাকাগামী লেন বন্ধ করে দিয়ে একযোগে ১৮টি বুথে টোল আদায় করে উত্তরগামী যানবাহন পারাপার করছে সেতু কর্তৃপক্ষ।
সেতু কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, রাতে সেতুর ওপর তিনটি গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হয়। অন্যদিকে দুইটি গাড়ি বিকল হয়ে পড়ে। পরে এসব গাড়ি সরিয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগায় ধীরগতির সৃষ্টি হয়। যানজট নিরসনে রাতে ও সকালে দুই দফায় ঢাকাগামী যানবাহনগুলো সিরাজগঞ্জ প্রান্তে আটকে দিয়ে উভয় প্রান্তের ১৮টি বুথ দিয়ে টোল আদায় করা হয়।
অন্যদিকে পুলিশ জানিয়েছে, সেতুর ওপর দুর্ঘটনা কবলিত যানবাহন সরিয়ে নিতে সময় লাগায় মহাসড়কে ধীরগতি সৃষ্টি হয়েছে। যানজট নিরসনে কাজ করছে পুলিশ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যানজট নিরসন হয়ে যাবে।
ঈদযাত্রায় দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর ঘরমুখী অনেক মানুষ মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ও আরিচা ঘাট হয়ে বাড়ি ফিরছেন। তবে এবার ঈদযাত্রায় পাটুরিয়া ও আরিচা ফেরিঘাট এলাকায় যাত্রী ও যানবাহনের সেই চিরচেনা চাপ নেই। পাটুরিয়া লঞ্চঘাটে ঈদে বাড়ি ফেরা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।
নৌপথের যাত্রীদের ঢাকার সদরঘাট টার্মিনালে পৌঁছাতে যানজট ও হকারদের কারণে খানিকটা ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। গরমের মধ্যে যানজটে দীর্ঘক্ষণ বসে থেকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে অনেককে। তবে লঞ্চে ভোগান্তি ছাড়াই যাত্রীরা বাড়ি ফিরেছেন।
ঢাকার সদরঘাট টার্মিনাল সূত্রে জানা গেছে, গত শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টা থেকে শনিবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত ৬২টি যাত্রীবাহী লঞ্চ সদরঘাট টার্মিনাল ছেড়ে গেছে। আর টার্মিনালে লঞ্চ এসেছে ৬৯টি।
লঞ্চমালিকদের সংগঠন অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল সংস্থার ঢাকা নদীবন্দরের আহ্বায়ক ও এমভি ইয়াদ লঞ্চের মালিক মামুন অর রশিদ জানান, গরমের কারণে কিছু পোলাপান লঞ্চের ছাদে গিয়ে লাফাচ্ছে। তবে লঞ্চের ভেতরে খালি জায়গা আছে। যাত্রী উপস্থিতিও কম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার এ পর্যন্ত ঈদযাত্রার স্বস্তির পেছনে বড় কারণ টানা ৯ দিনের ছুটি। এ ছাড়া মহাসড়ক, টার্মিনাল ও রেলস্টেশনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতাও বাড়ানো হয়েছে।
পরিবহন–বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদীউজ্জামান বলেন, ঈদের আগের তিন–চার দিনে ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকা থেকে ১ কোটি ২০ লাখ বা তারও বেশি মানুষ সারাদেশে যান। সাম্প্রতিক সময়ে সড়কে কিছুটা সক্ষমতা বেড়েছে। ছুটিও এবার লম্বা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতাও চোখে পড়ার মতো। ফলে দুর্ভোগে পড়তে হয়নি। বলা যায়, শেষ পর্যন্ত এবারের ঈদযাত্রা স্বস্তিরই হবে।