বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তানের ত্রিদেশীয় ফোরামে ঢাকাকে সক্রিয় করতে বেইজিংয়ের চাপ

0
18
গত ১৯ জুন চীনের কুনমিংয়ে বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের মধ্যে একটি অনানুষ্ঠানিক ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়ছবি: ইউএনবি

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে নিয়ে গত জুনে কুনমিংয়ে ত্রিদেশীয় এক ‘অনানুষ্ঠানিক আলোচনা’র আয়োজন করেছিল চীন। যদিও ঢাকা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, এটি কোনো জোট গঠন নয়, কেবলই কর্মকর্তা পর্যায়ের আলোচনা। তবু থেমে নেই বেইজিংয়ের তৎপরতা। ত্রিদেশীয় উদ্যোগে বাংলাদেশকে সক্রিয় করতে কূটনৈতিক চাপ ও কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছে চীন।

চীনের ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিংয়ে গত ১৯ জুন চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিবেরা বৈঠক করেছিলেন। এরপর গত এক মাসে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলের আলোচনায় ওই ত্রিদেশীয় উদ্যোগের প্রসঙ্গ এসেছে।

২১ জুলাই ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। ওই আলোচনায় চীনের রাষ্ট্রদূত পুনরায় ত্রিদেশীয় উদ্যোগের প্রসঙ্গটি তোলেন। ইয়াও ওয়েন জানান, সেপ্টেম্বর মাসে চীন ত্রিদেশীয় উদ্যোগের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম বৈঠক পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে করতে আগ্রহী। চীন আশা করে, বাংলাদেশ ওই বৈঠকে যোগ দেবে। যদিও বাংলাদেশ এখনই ত্রিদেশীয় উদ্যোগের কোনো বৈঠকে যোগ দিতে আগ্রহী নয়

এর আগে ১১ জুলাই মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে আসিয়ান আঞ্চলিক ফোরামের (এআরএফ) মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকের একফাঁকে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে দেখা করেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। ওই বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় এবং আন্তর্জাতিক নানা বিষয়ের পাশাপাশি ওয়াং ই কুনমিংয়ের বৈঠকের প্রসঙ্গটি তুলেছিলেন। তিনি বলেন, এটি একটি উন্মুক্ত গ্রুপ। অন্যরাও এসে এতে যুক্ত হতে পারে। এ উদ্যোগে বাংলাদেশের সক্রিয় ভূমিকা রাখা উচিত।

কুয়ালালামপুরের কূটনৈতিক সূত্রগুলো এই প্রতিবেদককে জানিয়েছে, কুনমিংয়ের উদ্যোগের বিষয়ে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলোচনায় তুললেও কোনো মতামত দেননি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। তিনি মনোযোগ দিয়ে হাসিমুখে কথা শুনেছেন।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আলোচনায় ত্রিদেশীয় উদ্যোগের প্রসঙ্গটি যে এসেছে, তা এই প্রতিবেদককে বলেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ এখনই এমন কোনো ত্রিদেশীয় উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হবে না।

ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিংয়ে ১৯ জুন বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের আলোচনা
ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিংয়ে ১৯ জুন বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের আলোচনাছবি: সংগৃহীত

কূটনৈতিক সূত্রগুলো এই প্রতিবেদককে জানিয়েছে, ১৯ জুন কুনমিংয়ে বৈঠক হওয়ার পর থেকে চীন অন্তত পাঁচবার বাংলাদেশের সঙ্গে ত্রিদেশীয় উদ্যোগ এগিয়ে নেওয়ার বিষয়টি আলোচনায় তুলেছে। তবে চীনের এ প্রয়াসের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যা-ই হোক না কেন, ঢাকা এমন কিছু করতে চায় না, যা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিসরে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সন্দেহের উদ্রেক করবে। তা ছাড়া পাকিস্তানের সঙ্গে দেড় দশকের স্থবির সম্পর্ক সম্প্রতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। দেশটির সঙ্গে ঐতিহাসিক কিছু রাজনৈতিক ইস্যুর নিষ্পত্তি হয়নি। ফলে ত্রিদেশীয় উদ্যোগ বাস্তবায়নে বাংলাদেশের যুক্ততার বিষয়টি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত বলে মনে করেন দেশের কূটনীতিকেরা।

এখনই যুক্ত না হওয়ার বিষয়ে আরেকটি দিক রয়েছে মনে করছেন কূটনীতিকেরা। চীন ত্রিদেশীয় উদ্যোগের মাধ্যমে আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা জানালেও নেপাল ও শ্রীলঙ্কাকে যুক্ত করা হয়নি। এ নিয়ে বাংলাদেশ জানতে চেয়েছিল চীনের কাছে। তবে দক্ষিণ এশিয়ার এই দুই দেশকে ত্রিদেশীয় উদ্যোগে যুক্ত হতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে কি না, তা স্পষ্ট করেনি চীন।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে দলের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল গত মাসে (২২ থেকে ২৭ জুন) বেইজিং সফর করে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে এ সফরের শুরুতে মির্জা ফখরুলের প্রথম বৈঠকটি হয়েছে চীনের পররাষ্ট্রসচিব সান ওয়েডংয়ের সঙ্গে। বাংলাদেশের কোনো শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতার প্রকাশ্যে এভাবে চীনের পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে আলোচনায় বসাটা বিরল। এ বৈঠকেও ত্রিপক্ষীয় ফোরাম গঠনের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে।

এরপর ১১-১৫ জুলাই জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে দলের একটি প্রতিনিধিদলও বেইজিং সফর করেছে। কূটনৈতিক সূত্রগুলো ধারণা করছে, বিএনপির মতো জামায়াতের কাছেও ত্রিদেশীয় উদ্যোগের বিষয়টি তুলেছে চীন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র এই প্রতিবেদককে জানায়, এ মাসের শুরুতে চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করেন। এ সময় চীনের রাষ্ট্রদূত ত্রিদেশীয় উদ্যোগ বাস্তবায়নের প্রসঙ্গটি তোলেন। এ সময় চীনা রাষ্ট্রদূতকে জানানো হয়, আগে তিন দেশকে সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো আলোচনা করে চূড়ান্ত করতে হবে। পাশাপাশি এই সহযোগিতার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, কাঠামো কী হবে, সে বিষয়গুলো নিয়ে প্রতিটি দেশ আলাদা করে মতামত দিতে পারে। এরপর ঠিক হতে পারে এ উদ্যোগের ভবিষ্যৎ পথরেখা।

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) প্রেসিডেন্ট এম হুমায়ুন কবীর মনে করেন, বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে চীন একধরনের আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। বর্তমান বাস্তবতায় বৈশ্বিক ব্যবস্থাটা বিবর্তনশীল। চূড়ান্তভাবে দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক ইস্যু নির্দিষ্ট গণ্ডিতে সীমিত থাকছে না। ফলে চীনের ত্রিদেশীয় উদ্যোগে বৈশ্বিক মাত্রা যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই এমন উদ্যোগে সক্রিয়ভাবে যুক্ততার ক্ষেত্রে সতর্কতার সঙ্গে এগোনো উচিত।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.