‘কদম গাছের ডালে/ পূর্ণিমা-চাঁদ আটকে পড়ে/ যখন সন্ধেকালে…’। সন্ধ্যাই তখন, ঘোর সন্ধ্যা। ২৩ এপ্রিল রাজধানীর ধানমন্ডি লেকের পাড়ে গাছগাছালির ভেতর দিয়ে ইটবাঁধানো পথে চলার সময় ঝিরঝিরে হাওয়ার সঙ্গে ভেসে এল মিষ্টি সুবাস। সেই চিরচেনা মনোহরা ঘ্রাণ, বর্ষার দূত!
চাঁদের বয়স তখন মাত্র দুই দিন। শুক্লপক্ষের সবে শুরু। পূর্ণিমার জন্য অপেক্ষা আরও সপ্তাহ দুয়েকের। বর্ষা আসতে তো ঢের দেরি। মেঘের সঙ্গে মিতালি বলেই নাকি কদমের আরেক নাম মেঘাগমপ্রিয়। তাই এমন দহনদাপট গ্রীষ্মে বাদলদিনের ফুলের দেখা পেয়ে মনে আনন্দের হিল্লোল বয়ে গেল!
লেকের পাড়ের বৈদ্যুতিক বাতির কৃত্রিম আলোয় পথ চলতে বেশ সুবিধা। তবে সে আলো কদমগাছের নিবিড় পাতায় ঘেরা অন্ধকার পর্যন্ত পৌঁছায়নি। ফুলগুলো সহজে চোখে পড়ে না। মনের সবটুকু আকাঙ্ক্ষাসমেত চোখ মেলে তবেই দেখা পাওয়া গেল সুষমামণ্ডিত কদমের। গাঢ় সবুজ পাতার ফাঁকে সাদা-হলুদ বর্তুলাকার ফুলের অপরূপ শোভা। তবে কিছু ফুল তখনই ঝরে পড়তে শুরু করেছে।
ধানমন্ডি ১৫ নম্বর থেকে বনানীতে প্রতিদিন যাতায়াত করেন ফারহানা বেগম। কর্মজীবী এই নারীর কথায় ফুল ফোটার সময়ের একটা ধারণা পাওয়া গেল। তিনি জানালেন, গত ঈদুল ফিতরের অন্তত দুই সপ্তাহ আগেই তিনি বিজয় সরণিতে কদম ফুল বিক্রি করতে দেখেছেন। যানজটে আটকা পড়লেই গাড়ির কাছে কদমের গোছা নিয়ে ছুটে আসত অনেক পথশিশু।
কদম ফুলের সৌন্দর্য তুলনারহিত। আকার ছোট্ট একটি বলের মতো। যদিও এটাকে আস্ত একটি ফুল মনে করা হয়, আসলে তা অনেক ফুলের সমাহার। ভেতরের পুষ্পাধারে হলুদ রঙের নলাকৃতির ফুলগুলো আটকে থাকে। তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে সাদা রঙের পরাগকেশ।
১৫ মে ধানমন্ডি লেকের পাড়ের সেই গাছে একটি ফুলেরও দেখা পাওয়া গেল না। এর মধ্যে ৪ মে চলে গেছে পূর্ণিমা। পরাগকেশসহ ফুলগুলো ঝরে পড়ার পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে একঝলক দেখে ‘লেবু’ বলে ভুল হতেই পারে! যদিও আকারে তা সুগোল, ফুলের চেয়ে আরেকটু ছোট, রং গাঢ় সবুজ।
তবে ২০ মে বিকেলের দিকে লেকের অন্য পাড়ে কদম ফুলের শোভা চোখ জুড়িয়ে দিল। বিদায়ী সূর্যের ঈষৎ নরম আলোয় ফুলগুলো যেন মুহূর্তে কংক্রিটের এই নগরীকে ভুলিয়ে দিল; হয়ে উঠল অপার নান্দনিকতার বার্তাবাহক! আর প্রাণও সেই বার্তার মর্মার্থ উপলব্ধি করল তৎক্ষণাৎ, এতটুকু দেরি না করে!
নিসর্গী দ্বিজেন শর্মার ভাষায়, ‘বর্ণে গন্ধে সৌন্দর্যে কদম এ দেশের রূপসী তরুর প্রথমদের অন্যতম’ (শ্যামলী নিসর্গ)। যথার্থই এই মূল্যায়ন। লম্বা গাছের মাথায় বড় বড় লম্বাটে পাতার প্রায় ঠাসবুনট সমাহার। কদমগাছ, কদম ফুল চেনেন না, এমন মানুষ এই দেশে সম্ভবত নেই। যদিও শহরাঞ্চলে কদমগাছের দেখা পাওয়া দিন দিন দুষ্কর হয়ে পড়ছে। কারণ, এর দারুর দাম প্রায় শূন্য। তাই শুধু ‘ফুলের মূল্য’ নিয়ে টিকে থাকতে পারছে না বাংলার রূপসী এ তরু।
বইপত্রের তথ্য বলছে, সংস্কৃত কদম্ব শব্দের অপভ্রংশ কদম। যা বিরহীকে ব্যথিত করে, তা-ই কদম্ব। ‘নির্জন যমুনার কূলে, বসিয়া কদম্ব ডালে/ বাজায় বাঁশি বন্ধু শ্যামরায়।’ সেই বাঁশির সুরে রাধার মন ব্যাকুল। বৈষ্ণব সাহিত্য রাধা-কৃষ্ণের বিরহ-বেদনায় একাকার হয়ে আছে কদমের সুরভি। এ কারণেই বুঝি কদমের আরেক নাম সুরভি!
কাব্যে, সংগীতে, নাটকে কতই-না বন্দনা কদমের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখাতেই আছে অজস্র উদাহরণ। ‘বাদল-দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান।’ কদমের আরেক নাম যে নীপ, তা জানা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়েই। সিন্ধুপুষ্প, প্রাবৃষ্য, বৃত্তপুষ্প, পুলকি, কর্ণপূরক, ভৃঙ্গবল্লভ, সর্ষপ, মঞ্জুকেশিনী, ললনাপ্রিয়—সবই কদমের নাম। যে ফুলের এত নাম, তার মুগ্ধতার ‘গান’ মনে মনে গুঞ্জরিতই তো হওয়ার কথা!
প্রকৃতির বুকে মানুষের কৃপাণ পড়ছে নির্দয়ভাবে। সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে গত এপ্রিল মাসে সাধারণভাবে যে গরম থাকে, এবার তাপমাত্রার পারদ ছিল তার চেয়ে চড়া। এমন দহনদিনে বর্ষার ফুলের দেখা পেয়ে মন যেমন উৎফুল্ল হয়, পরক্ষণে উদ্বেগেও ছেয়ে যায় মন। জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে প্রকৃতি কি আরও অচেনা হয়ে উঠবে?
প্রকৃতির আচরণে পরিবর্তন ঘটছে জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞানের অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বললেন, এর প্রভাব কদমেও পড়তে পারে। তাঁদের গত চার দশকের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, কদম বছরের একাধিক সময়ে ফোটে। বর্ষায় তো ফোটেই, এবার যেমন বসন্তের শেষে ফুটেছে, আবার শীতকালেও তাঁরা কদম ফুল ফুটতে দেখেছেন।
শুধু বর্ষার ফুল বলে সাহিত্যে যে কদমের স্তুতিগাথা, তা মূলত কবিমনের রোমান্টিকতার প্রকাশ বলেই মনে করেন এই অধ্যাপক। তাঁর ভাষায়, আগে এই সময়ে যেমন ঘন ঘন কালবৈশাখী হতো, এখন তেমনটা আর দেখা যায় না। আবার শীতকালের ব্যাপ্তি কমেছে। প্রকৃতি যখন নাতিশীতোষ্ণ থাকার কথা, তখন উঠছে তেতে। প্রকৃতির পরিবর্তনের প্রভাব প্রায় সবকিছুতেই পড়ছে। ফুল ধারণের জন্য দায়ী কিছু এনজাইম ও হরমোন তাপমাত্রা বা দিনের দৈর্ঘ্য ইত্যাদির ওপর নির্ভরশীল। তাই এখন যে কদম ফুটেছে বা কিছুদিন আগে যে ফুল ফুটেছিল, হয়তো অনুকূল পরিবেশ পেয়েছে বলেই ফুটেছে বা ফুটেছিল।