২০২১ সালের ১০ আগস্ট লিওনেল মেসি যখন পিএসজিতে যোগ দিতে এলেন, প্যারিসজুড়ে তখন সাজ সাজ রব। সবার মুখে হর্ষধ্বনি। মেসির আগমনে প্যারিসের প্রতীক আইফেল টাওয়ারও সাজানো হয়েছিল বর্ণিল রূপে। তখন মনে হচ্ছিল, বার্সেলোনার সঙ্গে ২১ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার দুঃখ ভুলে প্যারিসকে খুব সহজেই আপন করে নেবেন মেসি। কিন্তু দুই বছর না পেরোতেই পুরো উল্টো চিত্র। এখন আর হর্ষধ্বনি নয়, মেসিকে দুয়োধ্বনি দিচ্ছে সমর্থকদের কট্টর অংশ।
পিএসজি প্রকল্পের প্রধান লক্ষ্য চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়। নেইমার, কিলিয়ান এমবাপ্পের পর মেসিকে সে উদ্দেশ্যেই নিয়ে এসেছিল কাতারি আমিরের মালিকানাধীন ক্লাবটি। তবে এবারও চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ ষোলো থেকেই বিদায় নেওয়ায় পিএসজিতে হতাশার কালো মেঘ। সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই মেসিকে দুয়ো দিতে থাকা ক্লাবের কট্টর সমর্থক গোষ্ঠী তাঁর বিতর্কিত সৌদি আরব সফরের পর আর তাঁকে প্যারিসেই দেখতে চাইছে না।
সৌদি সফরের জন্য ক্ষমা চেয়ে যা বললেন মেসি
পিএসজি কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়ে সৌদি সফরে যাওয়ায় দুই সপ্তাহের নিষেধাজ্ঞা কাটাচ্ছেন মেসি। এ ঘটনায় পরশু রাতে এক ভিডিও বার্তায় ক্ষমাও চেয়েছেন। নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হলে পিএসজির জার্সিতে আবার দেখা যাবে তাঁকে। তবে জুনে চুক্তির মেয়াদ ফুরোলে তিনি যে আর প্যারিসে থাকছেন না, এটা প্রায় নিশ্চিত।
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়কের পরবর্তী গন্তব্য হিসেবে দুটি ক্লাবের নাম শোনা যাচ্ছে—বার্সেলোনা ও আল–হিলাল। সাবেক ক্লাব বার্সায় এক মৌসুম খেলে প্রতিদ্বন্দ্বী ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মতো সৌদি ফুটবলে নাম লেখাবেন, এমন খবরও বেরিয়েছে। সেটা হলে ভালো।
আর যদি পিএসজি থেকে এখনই আল–হিলালে নাম লেখান, মেসি-রোনালদো ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে এসে আবারও এক বিন্দুতে মিলিত হবেন। দুজনেরই ইউরোপীয় অভিযানের শেষটায় লেখা থাকবে তেতো অভিজ্ঞতার স্বাদ।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইল জানিয়েছে, চুক্তির মেয়াদ ফুরোনোর এক মাস আগেই পিএসজি ছাড়তে চান মেসি। প্যারিসে আর মন নেই তাঁর। আগামী বছর আর্জেন্টিনার হয়ে কোপা আমেরিকায় খেলা যাতে সহজ হয়, তাই আপাতত ইউরোপেই থাকতে চাইছেন মেসি। তবে তাঁকে ফেরানো বার্সার পক্ষে খুব একটা সহজ হবে না।
পিএসজি সমর্থকদের বিক্ষোভ, মেসি-নেইমারদের বাড়ির নিরাপত্তা জোরদার
লা লিগার বেতনসীমা–সংক্রান্ত নীতি অনুযায়ী, বার্সাকে আগামী মৌসুমে নতুন খেলোয়াড় নিবন্ধন করাতে হলে হয় ২৫ কোটি ইউরো (প্রায় ৩০০০ কোটি টাকা) পারিশ্রমিক বিল কমাতে হবে অথবা সমপরিমাণ অর্থ নিজেদের রাজস্বে জমা করতে হবে। সেটিতেও ব্যর্থ হলে বিকল্প একটা পথ খোলা আছে।
অনুমোদিত স্কোয়াডের বাইরে খেলোয়াড় নিতে চাইলে লা লিগার বেতনসীমা–সংক্রান্ত নীতির ‘৪০ শতাংশ খরচের নিয়মের’ আওতায় পড়বে তারা। এই নিয়ম হলো আগে কর্তৃপক্ষকে ১১ কোটি ২৭ লাখ ইউরো আয় দেখাতে হবে। সেখান থেকে ৪০ শতাংশ বা ৪ কোটি ৫০ লাখ ইউরো খরচ করতে হবে।
এই ৪০ শতাংশ অর্থ প্রাক্–মৌসুম প্রস্তুতি ম্যাচ থেকে তুলে ফেলবে বার্সা। এবারের প্রাক্–মৌসুমে প্রস্তুতি নিতে আগামী ১৯ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রে যাবে ক্লাবটি। এদিকে আর ২ পয়েন্ট পেলেই লা লিগার শিরোপা পুনরুদ্ধার করবে জাভি হার্নান্দেজের দল।
স্প্যানিশ চ্যাম্পিয়ন হলে মার্কিন মুলুকে তাদের চাহিদা আরও বাড়বে। সে ক্ষেত্রে দলটি আরও বেশি অর্থ দাবি করতে পারবে। পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের দিকে ঝুঁকবে। তবে বার্সার এই আর্থিক ধাঁধা মেলাতে সভাপতি হোয়ান লাপোর্তাকে ভূমিকা রাখতে হবে। এত দিন এই বিষয় দেখভাল করতেন ক্লাবের ক্রীড়া পরিচালক মাতিউ আলেমানি।
মেসি বিদায় নিলে পিএসজির যত ক্ষতি
তবে বার্সা ছেড়ে এ সপ্তাহেই অ্যাস্টন ভিলায় যাচ্ছেন আলেমানি। এত নিয়মের গ্যাঁড়াকল টপকে বার্সা মেসিকে আনতে পারলেও আগের মতো বেতন দিতে পারবে না। ইউরোপীয় সংবাদমাধ্যমের দাবি, বার্সায় দ্বিতীয় অধ্যায়ে মেসির বেতন হবে আগের চার ভাগের এক ভাগ।
তবে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ছাড়া মেসিকে সব ধরনের সুযোগ–সুবিধা দেবে কাতালান ক্লাবটি। বার্সায় নাম লেখালে মেসিও থাকতে পারবেন ইউরোপের ফুটবলে, খেলতে পারবেন চ্যাম্পিয়নস লিগ। এখানে পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে সময়টাও হয়তো ভালো কাটবে তাঁর।
ওদিকে মেসির জন্য বছরে ৪৬১৯ কোটি টাকার প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে সৌদির ক্লাব আল–হিলাল, যা আল–নাসরে রোনালদোর বেতনের প্রায় দ্বিগুণ। সৌদি ফুটবলে নাম লেখালে দেশটির পর্যটন দূত হিসেবে কাজ করতেও সুবিধা হবে তাঁর। আরেকটি বিকল্পও খোলা আছে মেসির। তাঁকে ক্লাবের মালিকানার অংশ দিয়ে নিতে চায় ডেভিড বেকহামের ইন্টার মায়ামি। মার্কিন মুলুকে একটি বাড়িও কিনে রেখেছেন ৩৫ বছর বয়সী তারকা।
তবে ডেইলি মেইল বলছে, বার্সা ছেড়ে সৌদিতে গেলে মেসি শুধু টাকাই পাবেন, অন্য কিছু নয়। একদিকে নিজের সাবেক ক্লাব বার্সার টান, অন্যদিকে রোনালদোর চেয়ে বেশি আয়ের হাতছানি—মেসি কোন দিকে যাবেন, উত্তরটা আপাতত সময়ের হাতেই তুলে রাখতে হচ্ছে।