তিন চাকার এক অটোচালক ওই পথ ধরে ফেরার পথে শত বছরের এক শিরীষ গাছের নিচে দাঁড়িয়ে মুঠোফোনে কথা বলছিলেন। সামনে যাবেন জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, ‘না আমার খ্যাপ আছে। যাত্রী লইয়্যা এইহানে আবার আইতে অইবে।’ এত রাতে…প্রশ্ন শুনেই বললেন, ‘আরে ভাই আইজ ব্রাজিলের খেলা না!’ অল্প আলাপের পর শফিকুল নামের এই চালক শো শো করে খালি অটো নিয়ে ছুটলেন বঙ্গবন্ধু উদ্যানে যাত্রী আনার জন্য।
একটু সামনে এগোতেই বিশাল বঙ্গবন্ধু উদ্যান লোকে লোকারণ্য। বরিশাল সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে এবারের বিশ্বকাপের সব খেলা দেখতে এই উদ্যানে একটি ডিজিটাল পর্দা বসানো হয়েছে। সেখানে তরুণ-তরণী, শিশু, বৃদ্ধ, মাঝ বয়সী সবাই আছেন।
খেলা শুরু হতে তখনো মিনিট পাঁচেক বাকি। ভুভুজেলা বাজাতে বাজাতে কেটিসি এলাকার এক কিশোর ব্রাজিলের জার্সি গায়ে এখানে এসেছে, বড় পর্দায় প্রিয় দলের খেলা দেখতে। তমাল নামের ওই কিশোরই নয়, শত শত কিশোর-তরুণ ভুভুজেলা হাতে উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠেন।
বঙ্গবন্ধু উদ্যানের স্থায়ী মঞ্চে বিরাট পর্দা লাগানো হয়েছে। আছে সাউন্ড সিস্টেম। সামনে কয়েক হাজার চেয়ার। কিন্তু তাতেও সংকুলান হয়নি। দাঁড়িয়ে, বসে, যে যেভাবে পারেন নকআউট পর্বে ব্রাজিল বনাম দক্ষিণ কোরিয়ার খেলা দেখতে চান।
বান্দরোডের বাসিন্দা মিলন প্রতিদিনই এখানে খেলা দেখেন। কিন্তু আজ তিনি আগেভাগেই এখানে এসেছেন আয়েশ করে খেলাটা দেখবেন বলে। তিনি বলেন, ‘বাড়িতে টিভি আছে কিন্তু এভাবে বড় পর্দায় হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে খেলা দেখার আনন্দটাই ভিন্ন। মনে হয় বড় কোনো স্টেডিয়ামে বসে সরাসরি খেলাটা দেখছি। আর ব্রাজিল মানে আমাদের হৃদয়ের স্পন্দন। সেই দলের খেলা এতটা উজ্জ্বলভাবে দেখছি, মনে হয় নেইমার আমার চোখের সামনে দৌড়াচ্ছেন।’
ঘড়ির কাটায় একটা বাজতেই রেফারির বাঁশি বেজে উঠল। তখন পুরো উদ্যানে উচ্ছ্বাস, ভুভুজেলার শব্দে মুখর চারদিক। খেলা শুরু হয়। তীব্র উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ল ৭ মিনিটে, যখন দক্ষিণ কোরিয়ার জালে ঢুকে পড়ল ব্রাজিলের প্রথম গোল। প্রথমার্ধে তিন গোলের ব্যবধানে এগিয়ে থাকার পর ব্রাজিলের দর্শকেরা নিশ্চিত হয়ে যান, তাদের দল আজ জিতবে। একের পর এক গোল হচ্ছিল আর হর্ষধ্বনিতে ফেটে পড়ছিলেন হলুদ জার্সির ব্রাজিল সমর্থকেরা। তাঁদের মুখে উচ্চারিত হচ্ছিল ‘বিউটিফুল গেম’।
মেহেদী হাসান একজন সংবাদকর্মী। তাঁর বাড়ি বঙ্গবন্ধু উদ্যান থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে নথুল্লাবাদ এলাকায়। তিনি অফিসের কাজ শেষে প্রিয় দলের খেলা দেখতে এসেছেন। বললেন, ‘বলেছিলাম প্রিয় দল ব্রাজিল আজ অন্তত চারটি গোল দেবে, হলোও তাই।’
নগরের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী উচ্ছাস মজুমদার বলছিলেন, ‘বোঝাতে পারব না প্রিয় দলের এই জয়ের আনন্দ কতটা গভীরভাবে আমাদের আনন্দিত করেছে।’
উদ্যানের সামনের সড়কে দেখা যায় কয়েক হাজার মোটরসাইকেল সারিবদ্ধভাবে রাখা। ছিল সারি সারি খাবারের দোকান। ভাপা পিঠা, ঝালমুড়ি, বাদাম, ডাব, ফাস্ট ফুডসহ নানা খাবারের পসরা দেখা গেল এসব দোকানে। খেলা দেখতে আসা মানুষের কারণে এসব ভ্রাম্যমাণ দোকানে বিক্রিবাট্টাও বেশ ভালো।
খেলার যে গতি, তাতে জয়-পরাজয় আগেই নিশ্চিত হয়ে যান দর্শকেরা। তাই রাত আড়াইটার পর আর কোনো উত্তেজনা ছিল না। ধীরে ধীরে উদ্যান ছাড়তে থাকেন দর্শকেরা। জয়ী দলের একদল সমর্থক ছোট ট্রাকে স্লোগান দিচ্ছিলেন আর ভুভুজেলা বাজিয়ে নগরের সড়কে সড়কে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। তাঁদের স্লোগান আর আনন্দে মুখর হয়ে ওঠে মধ্যরাতের নগর।