সংসারে সচ্ছলতার জন্য গরু বিক্রির ৪০ হাজার টাকা এবং এনজিও থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ছয় বিঘা জমি বর্গা নিয়ে ধান চাষ করেছিলেন সবিতা হালদার (৪০)। ফলনও হয়েছিল বেশ ভালো। তাই আশায় বুক বেঁধেছিলেন, এবার হয়তো বছর ভালো কাটবে। কিন্তু তাঁর সেই আশা লোনাপানিতে নিঃশেষ হয়ে গেছে। লোনাপানিতে পুড়ে গেছে তাঁর খেতের ধান।
বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার কালেখারবেড় এলাকার বাসিন্দা সবিতা হালদার। খেতের ধান ঘরে তুলতে মাত্র ১৫ দিন সময় চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালীরা খালের বাঁধ কেটে লবণ পানি প্রবেশ করানোয় নষ্ট হয়ে গেছে তাঁর কষ্টার্জিত ধান। এতে পুড়েছে তাঁর স্বপ্ন-আশা।
রামপালের কৃষক হুমায়ুন কবির বলেন, ‘কৃষি বিভাগ থেকে বিনা মূল্যে বীজ ও সার দেওয়ায় কৃষকেরা আগ্রহ নিয়ে ধান চাষ করেছিলেন। হঠাৎ করে ঘেরে লবণ পানি প্রবেশ করায় খালের বাঁধ কেটে দেন ঘেরচাষিরা। বাঁধটি কাটার আগে স্থানীয় চেয়ারম্যান, কৃষি অফিসার ও ইউএনওকে বিষয়টি জানিয়েছি। ধান কেটে ঘরে তোলার জন্য মাত্র ১৫ দিন সময়ও চেয়েছিলাম। কিন্তু কেউ আমাদের কথা শোনেনি।’
বাগেরহাট সদর উপজেলার কাশিমপুর এলাকায় চার বিঘা জমিতে ধান রোপণ করেছিলেন মো. সুজন শেখ। তাঁর জমিকৃষি বিভাগের সহায়তাপ্রাপ্ত ব্লকের মধ্যে ছিল। প্রায় ৭০ হাজার টাকা ব্যয়ও করেছেন। কৃষি বিভাগের করা সেচ লাইন দিয়ে খেতে পানি দিয়েছেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে তাঁর জমির ধানও মরে গেছে। কারণ হিসেবে সুজন শেখ বলেন, নদীতে লবণ পানি প্রবেশ করানোয় সেচ লাইনে লবণ পানি আসায় ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
একই চিত্র বাগেরহাটের তিনটি উপজেলার অন্তত ৪০টি এলাকায়। স্থানীয় কৃষকদের ভাষ্য, চাষাবাদের জমিতে মিষ্টি পানির অভাব ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের খালে লবণ পানি প্রবেশ করিয়ে মাছ চাষ। এই দুই কারণে এক মাসে তিনটি উপজেলায় অন্তত ১ হাজার ১০০ বিঘা জমির ধান নষ্ট হয়ে গেছে। ক্ষতি হয়েছে প্রায় আড়াই কোটি টাকা। এর মধ্যে রামপাল উপজেলায় ধান ওঠার মাত্র ১৫ দিন আগে খালে লবণ পানি প্রবেশ করানোয় নষ্ট হয়ে গেছে প্রায় ৩০০ বিঘা জমির ইরি ধান। চিংড়ির পোনা ছাড়ার সময় হওয়ায়, প্রভাবশালী ঘেরমালিকেরা খাল কেটে ধানের জমিতে লবণ পানি প্রবেশ করানোয় দুই শতাধিক কৃষকের প্রায় কোটি টাকার ওপরে ক্ষতি হয়েছে। তবে ১৫-২০ দিন পর পানি প্রবেশ করালে ধানের ক্ষতি হতো না।
বাগেরহাট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুবাইয়া তাসনিম বলেন, পুরো এলাকা সরেজমিনে দেখে ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে জানানোর জন্য ইতিমধ্যে উপজেলা কৃষি বিভাগকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এসব স্লুইসগেট গেট দিয়ে যাতে লবণ পানি ঢোকাতে না পারেন, সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার আশ্বাসও দেন তিনি।
ধান কাটার জন্য ১৫ দিন সময় চেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করেও কোনো সুফল পাননি বলে দাবি হতদরিদ্র কৃষকদের। তাঁরা জানিয়েছেন, রামপাল উপজেলার রাজনগর ইউনিয়নের ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্য দিয়ে যাওয়া কালেখারবেড় এলাকার ঘরের খালের বাঁধ কেটে মৎস্য ঘেরে পানি ঢুকিয়েছেন জুলু হাজিসহ স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এতে দুই-তিন দিনের মধ্যে ধানের গোড়া পচে নষ্ট হয়ে যায়। শুধু কালেখারবেড় নয়, উপজেলার রাজনগর ইউনিয়নের সিংগুরবুনিয়া, রনজয়পুর ও আড়ুয়াডঙ্গা এলাকায়ও লোনাপানির কারণে কৃষকের খেতের ধান মরতে শুরু করেছে।
রাজনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুলতানা পারভিন বলেন, ধান চাষের জন্য কৃষকেরা এক মত হয়ে খাল আটকে ধান চাষ শুরু করেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে কিছু ঘের ব্যবসায়ী পানি ঢুকিয়ে মাছ চাষ করতে চান। এ কারণে মাছচাষিরা বাঁধটি কেটে দিয়েছেন। মানবিক কারণে চাষিদের ১৫ দিন সময় দেওয়া উচিত ছিল।
বাগেরহাট সদর উপজেলার ডেমা ও খানপুর ইউনিয়নের অন্তত ৩০০ বিঘা জমির ধান পচে গেছে। ডেমা ইউনিয়নের বাঁশবাড়িয়া ও ছবাকি স্লুইসগেট দিয়ে ছবাকি নদীতে লবণ পানি প্রবেশ করানোর কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এতে ডেমা, পিসি ডেমা, কাশিমপুর, খেগড়াঘাট, বেতবুনয়িাসহ কয়েকটি গ্রামের দুই শতাধিক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এর মধ্যে কাশিমপুর মৌজায় থাকা সরকারি সহযোগিতাপ্রাপ্ত ব্লকের ধানও নষ্ট হয়েছে।
বাগেরহাট সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাদিয়া সুলতানা বলেন, ডেমা ইউনিয়নে এ মৌসুমে প্রায় ৬০০ হেক্টর জমিতে ধান চাষ হয়েছে। এর মধ্যে কিছু ধান মারা গেছে। তাঁরা কৃষকদের জমির মাটি পরীক্ষা করেছেন। মাটিতে লবণের পরিমাণ অনেক বেশি। এ বছর বৃষ্টিপাত কম হওয়ার কারণে মাটির লবণ কাটেনি।
হাড়িখালীসহ পাশাপাশি তিনটি স্লুইসগেট গেট দিয়ে পুঁটিমারি বিলে লবণ পানি ঢোকায় স্থানীয় হাড়িখালী ক্ষুদ্র পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি। সমিতিটির খামখেয়ালিতে পুঁটিমারি বিলের অন্তত ২০০ বিঘা জমির ধান নষ্ট হয়ে গেছে দাবি করেছেন কৃষকেরা।
এদিকে মোরেলগঞ্জে কৃষকের ধান কাটার ২০ দিন আগে একই কায়দায় মৎস্য ঘেরে লবণ পানি তোলার কারণে ৩০০ বিঘা জমির ধানখেত পুড়ে গেছে। ঘটনার বিচার চেয়ে গত সোমবার ধানখেতের পাশে মানববন্ধনও করেন ভুক্তভোগীরা।
মোরেলগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আকাশ বৈরাগী বলেন, প্রভাবশালীরা ঘেরে লবণ পানি তুলে হতদরিদ্র কৃষকদের অপূরণীয় ক্ষতি করেছেন। তাঁরা দেনাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেয়েছেন। তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাগেরহাট সদর উপজেলার ডেমা ইউনিয়নে স্লুইসগেট গেট থেকে কারা লবণ পানি ঢুকিয়েছে—এমন প্রশ্নের জবাবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন কৃষক বলেন, ডেমা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর হোসেনসহ স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ছবাকি ও বাসবাড়িয়া স্লুইসগেট গেট নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁরাই তাঁদের প্রয়োজনে লবণ পানি প্রবেশ করান।
তবে লবণ পানি প্রবেশ করানোর বিষয়ে ডেমা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, কৃষকদের সম্মতিতে মাঘী পূর্ণিমার সময় এসব গেট থেকে পানি ঢোকানো হয়েছে। কারণ তখন পানি মিষ্টি ছিল। এরপর আর কোনো পানি ঢোকানো হয়নি। মূলত মাটির তল থেকে ওঠা একটি অপরিচিত পোকার আক্রমণে ধান মারা যাচ্ছে। চাষিরা ভুল বুঝে লবণ পানির কথা বলছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাগেরহাট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাসুম বিল্লাহ বলেন, লবণ পানি যাতে প্রবেশ না করতে পারে, সে জন্য তাঁরা স্লুইসগেট গেট বন্ধ করে দিয়েছেন। কিন্তু রাতের আঁধারে কে বা কারা স্লুইসগেট গেট খুলে পানি প্রবেশ করায়, তা জানেন না। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।
মৌসুমের শেষ পর্যায়ে এসে ধান নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আর্থিক চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন কৃষকেরা। তাঁরা বলছেন, জমির ধান বেড়িবাঁধের মধ্যে। বেঁড়িবাধ দেওয়া হয়েছে মানুষকে লবণ পানি এবং ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচানোর জন্য। সেই বেড়িবাঁধের স্লুইসগেট দিয়ে চিংড়ি চাষের জন্য যদি লবণ পানি উঠিয়ে ধান নষ্ট করা হয়, তাহলে কৃষকেরা বাঁচবেন কীভাবে?