উঁচু ভিটার জমিটার দুই পাশ জোড়া গ্রামীণ বন। জমিজুড়ে ছোট ছোট ঘাসের আস্তরণ। ঘাসের ওপর বাসা করেছে নাগরবাটই পাখি দম্পতি। বাসার গড়ন অনেকটাই চায়ের কাপের পিরিচের মতো।
তবে এই পিরিচের কানা নেই, একবারে সমান। উপকরণ শুকনা, সরু ঘাসের ডাঁটি আর গাছের চিকন শিকড়। ছোট ছোট ঘাসের মধ্যে বাসাটি ক্যামোফ্লেজ হয়ে আছে। বাসায় চারটি ডিম। ডিমে বসে তা দিচ্ছে পুরুষ পাখিটি, ওটাও পারিপার্শ্বের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার।
একজন বালিকা এল ঘাসের জমিটাতে। চলে গেল বাসাটির মাত্র চার ফুট দূর দিয়ে। চতুর পাখিটা মাথা গুঁজে চুপচাপ পড়ে রইল। একটু পরই বালিকাটির মা এলেন, তিনি প্রায় বাসাটিকে মাড়িয়েই দিচ্ছিলেন। ভীত পাখি ঝট করে শূন্যে লাফিয়ে উঠল। পায়ের কাছের ডানার শব্দে ভয় পেলেন তিনি।
দ্রুত সরে গেলেন। হাসি পেল তাঁর নাগরবাটই পাখির মাথা নিচু করে পিল পিল পায়ে পালানোর দৃশ্য দেখে। দেখলেন ডিম চারটিকে। না, মেয়েটিকে দেখানো যাবে না। যেকোনো পাখির ডিম-ছানা চুরি করা মহা অন্যায়। কয়েক পা এগোলেন তিনি সামনে, অমনি পাখিটি আবার মাথা গুঁজে পিল পিল পায়ে এসে বসে গেল ডিমের ওপর ভদ্রমহিলার দিকে মুখ করে। কেননা, তিনি আবার আসতে পারেন!
মাটির ওপর দিয়ে দৌড়বিদ পাখিদের মধ্যে নাগরবাটই অন্যতম সেরা। চতুর, বুদ্ধিমান ও আত্মগোপনে অতিশয় পারদর্শী। মাটির ওপরই বৃত্তাকার বাসা তৈরি করে এরা।
খোলা মাঠে মাটির ওপর বাসা করে লাল লতিকা হট্টিটি, হলুদ লতিকা হট্টিটি, চরটিটি বা গাঙটিটি। লাল লতিকা খোলা মাঠের মাটির ওপর ছোট ছোট মাটির ঢেলা, ইটের ছোট ছোট টুকরা ইত্যাদি দিয়ে বাসা বানায়। তবে নিরিবিলি ছাদেও বাসা করে। ছাদে বাসা করে ছোট ছোট গোলাকার নুড়িপাথর বিছিয়ে। সে বড় চমত্কার ভাস্কর্য যেন! এ রকম বাসা আমি একাধিকবার দেখেছি।
হলুদ লতিকারাও বাসা করে খোলা মাঠে। উপকরণ মাটির ঢেলা বা মরা গুগলি, শামুক, আপেল শামুকের খোল। চরটিটি বা গাঙটিটিরা নদীচর, বালুময় ফাঁকা জায়গা, নুড়িপাথরে ভরা স্থান ও খাঁড়ির বালুতটে ছোট ছোট নুড়িপাথর দিয়ে চমত্কার বাসা বানায়।
এই তিন প্রজাতির হট্টিটির ডিমের সংখ্যা ৩-৪ করে। প্রজননের মৌসুম বসন্ত-শরৎকাল। হট্টিটিরা অতিশয় ধূর্ত। শত্রুকে বিভ্রান্ত করে বাসার অবস্থান থেকে দূরে সরিয়ে নিতে মহা ওস্তাদ। আরও ওস্তাদ আকাশে উড়ে-ঘুরে মাটিতে থাকা ছানাদের দিকনির্দেশনা দিতে।
হট্টিটিরা নাকি আকাশ ভেঙে পড়ার ভয়ে বাসায় চিত হয়ে শুয়ে পা দুখানা ওপরে তুলে রাখে! সম্পূর্ণ মিথ্যা। তারা এই কাজ করে ইগল, বাজ ও চিলের মতো আকাশ-শত্রুদের দৃষ্টির আড়ালে থাকার জন্য, ডিম-ছানা রক্ষার জন্য; অর্থাৎ এদের বুক-পেটের রং পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। ডিম-ছানাও তা-ই।
রঙিলা চ্যাগারা মাটির ওপরই ঘাস-লতা দিয়ে বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে চারটি। অতিবিরল আবাসিক পাখি গুড়ুল্লে চ্যাগা বা ম্যালা চ্যাগারা নদীচর বা বালুভরা স্থানের সামান্য খোঁড়লে—কখনো নিজেরাও খুঁড়ে নেয়—পাতার ডাঁটি, ঘাস, লতা দিয়ে বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে চারটি। এ ছাড়া হাঁটুভাঙা, হট্টিমা, রাক্ষুসে চ্যাগা বা খরমা পাখিরা খোলা মাটিতে বা ছোট ঝোপঝাড়ের তলায় কোনো কিছু না বিছিয়েই ডিম পাড়ে দুই-তিনটি। ছোট পাখিদের মধ্যে পিপিট বা ধানপিপিট ছোট একগুচ্ছ ঘাসের ডগাজুড়ে দিয়ে শিল্পিত ও চমত্কার তাঁবুর মতো বাসা করে।
বর্ণিত সব পাখিই আমাদের আবাসিক পাখি।