বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতার পথেই থাকুক ভারত, চায় যুক্তরাষ্ট্র

0
25
যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব ও অর্থ দপ্তরের আন্তর্জাতিক অর্থায়নবিষয়ক সহকারী আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যান এবং পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আগামীকাল শনিবার ঢাকায় আসছে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল। ছয় সদস্যের প্রতিনিধিদলটির নেতৃত্ব দেবেন যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব ও অর্থ দপ্তরের আন্তর্জাতিক অর্থায়নবিষয়ক সহকারী আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যান। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের জরুরি চাহিদা এবং দুই দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নিয়ে এই সফরে যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও সংস্কারে কীভাবে সহায়তা করা যায়, তাতে গুরুত্ব দেবে।

ঢাকা ও ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের সন্ধিক্ষণে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সংস্কারপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার এক দারুণ সুযোগ তৈরি হয়েছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের আমলে দুই দেশের সম্পর্ক নিরবচ্ছিন্নভাবে এগিয়ে নেওয়ার পথ উন্মোচিত হয়েছে। ফলে অর্থনৈতিক ও গণতান্ত্রিক সংস্কারে যেখানে যেখানে সহযোগিতার সুযোগ আছে, সেখানেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্র।

ওয়াশিংটনের প্রতিনিধিদলের এবারের বাংলাদেশ সফরে অর্থনীতিতে অগ্রাধিকার থাকলেও শেষ পর্যন্ত রাজনীতি দুই দেশের সম্পর্কে বড় নিয়ামক হয়ে থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য হিসেবে কাল দুপুরে দিল্লি হয়ে ঢাকায় আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। আলবেনিয়া আর কিরগিজস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন শেষে তিনি ২০২১ সালে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। ডোনাল্ড লু এই দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে তাঁকে নিয়ে যথেষ্ট আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এবার ওয়াশিংটন থেকে দিল্লি হয়ে তিনি ঢাকায় আসছেন। দিল্লিতে দুই দেশের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত বৈঠকে যোগ দিচ্ছেন তিনি। ফলে ঢাকায় আসার আগে তাঁর দিল্লি সফর নিয়ে বাংলাদেশে কৌতূহলের কারণ রয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে একধরনের অস্বস্তির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক।

ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতি নিয়ে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোয় যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। তবে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পরবর্তী পরিস্থিতিতে ভারত যেভাবে দেখছে, একইভাবে দেখছে না যুক্তরাষ্ট্র। তাই বাংলাদেশের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার সামগ্রিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে অন্তর্বর্তী সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র সম্ভাব্য সব ধরনের সহযোগিতা দিতে চায়। ওয়াশিংটনের প্রত্যাশা, ঢাকার সঙ্গে সহযোগিতার পথেই হাঁটবে দিল্লি। বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তাদের বার্তা ভারতকে দিয়েছে। দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সুসম্পর্কের স্বার্থে বাংলাদেশ ও ভারতের রাজনৈতিক পর্যায়ে যোগাযোগ ও কথাবার্তা নিয়মিতভাবে চালু থাকাটা জরুরি বলে মনে করে যুক্তরাষ্ট্র। এরই অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র চাইছে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাক্ষাৎ হোক।

  • কাল ঢাকায় আসছে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল
  • দিল্লিতে বৈঠক করে আসবেন ডোনাল্ড লু
  • ওয়াশিংটন সম্প্রতি বার্তা দিয়েছে দিল্লিকে

যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব ও অর্থ দপ্তরের আন্তর্জাতিক অর্থায়নবিষয়ক সহকারী আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যানের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের প্রতিনিধিদলে ডোনাল্ড লু ছাড়াও রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার (ইউএসএআইডি) উপসহকারী প্রশাসক অঞ্জলি কাউর, যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধি ব্রেন্ডন লিঞ্চ।

জানা গেছে, এই সফরের সময় বাংলাদেশকে ইউএসএআইডির ২০০ কোটি ডলারের আর্থিক খাতে কারিগরি সহযোগিতার বিষয়ে একটি চুক্তি সই হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের সদস্যরা কাল শনিবার আলাদা আলাদাভাবে ওয়াশিংটন ও দিল্লি থেকে ঢাকায় আসবেন। কাল বিকেলে তাঁরা একটি ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদলের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন। প্রতিনিধিদলটি আগামী রোববার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এবং অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবে। দুপুরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের সদস্যরা পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেবেন। ওই দিন বিকেলে প্রতিনিধিদলের নেতা যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব দপ্তরের ডেপুটি আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে বৈঠক করবেন।

সংস্কারে সহযোগিতা ও বিনিয়োগের উন্নতি

বাংলাদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলার পাশাপাশি অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনাটা গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করছে যুক্তরাষ্ট্র। তাই আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতার পাশাপাশি পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে সহায়তা করা, বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত করে নতুন বিনিয়োগের পথ সুগম করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্রের একটি সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। এই সহযোগিতার ৭০ শতাংশে অবদান শেভরন আর এক্সিলারেট এনার্জির। এই মুহূর্তে শেভরনের ২০ কোটি ডলার বাকি রয়ে গেছে। কীভাবে এই টাকা পরিশোধ করা হবে, সেটা জরুরি। তাই ভবিষ্যৎ বিনিয়োগের স্বার্থে বকেয়া টাকা পরিশোধ ও লভ্যাংশ ফেরতের মতো বিষয়গুলোর সুরাহা হওয়াটা জরুরি।

জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব ও অর্থ বিভাগ বাংলাদেশের আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা আনতে বিষয়ে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি বিনিয়োগের পরিবেশে উন্নতি ও দুর্নীতি দমনে সহায়তা দিতে আগ্রহী।

বাজেট–সহায়তা বা ঋণ নয়, আর্থিক খাতে কারিগরি–সহায়তা

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের সফরে অর্থনৈতিক সহযোগিতায় গুরুত্বের প্রেক্ষাপটে বাজেট–সহায়তা বা ঋণের বিষয়টি এসেই যায়। কিন্তু দুই দেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এটা মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গেছে, বাংলাদেশের রিজার্ভে ঘাটতি আর আর্থিক সংকটের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এই মুহূর্তে ঋণ পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আর প্রক্রিয়াগতভাবে কংগ্রেসের অনুমোদনসহ নানা কারণে সেটি সম্ভবও নয়। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে কংগ্রেসের অনুমোদনের পর ইউক্রেনকে বড় আকারে ঋণ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

ঢাকার এক কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, প্রক্রিয়াগত কারণ এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিয়মানুযায়ী ঋণ পাওয়ার সুযোগ নেই। আবার যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনের বছরে তা প্রায় অসম্ভব। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশকে সহায়তা করার সুযোগ আছে যুক্তরাষ্ট্রের।

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের দুই কূটনীতিক এই প্রতিবেদককে বলেছেন, ব্যাংকিং খাত সংস্কার, মুদ্রা ব্যবস্থাপনা, পাচার হওয়া টাকার বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া এবং আর্থিক খাতে নজরদারির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব ও অর্থ বিভাগের বিশেষায়িত জ্ঞান রয়েছে। এ বিষয়গুলোতে বাংলাদেশের চাহিদা অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র কারিগরি সহযোগিতা দিতে তৈরি আছে।

ওয়াশিংটনের একটি কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে আলাদা একটি বৈঠক করে কোথায় কোথায় সহযোগিতা দরকার, তা জানবে। এরপর প্রয়োজন অনুযায়ী সহায়তা দেবে যুক্তরাষ্ট্র।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.