প্রত্যেক মানুষের মাঝেই প্রতিভা থাকে, তবে খুব কম মানুষই তাঁর প্রতিভার সঠিক পরিচর্যা করতে পারেন। অন্যদিকে সফলতা পাবার জন্য শুধু প্রতিভা থাকলেই হয় না, তা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে জানতে হয়। বরেণ্য অভিনেত্রী, চিত্রকর বিপাশা হায়াত বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। বিপাশা তাঁর ক্যারিয়ারের বিভিন্ন সময়ে শিল্পের বিভিন্ন জায়গায় বিচরণ করেছেন, বলা যায়, তিনি যেখানে হাত দিয়েছেন, সেখানেই সোনা ফলেছে। বেশ কয়েক বছর ধরে বিপাশা স্থায়ীভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন।
প্রায় আড়াই বছর পর গত মাসের শেষ সপ্তাহে নিউইয়র্ক থেকে মাত্র তিন সপ্তাহের জন্য ঢাকায় আসেন বিপাশা হায়াত। তাঁর এবারের ঢাকায় আসার অন্যতম দুটো কারণ ছিল। যার একটি হলো মা মাহফুজা খাতুন শিরিনের চোখের অপারেশন আর অন্যটি হলো বাবা আবুল হায়াতের আত্মজীবনীমূলক বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া।
বাবার জন্য কিছু কথা..
গত ২ নভেম্বর শিল্পকলা একাডেমিতে এক আয়োজনের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ হয় বরেণ্য অভিনেতা, নাট্যকার ও নির্মাতা আবুল হায়াতের আত্মজীবনী ‘রবি পথ’। বাবার অন্যান্য বইয়ের মতো আত্মজীবনী ‘রবি পথ’-এর প্রচ্ছদ এঁকেছেন কন্যা বিপাশা। বইটির প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বাবা আবুল হায়াতকে নিয়ে বিপাশা বলেন, ‘আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে খুব কম মানুষকে দেখেছি, যারা নিজের সম্পর্কে সত্য প্রকাশের সাহস রাখেন। আমার বাবা সবসময় সত্য কথা বলেন। সত্য বলার সাহস তাঁর আছে। কারণ তিনি একজন নিভাঁড় মানুষ। কখনও কোনো আয়োজনে আমি তাঁকে ভাঁড় হতে দেখিনি। কখনও তিনি নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করেননি। বাবা যখন কলম ধরেছেন, তিনি অভিনেতা, তিনি ইঞ্জিনিয়ার, তিনি কি পেশায় আছেন, সব কিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে তিনি লিখেছেন তাঁর জীবনের নানা ঘটনার কথা। এটি বাবাকে নিয়েই লেখা। কোনো গল্প নয়, উপন্যাস নয়। বাবা তাঁর সময়ের কথা লিখেছেন।’
দেখতে দেখতে তিন সপ্তাহ…
বিপাশা এবারে মাত্র তিন সপ্তাহের জন্য দেশে এসেছিলেন। ইচ্ছা ছিল তাঁর আঁকা চিত্রকর্মসহ কয়েকটি কাজের মিটিং করবেন। হঠাৎ ভাইরাসজনিত অসুস্থতায় তা আর করা হয়নি। বিপাশা বললেন, ‘বাবার বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানের পর দেশে আমার নতুন কাজের বিষয়ে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ের কথা ছিল; যা নিউইয়র্ক থেকে চূড়ান্ত করেছিলাম। কিন্তু হঠাৎ ঠান্ডা-জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার কারণে সেগুলো করা হয়নি। গত সাত দিন ধরে বাসাতেই ছিলাম। গতকাল [সোমবার] থেকে একটু সুস্থ। এবার দেখতে দেখতে তিন সপ্তাহ পার হয়ে গেলো। বুঝতেই পারলাম না। আগামী বৃহস্পতিবার [২১ নভেম্বর] ফিরে যাচ্ছি।’
অভিনয় প্রসঙ্গে
টিভি অভিনেত্রী হিসেবে বিপাশা তাঁর প্রজন্মের প্রথম সারিতেই ছিলেন। দেশের প্রথম প্যাকেজ নাটকের নায়িকা ছিলেন বিপাশা হায়াত। বিপাশা অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র হুমায়ূন আহমেদের ‘আগুনের পরশমণি’। এই সিনেমার জন্য ১৯৯৪ সালে বিপাশা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে। বিপাশা তাঁর অভিনয়জীবনে দর্শক আর সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছেন দারুণভাবে, যা খুব কম অভিনয়শিল্পীর পক্ষেই অর্জন করা সম্ভব। গত কয়েক বছর ধরে অভিনয়ে অনুপস্থিত বিপাশা। জানতে চাই, অভিনয় মিস করেন না? বিপাশা বললেন, ‘একদম মিস করি না, এটা তো বলা যাবে না। মাঝে মধ্যে মিস করি। আমি এখন মঞ্চে কাজ করতে বেশি ইন্টারেস্টেড। তার কারণ হচ্ছে, এ মুহূর্তে যে ধরনের নাটক মানুষ দেখতে চায়, যেভাবে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে গেছে, সে ধরনের কাজ বোধ হয় করতে পারব না।’
চিত্রকর্ম ও লেখালেখি প্রসঙ্গে
নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে বিপাশা টেলিভিশনের জন্য নাটক লেখার চিন্তাভাবনা করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি লিখলেন ‘শুধু তোমাকে জানি’ নামের একটি ধারাবাহিক। ইচ্ছে করেই তখন তিনি নাটক রচয়িতা হিসেবে ছদ্মনাম ব্যবহার করেছিলেন, যাতে করে শুধু তাঁর নামের কারণে নাটকটি জনপ্রিয়তা না পায়। কিন্তু টেলিভিশনে ধারাবাহিকটি প্রচারিত হবার পর যখন জনপ্রিয় হয়, তখন বিপাশা তাঁর লেখকসত্তা নিয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। এরপর একে একে রচনা করেন ‘ভালোবাসা জেগে থাকে প্রাণে’, ‘ডাইনোসর’, ‘মরা জোছনা’, ‘মধ্যরাত ও ঝরা পাতার গল্প’, ‘ছায়া’, ‘এ কী খেলা’– এরকম প্রায় অর্ধশত নাটক। একটি সময় অভিনয় নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও এখন সেই মাধ্যমে নেই তিনি। লেখালেখি ও চিত্রকর্ম– এই দুই মাধ্যমে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন তিনি। বরাবরই নিজের কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করেন বিপাশা। বললেনও তা-ই, ‘আমি আমার কাজটাই করতে ভালোবাসি, যে কাজটি আমার, সেটি করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।’
বিপাশার আহ্বান
প্রমিত ভাষার ব্যবহার একটি দেশের যে কোনো মাধ্যমে জরুরি। আর সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তার গুরুত্ব বলার অপেক্ষা রাখে না বলে মনে করেন বিপাশা। তিনি বলেন, ‘আমরা যারা সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করছি, আদতে ভাষার ব্যবহার নিয়ে কতটা ভাবছি? এখন নিম্নমানের কিংবা কুরুচিপূর্ণ শব্দের ব্যবহারে ছেয়ে গেছে টেলিভিশন ও ইউটিউবের প্রযোজনাগুলোয়। মাঝে মধ্যে ভাষার বিকৃতি নিয়ে বিভিন্ন দাবি উঠলেও এ সমস্যার পরিত্রাণ বিরাট আকারে চোখে পড়েনি। কারণ ড্রয়িংরুম থেকে শুরু হয় এ বিকৃতি। পথে নেমে কান পাতলে শোনা যায় আরও শত রকমের বিকৃত বাংলা উচ্চারণ। দেশে নতুন প্রজন্মের একটি বড় অংশ শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণে কথা বলতে পারে না। তাই আমি চাই সবাই ভাষাদূষণের বিরুদ্ধে এগিয়ে আসুন। একটি সফল প্রযোজনার অর্ধেক সাফল্য নির্ভর করে ভালো চিত্রনাট্য ও সংলাপের ওপর। নিম্নমানের সংলাপ যেমন প্রযোজনার মান কমায়, ঠিক তেমনি ভাষার দূষণও ছড়ায়। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম সে দূষণে আক্রান্ত হচ্ছে; যা দিনকে দিন আরও মহামারি আকার ধারণ করছে। দীর্ঘ সংগ্রাম আর রক্ত ঝরিয়ে বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকার পেয়েছি আমরা। ফলে আমাদের মনে রাখা উচিত, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আমরা যে কোনো মাধ্যমে যা-ই করি না কেন, সেখানে শুদ্ধরূপে প্রমিত বাংলার ব্যবহার থাকা উচিত। আসুন, সবাই ভাষার দূষণ বন্ধ করি। শুরুটা করি, নিজের পরিবার থেকেই।’
এই জীবনই আমি ভালোবাসি
কর্মের মাঝেই আনন্দ। এ কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন বিপাশা। তিনি বলেন, ‘বিশ্রামপূর্ণ জীবন কখনোই পছন্দ করি না। সৃষ্টিকর্তা যদি সুস্থ রাখেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাজ করে যেতে চাই। আমি আমার কর্মময় জীবন ভালোবাসি। এই যে আমার জীবন, বাচ্চাদের নিয়ে থাকা, ছবি আঁকা, লেখালেখি করা–এ জীবনই আমি ভালোবাসি।’