প্রতিবাদ, সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল রাজনৈতিক জীবন। ১৯৬১-৬২ সালে ইডেন কলেজের ছাত্রী সংসদের ভিপি এবং ১৯৬৩-৬৪ সালে ডাকসুর জিএস নির্বাচিত হন। পাকিস্তান আমলে একাধিকবার কারাবরণ করেছেন। তবে জেল জীবন তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। বরং রাজপথে জোরালো ভূমিকার জন্য পান ‘অগ্নিকন্যা’ তকমা।
বামপন্থী রাজনীতি দিয়ে রাজনৈতিক জীবন শুরু করা মতিয়া চৌধুরী আশির দশকে ভেড়েন আওয়ামী লীগে। যেই দলের বিরুদ্ধেও কি না তিনি একসময় সংগ্রাম করেন। নৌকায় উঠেই ভোটের মাঠে সফল হন এই রাজনীতিবিদ। ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হয়ে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য হন মতিয়া চৌধুরী। শ্বশুরবাড়ির আসন (শেরপুর-২) থেকেই ভোট করে সংসদে যান। এরপর আরও পাঁচবার এই আসন থেকে নৌকা নিয়ে পৌঁছেন মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে।
এর মধ্যে ১৯৯৬, ২০০৯ ও ২০১৪ সালে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন মতিয়া চৌধুরী। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে জাতীয় সংসদে ক্ষমতাসীন দলের তৎকালীন উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর মৃত্যুর পর ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে মতিয়া চৌধুরীকে সংসদের উপনেতা করা হয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদেও তিনি ক্ষমতাসীন দলের উপনেতার দায়িত্ব পালন করেন।
রাজপথের অগ্নিকন্যা নিষ্প্রভ ছিলেন ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়। আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা এই রাজনীতিক দায় এড়াতে পারেন না শেখ হাসিনার টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলের। তিনিও প্রশ্নবানে জর্জরিত। সরকারের শীর্ষ পদে থাকা ছাড়াও সবশেষ আওয়ামী লীগের ১ নম্বর প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন বর্ষীয়ান এই রাজনীতিক।
১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবের ৬ দফা সমর্থনে তার জোরালো ভূমিকা ছিল। এর আগের বছর ১৯৬৫ সালে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন মতিয়া চৌধুরী। দুই বছরের মাথায়, অর্থাৎ ১৯৬৭ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দেন এবং এর কার্যকরী কমিটির সদস্য হন। ১৯৭০ ও ১৯৭১ এর মাঝামাঝি সময়ে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, প্রচারণা, তদবির এবং আহতদের শুশ্রুষায় সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ছিলেন।
আওয়ামী লীগে যোগ দেয়ার পর মতিয়া চৌধুরী দলটির হয়ে বিভিন্ন আন্দোলনে রাজপথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের আমলেও কারাবরণ করেন তিনি। মোট ১৫বার জেল কেটেছেন এই রাজনীতিবিদ।
আজ বুধবার (১৬ অক্টোবর) দুপুরে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করা এ রাজনীতিবিদের জন্ম ১৯৪২ সালের ৩০ জুন, পিরোজপুরে। তার বাবা মহিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা এবং মা নুরজাহান বেগম ছিলেন গৃহিণী।
১৯৬৪ সালের ১৮ জুন খ্যাতিমান সাংবাদিক বজলুর রহমানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন মতিয়া চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য ২০২১ সালে বাংলা একাডেমি তাকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ প্রদান করা হয়। ষাটের দশকে জেল জীবন নিয়ে লিখেছেন বই; এর নাম ‘দেয়াল দিয়ে ঘেরা’।
এমন একসময় তার প্রস্থান হলো, যখন তার দল আওয়ামী লীগ বড্ড বিপদে। দুই মাস আগেই ক্ষমতাচ্যুত হলো তার দল। দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়। অনেকে বিদেশে পালানোর পাশাপাশি আত্মগোপনে। এমনই এক অবস্থায় মতিয়া চৌধুরী চলে গেলেন, যখন কি না রাজপথে তার ও দলের সাড়াশব্দ নেই। নিশ্চয় তিনি ভাবেননি, রাজনীতিক মতিয়ার মন খারাপের দিনে তার জীবনের ইতি হবে।